সত্য সেলুকাস
আইডিবিআই ব্যাঙ্কে ৯০০০ হাজার কোটি টাকা
সুদেমূলে বকেয়া ঋণ। শুধু আইডিবিআই নয় স্টেট ব্যাঙ্কসহ
মোট ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ব ও প্রাইভেট ব্যাঙ্কে মোট দেনা আরও ৬,৯৬৩ কোটি টাকা। মাসিক
কিস্তি দিতে বিলম্ব ও অনাদায়ের কারণে তার ওপর জরিমানা হয়েছে আরও ৭.৬১ লক্ষ টাকা।
অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে ১৬০০০ কোটি টাকার ওপর দেনা যা সুদাসলে ক্রমবর্ধমান। পরিশোধের
কোনও চেষ্টাই নেই। একটি বৃহৎ শিল্প সংস্থায় লালবাতি জ্বলা মানে কয়েক সহস্র মানুষের
জীবিকা চলে যাওয়া। মূলত এটাই হয় শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পথে সবচেয়ে
বড় অন্তরায়।
তবু কিং ফিশারের ছয় সহস্রাধিক
কর্মী কর্মচ্যুত। মাইনে বন্ধ বছরের পর বছর। কর্মী সংখ্যা ২০১২-র মার্চে ৬,১৮৫ থেকে কমে ঐ বছরই ডিসেম্বরে ৩,৩৩৯ হয়ে গেছে।
তারপরে ২০১৫ থেকে কর্মীসংখ্যা কঙ্কালসার। তার পরেও শ্রম মন্ত্রক দিয়েছে ক্লিন চিট
যেহেতু ২০১২ পর্যন্ত কর্মীদের এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিংফিশার কোম্পানির তরফ
থেকে অনুদান জমা পড়েছে। কিন্তু ২০১৬-য় এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট (ED) লিকার সম্রাট বলে খ্যাত এই ভদ্রলোককে বিমান পরিষেবার জন্য গৃহীত ঋণ অনাদায়ের
কৈফিয়ত দিতে ১৮ই মার্চ হাজিরা দিতে নির্দেশ দেয়। আর রাজামশাই দুই যুযুধান রাজনৈতিক
দল বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে কাজিয়া উস্কে ২রা মার্চ ড্যাংডেঙিয়ে বিদেশে উড়ে
গেলেন। তিনি নাকি লন্ডনে বসে ‘সানডে গার্ডিয়ান’ কাগজে ইমেইলে সাক্ষাতকার দিয়ে
মন্তব্য করেছেন, তিনি পলাতক নন, দেশের আইন মেনেই চলবেন। কিন্তু যেহেতু দেশে এখন
তার পরিচয় দুষ্কৃতী, তাই ফিরতে ভরসা পাচ্ছেন না। মাল্যবাবু অবশ্য নিজে এমন কোনও
সাক্ষাতকারের কথা স্বীকার করেননি। মজার কথা, যাবতীয় আর্থিক অনিয়ম কংগ্রেস পরিচালিত
ইউপিএ সরকারের আমলে হয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক তদন্তের চাপে শিল্পপতির ২ মার্চ ২০১৬-য়
উড়ে পালানোকে দেখিয়ে বিরোধীরা একযোগে বিজেপি পরিচালিত এনডিএ সরকারের ঘাড়ে দায়
চাপাতে চাইছে।
২০০২ নাগাদ ছাবারিয়া পরিবারের কাছে
থেকে ১৩০০ কোটি টাকার বিনিময়ে যে শ ওয়ালেস কিনেছিলেন, বলা বাহুল্য সেটাও নিজের
টাকায় নয়, ব্যাঙ্ক ঋণ গ্রহণ করেই। মদের ব্যবসায় মন্দ আয় ছিল না। সেই সাথে এয়ার বাস। তারপরেও ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ের
একটি আইডিবিআই ব্যাঙ্কের শাখায় বিমান পরিষেবা খোলার জন্য ঋণের আর্জি জানান।
মাত্রতিরিক্ত জ্বালানি মূল্যের কারণে ও প্রাইভেটাইজ়েশনের জেরে বাজারে প্রতিযোগিতা
বেড়ে যাওয়ায় চলতি এয়ারলাইনস্গুলো তখন থেকে সংকটেই ছিল। তার ওপর বিজয় মাল্যর
ম্যাঙ্গালোর কেমিকালস্ অ্যান্ড ফার্টিলাইজ়ার অধিগ্রহণ নিয়ে কিঞ্চিত বিতর্কও
জন্মেছিল। তাই ঋণের আবেদন প্রাথমিকভাবে মঞ্জুর হয়নি। ২০০৯ সালে বিজয় মাল্যকে কিসের
ভিত্তিতে ৯০০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হল সেটাই এখন ব্যাঙ্কের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে
সিবিআই-এর প্রথম প্রশ্ন।
প্রশ্ন এটাও লোকটার কি আদৌ ঋণ
পরিশোধের পরিকল্পনা ছিল? প্রশ্ন যাই হয়ে থাক, জবাব দেওয়ার জন্য দেশের আইন ও
প্রশাসন আসামির বিদেশে পলায়ন আটকে রাখতে পারেনি। তাঁর বিলাস ব্যসনেরও অভাব হচ্ছে
না।
আর একটা ছবি দিচ্ছি। ২০১৫-তে ভারতে
কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ৩,২২৮, ২০১৪-তে যে সংখ্যাটা ছিল ৫৬৫০। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র
২০০৪-এ – ১৮,২৪১। এক মহারাষ্ট্রেই ২০০১ সাল থেকে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ২০,৫০৪
যার অধিকাংশ মারাঠওয়াড়া অঞ্চলের। এই নথিভুক্ত পরিসংখ্যানের
বাইরে আরও আত্মহনন হয়ে থাকতেই পারে। তাছাড়া মৃত্যুর পরিসংখ্যান তো চূড়ান্ত শিকারের
হদিশ দেয়, যারা নিরন্তর জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছে, তাদের কথা বলে না। ২০০৫ থেকে গত
এক দশকে কৃষক আত্মহত্যার হার প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় ১.৪ থেকে ১.৫।
গবেষক ও সমাজসেবীরা এই ভয়াবহ
প্রবণতার একাধিক কারণ দর্শেছেন। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি, ঋণের বোঝা, জেনেটিক-ভাবে
রূপান্তরিত বীজ, সরকারি নীতি, জনতার মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত সমস্যা অথবা
পারিবারিক সংকট।
এর মধ্যে কৃষি উৎপাদনে মন্দাই
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী হলেও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না
পারাটাও বহু ক্ষেত্রে জীবন থেকে পালানোর মূল কারণ হয়ে থাকে। শুধু কৃষিঋণ নয়, গৃহ
নির্মাণ, কন্যার বিয়ে তথা অন্যান্য পারিবারিক কারণেও ঋণ নিতে বাধ্য হয় তারা। সবটা
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক থেকে মেলে না, পড়তে হয় মহাজনদের খপ্পরে। এ ছাড়াও আছে চিট
ফান্ডে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা। পারিবারিক অশান্তিও আত্মহুতির একটা বড় কারণ, যার
নেপথ্যেও দেখা যায় ঘাপটি মেরে থাকে আর্থিক অনিশ্চয়তা। আর ঘাতক অর্থ-ঋণের পরিমাণ অনেক সময়
দশ-বিশ হাজারের মতো নগণ্য, যা বিজয় মাল্যদের এক ঘণ্টার বিলাসের খোরাকও নয়।
অথচ মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকা এই
মানুষগুলোর জমি ছেড়ে বিদেশে পলায়নের সঙ্গতিও নেই, উপায়ও নেই। প্রতিকারহীন
প্রতিবাদের ভাষা একটাই– নিজেকে শেষ করে দেওয়া। দেশভাগের সময় যখন বাংলাদেশ থেকে
কাতার কাতারে মানুষ এদেশে পালিয়ে এসেছিল, তখনও দেখা গিয়েছে নিম্নবর্গের হিন্দুরা
বিশেষত কৃষিজীবী সম্প্রদায় যাদের চাষের জমি ছাড়া সম্বল নেই, চাষের কাজ ছাড়া আর
কোনও কাজও জানা নেই, জমি হারিয়ে ক্ষেত মজুরে পরিণত হয়েও তারা জমি আঁকড়ে থেকে যেতে
বাধ্য এবং দাঙ্গায় বধ্য হয়েছিল। সে না হয় ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ কামড়ে এক রক্তাক্ত
অস্থির পরিস্থিতি; কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক পরে এখনও স্বাধীন দেশের সরকারও
কেন ব্যর্থ থাকবে সমাজে যারা মূল উৎপাদক, সেই অন্নদাতা সম্প্রদায়কে ন্যূনতম
নিরাপত্তা দিতে? উন্নয়ন আর বিশ্বায়নের নাম করে যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার নয়ছয়
চলে, বিদেশী বিনিয়োগ টানতে যেখানে সব দলের মন্ত্রী অমাত্যরা জনগণের টাকায় বিদেশ
ভ্রমণ করে, সেখানে আমাদের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে অন্নদাতাদের চরম দারিদ্র্য, হতাশা,
অসহায়তা আর অভিমানে জীবন থেকে সরে যেতে হয়। আর এক এক জন বিজয় মাল্য হাজার হাজার শ্রমজীবী
প্রাণের মূল্যে পরম সুখে থাকেন ‘বড় বিচিত্র এই দেশ’-এ! পলাতক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে
তোলা পদক্ষেপ কতটা ফলপ্রসূ হবে বা আদৌ হবে কিনা জানা নেই, তবে অনন্যোপায় হয়ে চলে
যাওয়া প্রাণগুলো কখনই ফিরবে না।
রচিত: ১৬.৩.১৬
প্রকাশিত: সান্ধ্য আজকাল: মার্চ ২০১৬
সংযোজন: ২০১৯-এর
গোড়ায় ব্রিটেন বিজয় মাল্যকে ভারতে প্রত্যার্পণ করতে রাজি হয়েছে। সম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করে দেনা মেটানোর কথাও চলছে। ফলাফল সময় বলবে। তবে কৃষক আত্মহননের মিছিল
এখনও অব্যাহত।