অমানবের
মানবাধিকার
কাঁঠালের আমসত্ব কিংবা সোনার পাথরবাটি। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের ক্ষেত্রবিশেষে অতি সক্রিয়তা
‘অমানবের মানবতা’ এই আপাত বিরোধী পদজোড়াকে সর্বৈব সত্য করে তুলেছে। অপরাধীকে আত্মপক্ষ
সমর্থন বা নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করার সুযোগ আইনই দেয়। সে উকিল নিয়োগে অপারগ হলে
তার জন্য ওকালতি করা সরকার নিয়োজিত আইনজীবীর পেশাগত দায়িত্ব। সে
জন্য ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যের আশ্রয় নেওয়াও প্রথাসিদ্ধ এবং হয়কে নয় প্রমাণ করে যদি
মিথ্যের জয় হয়, তাহলে তা আইনসিদ্ধও হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মানবাধিকারের প্রশ্নে যখন
একদল মানুষ ঘৃণ্যতম অপরাধীর পক্ষ নেয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে বিপজ্জনক দ্বিপদটির
ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠে, তখন তা খুবই উদ্বেগের
বিষয়।
কামদুনির কলেজ ছাত্রীর গণধর্ষণ ও বেনজির নৃশংস খুনের শাস্তি ঘোষণায় নিগৃহীত ও
নিহতের পরিবার, আন্দোলনরত কামদুনিবাসী ও তাদের সমর্থনকারীদের আপাত জয়ের মধ্যে অশনি
সংকেত হল দুজন অভিযুক্ত নুর আলম ও রফিকুল ইসলাম গাজ়ীর বেকসুর খালাস (জামিনে
মুক্তি নয়)। এতে কামদুনির মেয়েরা যতটা খুশি হয়েছে, উদ্বিগ্ন রয়েছে ততোধিক।
প্রত্যাঘাতের আশঙ্কায় সেখানকার মেয়েদের স্কুলের পর পড়াশুনো স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, সাত
তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে – হয়তো বা চিরাচরিত বধূ নির্যাতনে মৃত্যু বা নিগ্রহের
সঙ্গে সহবাস ধর্ষণে মৃত্যুর চেয়ে কম অগৌরবের বলে। এমনকি ভিটেমাটি গোপনে বেচে
প্রতিবেশীদের আরও একা করে দিয়ে চলে যাচ্ছে অনেক পরিবার। কারণ কোনও শাসক বা বিরোধী
কোনও রাজনৈতিক দলই গ্রামের মেয়েরা বাড়ির বাইরে পড়াশুনো কি অন্য কাজে নির্বিঘ্নে
ঘোরাফেরা করতে পারবে, এই আশ্বাস দিতে পারেনি। বরং
কামদুনি হল এমন এক বিরল ক্ষেত্র, যেখানে ধর্ষক-খুনীদের পরিবার পরিজন দ্বারা তাদের
পক্ষে সালিশি মঞ্চ গড়ে তোলা, পুলিস প্রহরায় নির্বিঘ্নে নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর
হাতে স্মারকলিপি তুলে দেওয়া, বারাসাত আদালত থেকে মামলা সরানোর জন্য সোচ্চার হওয়া,
বিচারক সঞ্চিতা সরকারের বদলি রোখা, এমনকি রায়দান রুদ্ধদ্বার কক্ষে হবে না মুক্ত
কক্ষে তাই নিয়েও মতামত – সবেতেই অপরাধী পক্ষের বক্তব্য ও দাবি নির্যাতিত শোকগ্রস্ত
পরিবারের প্রতিক্রিয়ার চেয়ে অধিক ধ্বনিত।
নিহত ছাত্রীর পরিবারের বদলে বরং তাদের দুই প্রতিবেশিনীকে অনেক বেশি প্রতিবাদী
ও মরিয়া ভূমিকায় দেখা গেছে। আর বিস্ময়করভাবে আগাগোড়াই ধর্ষক পরিবারের প্রতি
জনপ্রতিনিধিদের সমবেদনা উল্লেখযোগ্য। দিনে দুপুরে মেয়েরা বাড়ি থেকে পুরুষ দেহরক্ষী
ছাড়া বেরোতে পারে না। অপরাধের এমন মুক্তাঞ্চলে রাস্তায় আলো নেই, স্থায়ী
পুলিস ক্যাম্প নেই – এমন সব বেয়াড়া অভিযোগ করে যারা, তারা যে মাওবাদী, আর
মাওবাদীদের গ্রামের মেয়ে ইচ্ছাকৃত বা অন্তর্ঘাতে বীভৎসভাবে মরে গিয়ে ভিন গোষ্ঠীর মরদদের
ফাঁসিয়ে দিচ্ছে, এটাই শাসক দল প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে গোড়া থেকে। অবশ্য জনমতের চাপে
মৃতের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। এই আবহে
এজলাসে দাঁড়িয়ে আনসার আলি মোল্লার ছাড়া পেয়ে কামদুনির সব মেয়েদের একই হাল করার
স্পর্ধিত শাসানি বেশ মানাসই; বরং টুম্পা কয়াল মৌসুমী কয়ালরা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার
মনের জোর পেয়েছেন কোথা থেকে, সেটাই বিস্ময় জাগায়।
শাসক দলের সত্যের অপলাপে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা স্বীকারে বা দলীয় কর্মীর অপরাধে জড়িত
থাকা অস্বীকারে কিছু স্বার্থ থাকতেই পারে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা পুলিস, সেনাবাহিনী ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলির অপকর্মের
বিরুদ্ধে যতটা সরব, সাধারণ দুষ্কৃতী বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুষ্কৃতীদের
জঘন্যতম অপরাধের প্রতি প্রায় ততটাই সহনশীল। অত্যাচারিত বা তার পরিবারের প্রতি
মৌখিক সমবেদনা ও তাদের সুরক্ষার জন্য প্রতীকী দাবি দাওয়ার বাইরে কোনও বাস্তব
সংগ্রাম করতে এঁদের বিশেষ দেখা যায় না। বরং “অপরাধ ঘৃণ্য, অপরাধী নয়” এই খ্রিস্টীয়
দর্শনে ভর করে অপরাধীকে যথাযোগ্য শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে বিস্ময়কর রকম সক্রিয়
হয়ে ওঠেন।
মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়ে পশ্চিমের বহু দেশে প্রাণদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। কিছু
সভ্যদেশে মৃত্যুদণ্ডকে যথাসম্ভব যন্ত্রণাবিহীন করা হয়েছে। কিন্তু যে খুনী তার সহ
নাগরিককে শুধু তার বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করল তাই নয়, মৃত্যুটিকে
বর্ণনাতীত ক্লেদ ও যন্ত্রণাদায়ক করে তুলল, ঘুমের ঘোরে একটি আরামদায়ক মৃত্যু কি তার
পক্ষে আদৌ কোনও শাস্তি? তেমন শাস্তি তো আদতে পুরস্কার।
সকলের জন্য সমান মানবাধিকারের দৌলতে ২০১৬-র বর্ষবরণের রাতে জার্মানি জুড়ে দেড়
হাজারের ওপর যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটে যায়। সে দেশে বিংশ শতাব্দীতেও
ক্যানিবালিজ়ম বেআইনি ছিল না যদি শিকার স্বেচ্ছায় দেহ ও প্রাণ দান করে। একটা কথা
মাথায় রাখতে হবে, ইহুদি দমনের নামে জার্মানি যে ভয়াবহতা ও পৈশাচিকতার নিদর্শন
রেখেছে, তা শুধু অমার্জনীয় নয় রীতিমতো প্রতিশোধনীয়। তবু জার্মানরা বেঁচে আছে প্রথম
বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিক হয়ে। এত অপরাধের উত্তরাধিকারী বলেই হয়তো অপরাধীর প্রতি
কঠোর হওয়ার নৈতিক অধিকার বোধ করেনি জার্মানি, অথবা বীভৎসতার পুনরাবৃত্তি চায়নি
রাষ্ট্র কোনও অবস্থাতেই। কিন্তু কোলন সহ অন্যান্য শহরের যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঐ
দেশটিকেও নতুন করে ভাবাচ্ছে।
অথচ পশ্চিমী মানবাধিকারের দীক্ষা, যিশু খ্রিস্টের বাণী নাকি গান্ধীবাদ বলা
মুশকিল, নিজেদের activist ভাবতে ও প্রতিপন্ন করতে ভালোবাসে, এমন কিছু মানুষকে এমন
এক বিচিত্র মূল্যবোধে আবিষ্ট করছে, যার সঙ্গে ব্যক্তি বা সমাজ কোনওটারই মঙ্গলের
যোগ নেই। এই বিমূর্ত মানবাধিকারের উচ্চারণে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ শহুরে শিক্ষিত সচ্ছল
এক শ্রেণীর মানুষ যাদের জীবন ধারণে অনিশ্চয়তা কম। এরা রাষ্ট্র নামক বিমূর্ত শত্রুর
সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ করে কল্পিত বিপন্নতার তাপে বুদ্ধিবৃত্তি জারিত রাখে।
“মুক্তধারা”র মতো চলচ্চিত্র তথা নাটক সমাজের পক্ষে যতটা অনুপ্রেরণার তার চেয়ে
ঢের বেশি উদ্বেগের। নৃশংস অপরাধীরা যদি অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করার বদলে নাচ
গান শিখে শিল্পীর সম্মান পেয়ে সমাজের মূল স্রোতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়,
তাহলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা যে পরোক্ষে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যায়, তা শৌখিন
মানবাধীকারবাদীরা মানতে চায় না, আর আমারাও অনেক ক্ষেত্রে পিশাচের মানুষে বিবর্তন
দেখে আপ্লুত হই। তাই কামদুনির ধর্ষকদের সহায়করা দর্শকদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে
ফুটবল খেলে, নির্ভয়ার দেহে লৌহ দণ্ড ঢুকিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া ’নাবালক’ দুবছর
সংশোধনাগারে কাটিয়ে ‘সংশোধিত’ হয়ে সেলাইকল ও নগদ দশ হাজার টাকা এবং জনরোষ থেকে নিশ্ছিদ্র
সুরক্ষা উপহার পায়। আর সবচেয়ে বড় কথা দিল্লী, কামদুনির পরও দেশজুড়ে হরিয়ানার
রোহিতক, পশ্চিমবঙ্গের লাভপুর, বারাসাত, মধ্যমগ্রাম, ধূপগুড়ি, কাকদ্বীপ ... আরও আরও
অসংখ্য ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। তাও ভালো, আনসার আলি মোল্লা, সইফুল আলি, আমিন
আলি, ইমানুল ইসলাম, আমিনুর ইসলামদের মাঝে সম্ভবত ভোলা নস্করের আপাত হিন্দু নামটা
কামদুনি কাণ্ডকে সাম্প্রদায়িক রূপ পেতে দেয়নি। এর জেরে সহিংস প্রতিবাদ যা স্বাভাবিকভাবেই
দাঙ্গার রূপ পেতে পারত, তেমন কিছু হলে পুনরায় মেয়েরাই আক্রোশের শিকার হত। একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার সমীকরণ খণ্ডাতে
রাজ্য সরকার থেকে মানবাধিকারকর্মীদের সক্রিয়তায় হয়তো দাঙ্গার মেঘ কেটে গেছে,
কিন্তু তার মধ্যে কোনও সম্প্রদায়-নির্ভর রাজনৈতিক অভিমুখ নেই – এটা বিশ্বাস করা
কঠিন।
এরই মধ্যে ফেসবুকে একটি পোস্টের উল্লেখ না করে পারছি না। জনৈক বাঙালী পুংগব
ফেমিনিস্টদের আক্রমণ করে লিখেছেন, “ধর্ষণ মেয়েদের ক্ষতি করে না, কিন্তু ধর্ষণের
মিথ্যে অভিযোগ একজন পুরুষের জীবন তছনছ করে দেয়।” এই মহাপুরুষটিও সম্ভবত মানবাধীকারবাদী যিনি নৃশংস
অত্যাচার ও প্রাণহানিকে ক্ষতি মনে করেন না, করেন জীবিতের মানহানিকে। হয়তো মানবাধিকার আসলে মানবের অধিকার সুরক্ষিত করার
জন্য, ‘মানবী’র অধিকার নয়। ‘মানব’ শব্দটির আওতায় মানবীদের আনতে চাইলেই
‘নারীবাদী’ বলে চিহ্নিত হতে হয়, যেখানে ‘নারীবাদী’ শব্দটা অধিকাংশ পুরুষ বিদ্রূপ
বা গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
রচিত: ০৮.০৪.১৭
প্রকাশিত: সান্ধ্য আজকাল: এপ্রিল
২০১৭