প্রশাসনের
ছদ্মবেশ
নিঠারি-নির্ভয়া-কানহাইয়া
প্রশাসনের ক্ষেত্রবিশেষে পর্যায়ক্রমে নিষ্ক্রিয় ও অতিসক্রিয়তা নতুন কিছু নয়। গত
মাসাধিক কাল ধরে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র কানহাইয়া কুমার
দেশদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার হয়ে মিডিয়ার সৌজন্যে একই সাথে জাতীয়
নায়ক ও ‘বাক্-স্বাধীনতা’ বিষয়ক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সংসদ
হামলা-কাণ্ডের গুরুমশাই আফজল গুরু ও মকবুল ভাটের মৃত্যুদণ্ডকে ‘বিচার বিভাগীয়
হত্যা’ বলে দাবি করা এবং কাশ্মীরি উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে জঙ্গি
কার্য-কলাপকে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবে সমর্থন করাটা বাকস্বাধীনতার সাথর্কতা, নাকি
তাদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়াটা যথোপযুক্ত – তাই নিয়ে দেশ জুড়ে তর্ক বিতর্ক,
রাজনীতি, সমাজ সচেতনতা, মায় কবিতা, গান, সেলিব্রিটি সংলাপ – সব মিলিয়ে এক জমজমাট
বাতাবরণ। অভিযুক্ত ছাত্র কানহাইয়া কুমার ও তার ইউনিয়নের সেই দেশ বিরোধী মঞ্চের
ভূমিকা ঠিক কী ছিল, ভিডিও-তে যে ভারত-বিরোধী স্লোগান পাওয়া গেছে তা আসল না ফোটোশপের
কারসাজি – তাই নিয়ে অবশ্য তদন্তের অবকাশ রয়েছে।
কিন্তু যেভাবে কানহাইয়াকে তড়িঘড়ি তিন দিনের পুলিসি হেফাজতের নির্দেশ দিয়ে
ভেতরে চালান করা হল, তাতে শুধু বিরোধী রাজনীতিকরা তূণীরে অস্ত্র পেয়ে যায়নি,
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে জেএনউই-এর শিক্ষকদের মধ্যে এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও।
এর মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লোগান তো ‘বাক-স্বাধীনতা’র পরাকাষ্ঠা দেখাতে
স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বকে এক চোট নিয়ে ফেলেছে এবং লাগাতার টেক্কা দেওয়ার
প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিছু উগ্র ও হটকারী বিজেপি সমর্থক
এমনকি জনা কয়েক আইনজীবীর অসংযমী ও সংবিধান-বিরোধী আচরণ প্রকৃত দেশদ্রোহীদের ধরার
বদলে ধৃত কাউকে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে গায়ের ঝাল মিটিয়ে নেওয়ার মতো।
যে পদক্ষেপে অধিকাংশ দেশবাসীর সমর্থন থাকার কথা ছিল, তা এখন সংবাদ মাধ্যম থেকে
সমাজসেবক তথা ছাত্রসমাজ হয়ে রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরের মৃগয়ার প্রশস্ত লক্ষ্য হয়ে
উঠেছে। শুধু তাই নয়, বিজেপি সমর্থিত আইনজীবীরাও আদালত চত্বরে পুলিসের সামনে
কানহাইয়াকে বেদম পিটিয়ে এতটা জখম করে দেয়, যে শেষ মুহূর্তে একটা ঘরে ঢুকিয়ে তার
প্রাণরক্ষা করতে হয়। যেখানে কানহাইয়া বারবার বলেছেন, তিনি কোনও দেশ-বিরোধী
স্লোগান বা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি (কোনটা দেশবিরোধী কোনটা নয় সেটা অন্য
প্রশ্ন) এবং দেশের সংবিধানের প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা আছে, সেখানে আইনের রক্ষকরা
শুধুমাত্র রাজনৈতিক আবেগোন্মাদনায় একজন অপরাধ প্রমাণ না হওয়া বন্দীর ওপর চড়াও হয়ে
আইন ভাঙলেন।
মনে পড়ে যায় ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ কড়া সরকারি নিরাপত্তায় নির্ভয়া
ধষর্ণ-হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতম অপরাধীকে জনরোষ থেকে বাঁচাতে পরিবারের নিরাপদ হেফাজতে সরানোর
কথা। ছাড়া পেয়েই একটি শিশুকন্যাসহ ফের দুটি খুন করেছে বলে যে খবর, তার সত্যাসত্য
ফলোআপ অবশ্য জানা নেই, কিন্তু জেলে তার সঙ্গে
জঙ্গিদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার কথা তো প্রশাসন জানত। তবু সেই ঘৃণ্য বিভীষিকাময়
অপরাধীকে সঙ্গত জনরোষ থেকে বাঁচাতেও যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আয়োজন ছিল, তা
কানহাইয়ার মতো একজন বিচারাধীন কয়েদির ক্ষেত্রে ছিল না কেন? কালো শামলা-আঁটারা যখন
ছাত্রনেতাকে প্রহার করে ভূলুণ্ঠিত করল, তখন হেপাজতি পুলিসরা কি একটুও প্রতিরোধ
করতে পারত না? নাকি নির্ভয়ার হত্যাকারীর চেয়ে ছাত্রনেতাকে সরকারপক্ষের বেশি
বিপজ্জনক মনে হয়েছে বলে সরকারি নিরাপত্তার রকমফের হল? সাধারণত রাজনৈতিক অপরাধীরাই
বিশেষ নিরাপত্তা ভোগ করে থাকে। কিন্তু দেশভক্তির উত্তেজনায় রাজনৈতিক কৌশলটাই
গুলিয়ে গিয়েছিল।
মনে পড়ছে, ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আবিষ্কৃত নিঠারি ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড। মণীন্দর
সিং পান্ধার নামে জনৈক শিল্পপতির সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় তার ভৃত্য সুরেন্দ্র কোলি বেশ
কিছু নারী ও বাচ্চাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে খেয়ে ফেলে। বিকৃতকামী
মণীন্দরও নারী নিগ্রহে সক্রিয় হওয়া সত্ত্বেও টাকার জোরে ২০১৪ সালে নিস্তার পেয়ে শেষ
পর্যন্ত একা সুরেন্দ্রর ঘাড়ে দোষ চাপানোর আয়োজন হচ্ছিল। তখনও কানপুর হাইকোর্টের
আইনজীবীরা কিন্তু আদালত চত্ত্বরে মণীন্দরকে জুতো নিয়ে আক্রমণ করেছিল। তাদের সেই
স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক উষ্মাকেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত ভর্ৎসনা করে ও মণীন্দর সিং-এর
মতো ঠান্ডা মাথার নরপিশাচও (ক্যানিবাল প্রমাণিত না হলেও) জামিন পেয়ে যায়। কারণ সেই
অর্থ-ক্ষমতা-রাজনীতির ত্রিঘাত সমীকরণ! মণীন্দর ডাকসাইটে শিল্পপতি হিসাবে স্থানীয় ও
দিল্লীর পুলিস মহলে রীতিমতো প্রভাব খাটিয়ে জনৈক মহিলা অফিসারকেও নিজের কাজে লাগাতে
পারে, যেখানে সুরেন্দ্রদের আর্থিক বা সাম্প্রদায়িক কোনও রক্ষাকবচই নেই।
উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ করলে আমাদের বিমূঢ়তা আরও বেড়েই চলবে যার ব্যাখ্যা
ঔপনিবেশ শাসনমুক্ত এই খেয়োখেয়ির রাজনীতি ও তার
ব্রিটিশ উত্তরাধিকারে পাওয়া ছদ্মবেশী পুলিস-প্রশাসন ব্যবস্থা দিতে পারবে
না।
রচিত: ৬.৩.১৬
প্রকাশিত: সান্ধ্য আজকাল:
মার্চ ২০১৬
সংযোজন: ২৪ জুলাই ২০১৭ গাজ়িয়াবাদের বিশেষ
সিবিআই আদালত মনীন্দর ও সুরেন্দ্র দুজনকেই ফাঁসির নির্দেশ দেয়।