বাজেট রাজ ও নীতি
আমাদের দেশে বাজেটোত্তর আলোচনার মোটামুটি একটা সাধারণ গত আছে। যদি বাজেট
রাজকোষ পোক্ত করতে মূল্যবৃদ্ধি, কর লাগু, ভর্তুকি লোপ এইসবে প্রাধান্য দেয়, তাহলে
সেটি জনবিরোধী; আর যদি আপামরকে খুশি করতে কর ছাড়, শুক্ল হ্রাস, ঋণ মকুব ইত্যাদি ঘোষণা
করে, তাহলে তা সংস্কার বিরোধী জনমোহিনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বলা বাহুল্য
কোনও বাজেটের পক্ষেই সব শ্রেণীর ও সব পেশার মানুষকে খুশি করা সম্ভব নয়। কিন্তু
এবারে ২০১৬-র জাতীয় বাজেট এক প্রকার বেপরোয়া ও দুঃসাহসী।
নরেন্দ্র মোদী সরকার যে উন্নয়নের স্বার্থে অর্থবান শিল্পপতি মহলের প্রতি
অতিরিক্ত উদার ও গরিব মানুষের প্রতি উদাসীন, এই অভিযোগ তথা মূল্যায়ন নতুন কিছু নয়।
কিন্তু এবারের বাজেটে পেনশন স্কিমের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে প্রভিডেন্ড
ফান্ডের ওপর যে কোপটি পড়েছে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত এনডিএ জমানায় ১ জানুয়ারি ২০০৪-এর পর সরকারি চাকরিতে যোগদানকারীদের জন্য গতানুগতিক পেনশন
ও প্রভিডেন্ড ফান্ড তুলে চালু হয় বাজার নির্ভর ‘নিউ পেনশন স্কিম’ (NPS), যাতে কর্মীর খাতে সে ও সরকার যৌথভাবে মাইনের ১০%
করে জমা দেবে। শুধু সশস্ত্র সেনা বল (Armed Force) পুরনো নিয়মে পেনশনের অধিকারী থাকে। অর্থাৎ বাকি সরকারি কর্মীদের নির্দিষ্ট পেনশন থেকে
সুনিশ্চিত আমদানি বন্ধ করে অবসরকালীন উপার্জনে বাজারি উদ্বায়ুতা (voltality) জুড়ে
দেওয়া হয়েছিল। পরে মনমোহন সিং-এর রাজত্বে মে ২০০৯-এ National Pension System (NPS)-এর আওতায় নিউ পেনশন স্কিমকে ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাবে
সবার জন্য সম্প্রসারিত করা হয়। এরপর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ২০১৪-১৫-র বাজেটে ‘বেশি
ঝুঁকি বেশি লাভ’ এই আপ্তবাক্যে আমানতকারীদের উৎসাহী করতে জীবন বীমা কর্পোরেশনের (LIC) অধীনে আনা হয় ইউনিট লিংক্ড্ ‘পেনশন সুরক্ষা’। কিন্তু সরকারি বা আধাসরকারি বেতনভোগী মানুষ যাঁরা
জীবিকার স্থায়ীত্ব ও নিরাপত্তায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তাঁরা অনর্থক বাজার নির্ভর
ঝুঁকির দিকে না গিয়ে সুনিশ্চিত সঞ্চয়ের জন্য প্রভিডেন্ড ফান্ড বা ‘ভবিষ্যনিধি’র ওপর বেশি আস্থা
দেখিয়েছেন। সংস্কারে একবগ্গা মোদীজীর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবার তাই ভবিষ্যনিধির
ভবিষ্যৎটাই অপ্রত্যাশিত করের ছায়া ফেলে অন্ধকার করে দিয়েছেন। ইপিএফ-এ সুদেমূলে জমা
টাকার মাত্র ৪০ শতাংশ করমুক্ত আর ৬০ শতাংশ করভুক্ত! অর্থাৎ তিলতিল জমানো সারা
জীবনের সঞ্চয়ে সরকার বড়সড় থাবা বসাতে চলেছে। জিপিএফ যেহেতু সরকারি কর্মীর একান্ত
নিজস্ব সঞ্চয়, তাকে করের আওতায় আনা হয়নি কখনোই। তবে প্রবল বিরোধিতার
জেরে ও জনমতের চাপে পিছু হটেছে সরকার। ফলে এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা
তোলাকেও সুদহীন করতে হয়েছে। তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন মোট
তহবিলের ৬০% নয়, কর প্রদেয় শুধু আমানতের ওপর পাওয়া সুদটুকুর জন্য। অন্যদিকে পেনশন ফান্ড থেকে চলতি খাতা বন্ধ করে পুরো
টাকা তুলে নিলে আগে যেখানে পুরোটার ওপরই কর লাগু ছিল, এখন সেখানে তার ৪০%-এর ওপর
কর দিতে হবে।
নতুন পেনশন স্কিমকে আকর্ষণীয় করতে আর একটি পদক্ষেপ হল, পিএফ-এর টাকা তুলে
পেনশন ফান্ডে রাখলে কর ছাড়। গতবারে মূল্যবৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে আয়কর ছাড়ের
ক্ষেত্রে কোনও নতুন স্ল্যাব না তৈরি হওয়ায় এবার চাকরিজীবীদের প্রত্যাশা ছিল তেমন
কিছু প্রাপ্তির। বস্তুত সচরাচর সরকারপক্ষ পে কমিশন বসানো থেকে আয়কর নীতি – সব দিক
দিয়ে মধ্যবিত্ত সরকারি বেতনভোগীদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে থাকে। জনমত স্বপক্ষে
রাখার এটাও একটা পরিচিত কৌশল। সেদিক দিয়ে এবারের বাজেট অনেকটা ব্যতিক্রম।
অর্থনীতি বিশারদরা এতে করে অবশ্য গ্রাম-গরিবদের অমঙ্গল দেখছেন না। উচ্চ ও
মধ্যবিত্তের জন্য বিভিন্ন পরিষেবায় .৫% কৃষি সেস বসিয়ে কর বাড়ল, যা নাকি গ্রামীণ
অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষক হবে। আবার পারমিট-রাজ তুলে ওলা উবের-এর মতো পরিবহন সংস্থার
জন্য দরজা খুলে দেওয়া কতটা দুর্নীতি রুখতে আর কতটা অত্যধিক কর্পোরেটাইজ়েশনের
বাজারি তাগিদে, সেটাও এখনই বোঝা যাচ্ছে না। আবার আধার নম্বর ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে
ভর্তুকির সমীকরণ সহজ করতে নতুন আইন ঘোষিত হলে তার ফল কতটা ইতিবাচক হয়, দেখার জন্যও
আপাতত অপেক্ষা করতে হবে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে এই প্রধানমন্ত্রীই গত বছর যখন বিনিয়োগের সঙ্গে
কর্মসংস্থানের বিষয়টা জুড়ে দিয়েছিলেন অথবা রপ্তানিকে আমদানির শর্ত হিসাবে তুলে
ধরেছিলেন, তখনও কিছু সংবাদপত্র ও বিশেষজ্ঞমহল সেটা জনমোহনের রাজনৈতিক স্বার্থে
পশ্চাদপসরণ বলে ব্যাখ্যা করেছিল। পশ্চিম বিশ্বের চাহিদা আর্থিক উদারীকরণের
নামে কমজোরি দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চায় সাংস্কৃতিক ও অবশ্যই অর্থনৈতিক
সাম্রাজ্যবিস্তার। বাম শিবিরের বিপক্ষে থেকে এবং কটূক্তি ব্যঙ্গবিদ্রূপসহ কঠোর
সমালোচনার লক্ষ্য হয়েও নেহেরু-ইন্দিরারা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ,
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, লাইসেন্স আমদানি-রপ্তানির ওপর অনুদার নীতি নির্ধারণের
পাশাপাশি দেশবাসীর প্রতি বিশেষত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনতার প্রতি রাষ্ট্রের
দায়দায়িত্ব পালনের ভূমিকাটাও বড় করে দেখেছিলেন। কালক্রমে এই ‘স্বদেশী’ সংস্কার
অনুদারতার পরিচয়, আর ‘বিদেশী তোষণ’ সংস্কার ও উদারতার মাপকাঠি হয়ে যায়। বলা
বাহুল্য ‘সংস্কার’ শব্দটার অর্থ দু ক্ষেত্রে দু রকম। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ,
বেসরকারিকরণ, ভর্তুকি অপনয়নের মতো উদারপন্থী পদক্ষেপগুলোয় মুষ্টিমেয়
বাণিজ্য-ব্যক্তিত্ব ও সুবিধাভোগী উচ্চবিত্তরা ছাড়া দেশের অধিকাংশ জনগণ বিশেষত
জীবিকা অনিশ্চয়তায় ভোগা বিশাল জনগোষ্ঠী খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না; যদিও
নৈতিক শিথিলতায় পুলক কার না জাগে? স্বভাবতই কম্পিউটার বা নতুন প্রযুক্তি বরণ থেকে
শিল্পায়ন সর্বত্রই যে প্রশ্নটি আপামরের মাথায় প্রথমেই আসে, তা হল কর্মসংস্থান
বাড়বে না কমবে? তাই উদারীকরণের সরব ঘোষণা দ্বারা বণিক ও ধনিক মহলের মন জয়ের পর পড়ে
থাকা চোদ্দ আনার কথা ভেবে অর্থনৈতিক সংস্কারের রথে রাশ টেনে ধরতেই হয়।
নিজের দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থরক্ষা করতে চাওয়াটা অনুদারতা, আর বৈদেশিক চাপে
নতজানু হওয়াটাই কি সুসংস্কার? এত উদারীকরণ, দেশবাসীর প্রতি নির্মম দায়িত্বহীন
উদাসীনতা যে পাখির চোখ লক্ষ্য করে, রাষ্ট্রসংঘের সেই বহুকাঙ্খিত ভেটো ক্ষমতাসহ
স্থায়ী সদস্য পদ তো অধরাই থেকে গেল। সদস্য সংখ্যার মাঝারি বিস্তারের ফলে স্থায়ী
সদস্য তালিকায় ভারতের স্থান হলেও ভেটো পাওয়ার প্রশ্নে আমাদের সুহৃদ প্রতিবেশী চিনের
বিরোধিতায় সুর মিলিয়ে আমেরিকাও এক বছরের মধ্যে প্রতিশ্রুতি ভুলে নিজের অবস্থান
বদলে ফেলেছে। তাহলে? এই অবস্থায় নিজেদের একটা ন্যূনতম নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষার
দাবি কি খুব অসমীচীন? বাজেট দ্বারা বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক, আভ্যন্তরীণ
রাজনৈতিক ও নাগরিকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার ভারসাম্য রক্ষা করা সত্যিই দুরূহ একটা
চ্যালেঞ্জ।
রচিত: ৩.৩.১৬;
প্রকাশিত: সান্ধ্য আজকাল:
মার্চ ২০১৬