মনুস্মৃতি থেকে সমকামিতার সাফাই?

 

মনুস্মৃতি থেকে সমকামিতার সাফাই?

 

মনুষ্য শব্দটার উৎপত্তি মনু থেকে। স্বয়ং ব্রহ্মাই মনু। আর মনুর সন্তানই হল মনুষ্য। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ অনুযায়ী স্বয়ং স্রষ্টা ব্রহ্মা উবাচ হল মনুস্মৃতি বা সংহিতা, যার আর এক নাম ‘মানবধর্ম শাস্ত্র’ব্রহ্মার বাণী বলে এটি অভ্রান্ত ও তর্কাতীত। পণ্ডিত হৃদয় নাথ পাটওয়ারির অনুবাদকে অবলম্বন করে এই ব্রাহ্মণ্য মানবতাবাদে মানবীর অবস্থান ঠিক কোথায়?

১২ টি অধ্যায়ে বিভক্ত মোট ২৬৯০ টি সূক্তর সংকলন এই সংহিতা। বলা বাহুল্য ‘মনু’ নাম নিয়ে কোনও মানবের রচনাটাই শাস্ত্র হিসাবে হিন্দুধর্ম ও কর্তব্যকর্ম হিসাবে প্রচলিত। ঐতিহাসিক অনুসন্ধান জানাচ্ছে ‘মনু’ নামধারী বাস্তব পুংগবটির জন্ম উত্তর ভারতে কোনও ব্রাহ্মণ পরিবারে। মূল মনুস্মৃতিতে যদিও “যত্র নারয়াস্তু পূজ্যতে, রমন্তে তত্র দেবতা” [৩/৫৬] অর্থাৎ নারী যেখানে পূজিত সেখানে দেবতার আবাস – এমন শ্লোক আছে, কিন্তু বাস্তবে পুরুষতন্ত্রের ও নারী অবমাননার সবচেয়ে জোরদার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল মনুস্মৃতি বা সংহিতা নামে প্রচলিত প্রক্ষিপ্ত গ্রন্থটি‘শাস্ত্রে বলেছে’ বলে যা কিছু অনুশাসন হিন্দু মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই মনু সংহিতার দোহাই দিয়ে।

২/২১৩ শ্লোকে নারীর স্বভাব বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে “নারীর প্রকৃতি হল পুরুষকে প্রলুব্ধ করা, তাই জ্ঞানীরা নারী সংসর্গে নিরাপদ নয় খ্রিস্টীয় বা ইসলামিক আদম ইভের কল্পকাহিনীর চেয়ে এ আর আলাদা কীসে? ঐ গল্প যদি মানতেও হয়, তাহলেও প্রশ্ন, ইভ না হয় আদমকে পাপে প্ররোচিত করেছিল, কিন্তু তাকে প্ররোচিত করেছিল কে? শয়তান, যার আর এক নাম পুরুষ বললে অত্যুক্তি হয় না। আবার মজা দেখুন পুরুষ মানুষের অনৈতিক প্রবৃত্তির জন্যও তাকে নয়, নারীকেই দায়ী করা হয়েছে ২/২১৫ নং শ্লোকে – “জ্ঞানী ব্যক্তির (পুরুষের) নিজের মা, ভগ্নী এমনকি কন্যার পাশেও বসা উচিৎ নয়, কারণ তাতে অজাচারের ইচ্ছা জন্মাতে পারে” ইসলামের হাদিশ-এর সঙ্গে এর একটা চরিত্রগত সাদৃশ্য আছে। যিশু খ্রিস্টের প্রেমময় রূপ আর করুণ জীবন কাহিনী যতই হৃদয় ছুঁয়ে যাক নারী অবমাননায় বাইবেলও কম যায় নাআর ইহুদিদের ডিউটেরোনমি তো বাইবেল আর কোরানের বাপ তবে এই তিনটি আব্রাহামীয় ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলা চলে না। কিন্তু হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য হল, মনুস্মৃতি বা স্বয়ং ব্রহ্মার বচন বলে প্রচারিত শাস্ত্রকেও প্রশ্ন তোলার মতো একাধিক নিরীশ্বরবাদী দর্শনও আছে, যেগুলো হিন্দু শাস্ত্র হিসাবে রীতিমতো সমাদৃত এবং সেগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস ব্যক্ত করলেও আস্তিক্য অর্থাৎ বেদ অনুমত দর্শন হিসাবে স্বীকৃতবৌদ্ধ ও জৈন বেদ বিরোধী নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক্য দর্শন হলেও তাদের ভিত্তি বেদেই নিহিত, এবং ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের পরিসরে তারা সমান প্রাসঙ্গিক।

যাই হোক, যে গ্রন্থটি পুরুষতন্ত্রের স্তম্ভ বলে সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও সমালোচিত, LGBT বা সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের যৌনাচারের সপক্ষে সেখান থেকেও যুক্তি আহরণ করার চেষ্টা করা হয়। মনুস্মৃতি এমন একটি শাস্ত্র যেখানে প্রাণীর জন্মে স্ত্রী ও পুরুষের ভূমিকা কী, সেই ধারণাটাই ভ্রান্ত। তৃতীয় প্রকৃতির সন্তান জন্মানোর পিছনেও দর্শানো হয়েছে কিছু কিম্ভূত মন গড়া কারণ। ভ্রূণ গঠনের সময় পুরুষের বীর্য অধিক পরিমাণে থাকলে পুত্র, নারী উপাদান বেশি কাজ করলে কন্যা আর স্ত্রী-পুরুষের উপাদান সমান সমান হলে হয় যমজ পুত্র-কন্যা নয় নপুংসক বা তৃতীয় প্রকৃতির সন্তান জন্মায়। ডিম্বাণু ও শক্রাণুর ধারণা মনুর ঠিকমতো ছিলই না। বীর্য তাঁর কাছে পুং বীজ, মায়ের গর্ভ কেবল জমি। আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর মতোই ডিম্বাণুর ভূমিকা বা বংশগতিতে মায়ের অবদানের কথা স্বীকারই করা হয়নি মনু সংহিতায়।

কিন্তু যতই পুরুষবাদী হোক মনুস্মৃতি, রক্ষণশীলতার কারণেই সমকামী বিকৃতিগুলোকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতিও দেয়নি, যদিও শাস্তি দানে ও তার কঠোরতায় নারী পুরুষে তারতম্য যথেষ্ট বয়স্ক মহিলার সঙ্গে অল্প বয়সী কুমারী মেয়ের যৌন সংসর্গ হলে বয়স্ক রমণীটির জন্য রয়েছে কড়া দাওয়াই। মাথা মুড়িয়ে গাধার পিঠে চড়িয়েও যথেষ্ট মনে না হলে দুটো আঙুল কেটে দাও। দুজন কুমারী মেয়ের মধ্যে তেমন সম্পর্ক হলে তুলনায় হাল্কা শাস্তি। দুই শত পান্না জরিমানা, সেটা দ্বিগুণও করা যেতে পারে, আর দশ ঘা লাঠি। সমকামটা বড় কথা নয়, কুমারীর কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে বিবাহ অযোগ্যা হয়ে যাচ্ছে, সেটাই আসল অপরাধকোনও পুরুষ কুমারী কন্যা বা পরস্ত্রীকে বল প্রয়োগে ভোগ করলে তারও দুটো আঙুল কেটে নেওয়ার ও ৬০০ পান্না জরিমানার বিধান আছে, যদিও যৌনতার দাবিতে নিজের স্ত্রীর ওপর যথেচ্ছ বল প্রয়োগে ও প্রহারে কোনও দোষ নেই। তবে স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক সংসর্গ ছাড়া অন্য কোনও বিকৃতির অনুমোদন নেই, যদিও তার অন্যথায় শাস্তির বিধান পরিষ্কার নয়, কারণ স্বামীর অনুগত হওয়া স্ত্রীর পক্ষে বাধ্যতামূলক।

অন্য দিকে দুজন পুরুষের মধ্যে সমকামী সঙ্গম হলে শাস্তি বলতে কেবল একবস্ত্রে স্নান ও পঞ্চ গোব্য গ্রহণ দ্বারা দেহশুদ্ধি, এক রাত্রি উপবাস ব্যাস! পূর্বে ব্রাহ্মণরা এমন কাজ করলে জাতিচ্যুত হত, মনুর (মনু নামধারী মানুষটির) বিধানে ঐটুকু প্রায়শ্চিত্ত করলেই আর দ্বিজত্ব খোয়া যাবে না। যেখানে পুরুষদের সমকামিতা অনেক বেশি ন্যাক্কারজনক এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক অসুস্থতার হেতু, তবু সেটা মেয়েদের সমকামিতার মতো অত বড় অপরাধ নয়। মনুর বিধানে ব্রাহ্মণের পক্ষে সমকামী সংসর্গ, ষাঁড়ে টানা গাড়িতে, জলে বা দিনের বেলা নারী সম্ভোগ অনুচিৎ; কিন্তু সবস্ত্র স্নান করে নিলেই তার প্রতিবিধান হয়ে যায়। অব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে নারী বলাৎকারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অব্রাহ্মণ পুরুষদের জন্য সমকামিতার কী শাস্তি পরিষ্কার নয়মনুর কাছে মদ্যপান অধিকতর অপরাধ, যার জন্য তপ্ত গোমূত্র পান করে যেতে হবে। হস্তমৈথুন আর সমকামিতা এই স্মৃতিশাস্ত্রের বিচারে প্রায় সমতুল্য এবং তুলনায় লঘু অপরাধ।

মনুস্মৃতি থেকে এই বিধান উল্লেখ করে পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্রে একটি রচনায় সমকামিতার পক্ষে জোর সওয়াল করেন এ যুগের এক লেখক। আদি শাস্ত্রে যাই থাক, প্রচলিত সংস্করণের মনুস্মৃতি যে নারীর প্রতি বিদ্বেষপ্রবণ ও পুরুষের অপরাধের প্রতিও প্রশ্রয়ী, ব্রাহ্মণদের প্রতি উদার ও শূদ্রদের প্রতি কঠোর, সে কথা তো প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনজ্ঞাত সত্যপরিতাপ ও উদ্বেগের বিষয় আজকের সমকামিতার দাবির সমর্থকরা সেই গ্রন্থটিকেও শালিশি মানছে, যাকে অবৈজ্ঞানিক এবং বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্যবাদী বলে নিজেরই দিবারাত্রি গালাগাল করে। প্রসঙ্গত সমকাম ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও মৃত্যুর পর স্বর্গে যেতে পারলে সুন্দরী হুরেদের পাশাপাশি সুন্দর বালকদের সঙ্গে যথেচ্ছ সমকামী সঙ্গমের প্রলোভন সেখানেও রয়েছে। এভাবেই কোথাও না কোথাও এসে বোধহয় পুরুষের স্বার্থে সর্বধর্ম সমন্বীত হয়ে যায়।

 

রচিত: ৪.২.১৬;

প্রকাশিত: এক্সপ্রেস খবর: ১০ এপ্রিল ২০১৬

Post a Comment

Previous Post Next Post