হিন্দুত্ব ও সহিষ্ণুতা
প্রসঙ্গ স্বামী বিবেকানন্দ
"I am proud to belong to a religion which has
taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only
in universal tolerance but we accept all religions as true." ভারি কিম্ভূত লাগছে না কথাগুলো
গোহত্যার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ হত্যা আর এই বিশ্বজোড়া অশান্তি ও অসহিষ্ণুতার
বাতাবরণে? কিন্তু কিম্ভূত কথাগুলো যে অদ্ভূত নয়, “যত মত তত পথ”ই যে সনাতন ধর্মের
অন্তর্নিহিত দর্শন, ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর এক তরুণ হিন্দু সন্ন্যাসী
বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পেরেছিলেন। ঠিক বিশ্ববাসী না হলেও শিকাগোর ধর্ম মহাসভায় (World's Parliament of Religions) সেদিন উপস্থিত প্রায় সাত হাজার
উন্নাসিক শিক্ষিত মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু নিজের দেশে তাঁর
ধর্মমহাসভায় বিশ্বজয়ের খবর ও উন্মাদনা যতটা ছড়িয়েছিল, তাঁর বক্তব্যের নির্যাস ও
বার্তাটা বোধহয় সেভাবে ছড়াতে পারেনি।
আসলে ব্যাখ্যা বা উপস্থাপনাই যে কোনও মতবাদের প্রকৃত নিয়ন্তা হয়ে ওঠে। কোনও
ধর্মমত শান্তি-মৈত্রী-সাম্যের বার্তা হবে না অশান্তির প্ররোচনা, তা বলতে গেলে
পুরোটাই নির্ভর করে, তাকে কী ভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপিত করা হচ্ছে তার ওপর। না
হলে বিষ্ণুরই এক অবতার মসজিদ ভাঙার প্রেরণা আর এক অবতার প্রেমের দূত হয়ে উঠত না,
যদিও দুজনেই ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ ও যোদ্ধা। তবে উপস্থাপনার দায়িত্ব বহনকারীদের হাতে
মতবাদটি কী ধরণের আয়ুধ তুলে দিচ্ছে, অর্থাৎ তার সারমর্ম ও দর্শনটা কী সেটাই তো
ভিত্তি। সেই দিক থেকে দেখলে পৃথিবীর অধিকাংশ তথাকথিত ধর্মমত তৈরি হয়েছে কিছু
অবৈজ্ঞানিক অনুমানের ওপর, যেগুলো শ্রেণীতান্ত্রিক বিশেষত পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির
ফসল, এবং কায়েমি স্বার্থে আরও বিকৃত হতেই থেকেছে।
ইহুদি ধর্মগ্রন্থ, বাইবেল ও কোরানের সাধারণ ভিত্তি ‘জেনেসিস’ আদ্যন্ত
অবৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক সত্যের বিরোধী। অনুরূপ অবৈজ্ঞানিকতা যে হিন্দু
শাস্ত্রগুলোতে নেই একথাও বলা যায় না; কিন্তু এরই পাশাপাশি হিন্দু শাস্ত্র বলে
স্বীকৃত একাধিক দর্শনে রয়েছে প্রবল যুক্তিবাদ, প্রকৃতিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা। এমনকি
সাংখ্যের মতো নিরীশ্বরবাদী দর্শনও হিন্দুত্বে অস্পৃশ্য হয়ে যায়নি, বরং গোড়ার দিকে কিছু
গোঁড়া বেদপন্থী বিরোধিতা করলেও পরে তাকে বেদ অনুমত দর্শনের অঙ্গ হিসাবে দেখানোর
প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তথাকথিত হিন্দু ধর্ম বলে যা আপেক্ষিকভাবে পরিলক্ষিত হয়, তা
কোনও একজনের বা একটি গোষ্ঠীর বিশ্বাস বা ভাবনা নয়। আদি ভারতীয় দ্রাবিড়, সিন্ধু সভ্যতা, উপজাতীয় বিশ্বাস
ও আর্য সভ্যতার সংমিশ্রণে তা তৈরিই হয়েছে সংঘাতের পথ ধরে নানাবিধ পরস্পর বিরোধী
মতের আত্তিকরণ ঘটিয়ে। তাই অন্ধ কুসংস্কারের পাশাপাশি
রয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতা, স্থূল জাগতিক সুখকামনার পাশাপাশি গভীর দার্শনিক চিন্তা,
শত্রুনাশের প্রার্থনার পাশাপাশি “বসুধৈব কুটুম্বকম্”-এর ভাবনা। কয়েকটি বেদমন্ত্রে
নিজের সমৃদ্ধি ও শত্রুর সর্বনাশ কামনা থাকলেও বিধর্মীকে হত্যা করে স্বর্গলাভের
প্রলোভন কোনও স্বীকৃত হিন্দু দর্শনে নেই।
‘পরমহংস’-এর প্রিয়তম শিষ্য এতশত বেনোজলের মধ্যে প্রকৃত হংসের মতোই কেবল খাঁটি
দুধটুকু আহরণ করে বিশ্ববাসীকে পরিবেশন করেছেন। অসার বা অবাঞ্ছিত পরিত্যাজ্য যা
কিছু, তা নিয়ে ধেয়ে আসা তির্যক বিদ্রূপগুলোর মোকাবিলা করেছেন পরিহাস দিয়েই। তাই
গঙ্গাসাগরে প্রথম সন্তান বিসর্জনের প্রথা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে মন্তব্য করেন তিনিও
প্রথম সন্তান হিসাবে বিসর্জিত হয়েছিলেন, কিন্তু কালোকোলো চেহারার জন্য সাগর বা
কুমির কারোর মনঃপুত না হওয়ায় ফিরে এসেছেন। কন্যা-সন্তান হত্যার সামাজিক ব্যাধির
অভিযোগটিকেও সকৌতুকে “তাই ভারতে ছেলেরাই প্রসবের কাজ করে” বলে উড়িয়ে দিলেও
স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে প্রতীচ্যের মণীষাকে কাজে লাগান শিষ্যা নিবেদিতার মাধ্যমে।
গোরক্ষিণী সভার গোরুর জন্য মাথা ব্যথা দেখে এক সদস্যকে প্রশ্ন করেন, মধ্যভারতে যে নয়
লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গেছে, তাদের সাহায্যার্থে সংস্থাটি কিছু করছে কিনা।
সেই ব্যক্তি জানায় গোরুকে কসাইয়ের হাত থেকে বাঁচানোই তাদের কর্তব্য, মানুষ মরছে
নিজের কর্মফলে। স্বামীজী বলেন, তাহলে তো বলা যায় গোরুও কসাইয়ের হাতে মরছে নিজের
কর্মফলে। কিন্তু শাস্ত্রে যে বলে গোরু আমাদের মাতা? বিবেকানন্দের সহাস্য জবাব, “তা
বটে, নাহলে এমন সব কৃতী সন্তানদের আর কে প্রসব করবেন?”
স্বামীজীর জীবন সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে যেমন কৌতুহল,
তাঁর বাণী ও শিক্ষা নিয়েও মানুষের আগ্রহ ও চর্চা অপরিমিত। কিন্তু তাঁর যথাযথ
অনুধাবন কি হচ্ছে? কোনও কোনও সম্প্রদায়ের ভয়ানক বিধ্বংসী আচরণ অন্য ধর্মাবলম্বীদের
মধ্যেও অসহিষ্ণুতার বারুদ স্তূপীকৃত করছে। যত দিন যাচ্ছে, আমাদের দেশবাসী শিক্ষিত
ও সভ্য হওয়ার বদলে আরও বেশি করে অন্ধ ও অনৈতিক বিশ্বাস ও প্রথার দিকে ঝুঁকছে।
বাড়ছে পারস্পরিক বিদ্বেষ। কেউ তার নিজের ধর্মের মর্মকথা জানে না, অথচ প্রত্যেকেই
যেন তার স্বনিয়োজিত রক্ষক হয়ে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি শত্রুতাকেই ধর্মাচরণ
বলে ধরে নিয়েছে। আসমুদ্রহিমাচল ইসলাম মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদী হানায় বিপর্যস্ত হতে
হতে এমন পরিস্থিতি, যে এক ধরণের বিপন্ন জঙ্গিপনা আজ যেন হিন্দুত্বের পরিচায়ক হয়ে
উঠেছে। একদিকে যত বোমা, মাদ্রাসা ও হাদিশি মগজ ধোলাইয়ের কারবার, আর একদিকে তত বেড়ে
চলেছে তেত্রিশ কোটি দেবতা, গ্রহ নক্ষত্র, অমুকবাবা, হনুমান কিংবা গোরু পুজোর হিড়িক
দিয়ে হিন্দুত্ব জাহির। বিভিন্ন বিরোধী ও অসম্পর্কিত
দর্শনগুলোকে সমন্বয়িত করার প্রয়াস ‘ভগবদ্গীতায় রয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই গীতাকে
হিন্দু ধর্মগ্রন্থের প্রতিনিধিস্থানীয় মনে করার পক্ষপাতী অনেকেই। বর্তমানে কিন্তু
এই প্রয়াসের সামনে ও পিছনে সর্বধর্মসমন্বয়ের ভাবনার বদলে বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক
উন্মাদনার ভূমিকাই যেন বেশি প্রকটিত। স্বামীজীর নামে হিন্দু ভাবাবেগ
উদ্দীপিত করার চেষ্টা হলেও তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ও উদার চেতনা জনমানসের মনে শেকড় ছড়াতে
পারছে কই?
‘মনুস্মৃতি’-তে কিছু ব্রাহ্মণ্যবাদী আচরণবিধি বা code of conduct থাকলেও তা
পালনের বাধ্যবাধকতা হিন্দু সমাজে নেই। সনাতন ধর্মের কোনও নির্দিষ্ট scripture নেই,
বরং আছে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী দর্শনের স্বকীয় অবস্থান। একটি শাস্ত্র পরবর্তীকালে অন্যটির দ্বারা প্রভাবিত
হলেও কোনও সমাকলিত হিন্দু দর্শন তথা সংবিধান কোনও কালেই ছিল না। বিবেকানন্দ নিজের জন্মগত ধর্মপরিচয়কে পূর্ণ মর্যাদা
দিয়ে হিন্দুত্বের নামে এমন এক সমন্বয়ীকরণের প্রয়াস করেছিলেন, যাতে প্রতিটি
ধর্মবিশ্বাসের স্বাতন্ত্র্য বজায় থেকেও ঐক্য সংহতি তৈরি হয়। “The Christian is not
to become a Hindu or a Buddhist, nor a Hindu or a Buddhist to become a
Christian. But each must assimilate the spirit of the others and yet preserve
his individuality and grow according to his own law of growth..... if anybody dreams of the exclusive survival of his own religion and the
destruction of the others, I pity him from the bottom of my heart, and point
out to him that upon the banner of every religion will soon be written, in
spite of resistance: ‘Help and not Fight’, ‘Assimilation and not Destruction’,
‘Harmony and Peace and not Dissension’.” এই Assimilation বা আত্তীকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যদি প্রকৃতই
হিন্দুত্বের পরিচায়ক হয়, তাহলে সেই উদারতার মধ্যে যে রাজনীতি আছে তা দিগ্বিজয়ে
নাৎসিবাদ বা ফ্যাসিবাদের চেয়ে ঢের শক্তিশালী। কিন্তু আক্ষেপ তা বাস্তবায়িত করার জন্য আর একজন
বিবেকানন্দ দরকার।
রচিত: ৫.১.১৬
প্রকাশিত: সান্ধ্য
আজকাল: ১২ জানুয়ারি ২০১৬