নাবালকোচিত
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, আর সেলাইকল নির্ভয়ার নিশ্বাসে।
২০ ডিসেম্বর ২০১৫, শীতের অপরাহ্ণ। সংশোধানাগারের ফটক দিয়ে
বেরিয়ে আসছে এক তরুণ। সরকারি খরচে বিশেষ গাড়িতে বাড়ির লোকেরা এসেছে নিরাপত্তার
ঘেরাটোপে নায়ককে বরণ করে নিতে। তিন বছর আগে সে ১৬ ডিসেম্বর এমনই এক কনকনে শীতের
দিন, তবে বিকেল নয়, বেশ রাতে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণীর ওপর কিছু অভিনব পরীক্ষা
নিরীক্ষার জন্য খ্যাতি অর্জন করে। তিন বছর সামান্য কায়িক শ্রম দান ও বৃত্তিমূলক
শিক্ষা লাভের পর সে এখন সংশোধিত। মেয়েদের নিম্নাঙ্গে রড ঢুকিয়ে অন্ত্র ছিঁড়ে
ফেললেও আর চিন্তা নেই, আবার সেলাই মেশিনের সাহায্যে জুড়ে দিতে পারবে!
অক্ষয় ঠাকুর, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত ও মুকেশ সিং-রা বিরলতমের মধ্যে বিরলতম
অপরাধ করে থাকলেও মহম্মদ আফ্রোজ় বেচারা তো গিয়েছিল নাবালকোচিত কৌতুহল নিবৃত্তি
করতে। তাই তো জ্যোতি সিং-এর দেহটাকে আপাদমস্তক ভোগ করেও যখন নিষ্পাপ কিশোরের জীববিদ্যার
জ্ঞানতৃষ্ণা মিটল না, তখন আনাড়ি হাতে ভুলভাল আয়ুধ দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করতে হল।
সুতরাং আমাদের মানবাধিকার কর্মী, মনস্তাত্ত্বিক, আইন রক্ষক সকলে উক্ত ‘নাবালক’
‘rarest of the rarest’ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে মানলেও তাকে ‘rarest
of the rarest’ অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করতে অপারগ। বরং কোন
সামাজিক পরিস্থিতি কোন মানসিক অবস্থা এই জাতীয় ‘নাবালকত্ব’-এর জন্য দায়ী, তা খতিয়ে
দেখে পরিস্থিতিকে দোষারোপ করে অপরাধীর প্রতি তারা সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিতে উৎসাহী। এমন মানবিকতার প্রশ্রয়ে যদি এই ধরণের ঘটনা ক্রমাগত
বাড়তে থাকে, তাহলে তার সমাধানে সংশোধনাগারে অতিরিক্ত আসন, বৃত্তিশিক্ষা, ভালো
খাদ্য, মনোরঞ্জন, স্টাইপেন্ডের টাকা ও সেলাইকল বা তেমন কিছুর যোগান থাকলেই হল।
প্রসঙ্গত এমনিতেই ‘rarest
of the
rarest’ ঘটনা আর মোটেই ‘rare’ ব্যাপার নয়। বস্তুত ধর্ষণ করে প্রমাণ লোপাটের জন্য
খুন কোনও কালেই বিরল ছিল না। কিন্তু পদ্ধতিগত নৃশংসতায় দিনকে দিন নতুন নতুন উদ্ভাবন
দেখে বোঝা যাচ্ছে, নিছক প্রমাণ লোপাট নয়, বল প্রয়োগে যৌনতা আদায়ের পাশাপাশি হত্যার
রোমহর্ষক পদ্ধতিটাও সাবালক থেকে নাবালকদের কাছে রীতিমতো উপভোগ্য। সুতরাং ‘মৃত্যুদণ্ডের
ভয়ে হত্যা’ এবং দণ্ড উঠে গেলে নাকি অপরাধের তীব্রতা কমবে, এই সমীকরণ অতি সরলীকরণ
ছাড়া আর কিছুই নয়। যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধের সময়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বা পরিকল্পিত
এথনিক ক্লিনজ়িং-এ এই ধরণের নৃশংসতা ও নারকীয়তার নজির অসংখ্য হলেও স্বাভাবিক
অবস্থাতেও যদি নিত্যনৈমিত্তিক যুদ্ধকালীন আতঙ্কে কাটাতে হয় মেয়েদের, তাহলে এইসব
তাত্ত্বিক মানবিকতা কতটা প্রাসঙ্গিক থাকে? ঘটনাটা বিরল নয় বলেই তো কঠোরতম ব্যবস্থা
দরকার। অথচ স্বাধীন জীবিকায় সহায়তা দেওয়া ছাড়াও এই ‘জাতীয় নায়ক’কে পুলিস যেভাবে
জনরোষ থেকে বাঁচাতে গোপনে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেল, তার সিকির সিকি
তৎপরতা যদি জনসাধারণের নিরাপত্তায় নিযুক্ত হত, তাহলে সমাজের ছবিটা অন্যরকম হত।
বুঝে পাই না চরম শাস্তি দিতে কেন বিরলতম অপরাধের জন্য হাপিত্যেশ করতে হবে। যৌন
নির্যাতন করে হত্যা একটা সামাজিক ব্যধি যা কড়া চিকিৎসার অভাবে মহামারীর রূপ
নিয়েছে। তফাৎ একটাই, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তির বদলে তার বিকৃতির শিকার রোগযন্ত্রণায়
ছটফট করে নিঃশেষ হয়ে যায়। কোনও ব্যাধিগ্রস্ত অঙ্গে পচন লাগলে সেটি কেটে বাদ দিতে
হয় পুরো দেহটিকে সুস্থ রাখতে। ক্যানসার আক্রান্ত টিউমার নতুন অবস্থাতেই কেটে বাদ
দিতে হয়। সুতরাং মানসিক বিকৃতিগ্রস্ত অপরাধী যারা অপরিশোধনীয়,
তাদের জনমানচিত্র থেকে সরিয়ে ফেলাটাই সমাজের পক্ষে সঠিক চিকিৎসা। যদি মহানুভব সমাজ
সংস্কারকরা বয়সের কারণে ঘৃণ্য অপরাধীদের কাউকে কাউকে সংশোধনযোগ্য মনেও করেন,
তাহলেও তাদের সহজে পুনর্বাসন দেওয়া উচিত নয়। কারণ সংশোধিত পরিচয়ে তাদের সমাজের মূল
স্রোতে ফিরতে দেওয়া মানে অপরাধপ্রবণ মানুষদের দুঃসাহসী হতে উৎসাহ দেওয়া, আরও বেশি
সংখ্যক অপরাধকে আমন্ত্রণ জানানো।
২০১২ সালে দিল্লি পুলিসের কাছে ৭০৬টি নথিকৃত ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে নির্ভয়া
একটি। ১৬ ডিসেম্বর ২০১২ থেকে ৪ জানুয়ারি ২০১৩-র মধ্যে নথিভুক্ত মানে ডায়রি নেওয়া
যৌন হেনস্থার সংখ্যা ৫০১ ও বলাৎকারের সংখ্যা ৬৪। অর্থাৎ আমরা যারা সরাসরি আক্রান্ত
বা ক্ষতিগ্রস্ত নই, তারা যখন ‘নির্ভয়া’ কাণ্ড নিয়ে উথালপাথাল, তখনই ঘটে গেছে
অনুরূপ একাধিক নারীমেধ যজ্ঞ প্রচারবৃত্তের বাইরে এবং সেগুলোও যে বীভৎসতায় কোনও
অংশে পিছিয়ে নেই। বর্ণনা দিতে গেলে পাতা জোড়া নারকীয়তা পরিবেশন করতে
হয়। এই বছরই ২০১৬-র ৪ জানুয়ারি হরিয়ানার রোহতকে পাওয়া যায় নিখোঁজ মানসিক
প্রতিবন্ধী একটি মেয়ের কুকুরে খাওয়া দেহাংশ। কুকুরগুলোর দোষ ছিল না। মাথা
থ্যাঁতলানো যে দেহাবশেষ পড়েছিল তা পুরুষ অঙ্গ ছাড়াও লাঠি, কন্ডোম, ব্লেড, মোমবাতি
ইত্যাদির বেপরোয়া প্রবেশে এমন মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল যে সারমেয়রা বুঝতে পারেনি
ওটা সৎকারযোগ্য মনুষ্যদেহ, ওদের ভোজ্য নয়।
অপরাধ করে আইনের ফাঁক গলে পালানো অনেক পুরোনো ব্যাপার, কিন্তু জঘন্যতম অপরাধ
করে রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা তথা প্রশাসন দ্বারা পুরস্কৃত হওয়াটা সত্যিই
নজিরবিহীন। দক্ষিণ আফ্রিকার এক ইসলামিক দেশে কিছু বছর আগে সাক্ষীর অভাবে ধর্ষণের
অপরাধ প্রমাণ করতে না পারায় অবিবাহিত অবস্থায় কৌমার্য হারানোর অপরাধে ধর্ষিতারই
প্রাণদণ্ডের রায় হয়েছিল। বহির্বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জেরে শাস্তি শেষ পর্যন্ত
সরকারিভাবে বলবৎ না হলেও সমাজ তাকে কী সাজা দিয়েছিল, তা জানা যায় না। বলা বাহুল্য
সাক্ষী রেখে এই জাতীয় অপরাধ হয় না, বরং সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাট করতে খুন করা হয়।
গণধর্ষণে অংশগ্রহণকারী সহ-ধর্ষকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এটাও প্রত্যাশিত নয়।
সুতরাং এ জাতীয় অপরাধে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মানুযায়ী নির্যাতককে মধ্যযুগীয়
শাস্তিদানের বিধান থাকলেও, কার্যত নির্যাতিতাকে হেনস্থা ধর্মান্ধ সমাজের দস্তুর
হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুদানে আবার ধর্ষণ ও সোশাল মিডিয়ায় অশালীন ছবি ছড়ানোর জন্য ধৃত পুরুষদের
কষাঘাত ও জরিমানার আদেশ দিলেও, একই সঙ্গে বেশ্যাবৃত্তি ও বেআইনি গর্ভধারণের অপরাধে
আক্রান্ত মেয়েটিকেও ৫০০০ সুদানি পাউন্ড ($880.00/£530.00)
জরিমানা ও কারাবাসের নজির রয়েছে। এগুলো পুরুষতান্ত্রিক ধর্মান্ধতা পরিচালিত রাষ্ট্রে
প্রত্যাশিত ব্যাপার। কিন্তু কোনও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রও যে ধর্ষণ ও খুনের
পৃষ্ঠপোষক হতে পারে, আমাদের তারও সাক্ষী হতে হল।
নির্ভয়া বিচার প্রহসন কাণ্ডে যদিও বর্তমান বিজেপি সরকারের হাত নেই, বরং ঐ
ঘটনার পর প্রাপ্তবয়স্কসুলভ যৌন অপরাধে নাবালকত্বের সংজ্ঞা পুনর্নিধারিত হয়েছে, তবু
আদালতের রায় ও আসামির সাম্প্রতিক মুক্তিতে জ্যোতি সিং-এর মা-সহ দেশের মামুলি জনগণের
ক্ষোভ বর্তমান প্রশাসনের ওপরেই বর্ষিত হয়েছে। কিন্তু
আন্তর্জাতিক মহল ততটা সরব নয়। এটা প্রধানমন্ত্রীর ঘন ঘন বিদেশযাত্রার সুফল কিনা কে
জানে?
২০১৫-র মার্চে BBC
“India’s Daughter” নামে
একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে নির্যাতিতার
প্রতি সহানুভূতি, প্রতিবাদ, সমাজ সচেতনতা ও পূর্বতন সরকারের প্রতি কটাক্ষ ইত্যাদি
কর্তব্য সমাধা করে ফেলেছে, আর কারও কিছু করার নেই। ওদিকে ‘নাবালক অপরাধী’
সংক্রান্ত আইন সংশোধনীটি সংসদে পেশ করাই যাচ্ছিল না নানা রাজনৈতিক চাপান উতোরে।
মাঝখান থেকে মানবাধিকারবাদীরা মৃত্যদণ্ড তুলে দেওয়ার জোরালো প্রচারে নেমে পড়ে।
বিরোধী ও স্বঘোষিত মানবদরদীদের এই মহানুভবতার পিছনে প্রধান অনুপ্রেরণা যে অপরাধী
মহম্মদ আফ্রোজ়ের নাম ও ধর্ম পরিচয়, এটা বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না। বস্তুত ঘৃণ্যতম এই অপরাধীর নামটা মিডিয়াও গোপন রাখারই
চেষ্টা করেছিল, যেহেতু তা ভারতে অপরাধ জগতের পরিসংখ্যানে একটি বিশেষ শ্রেণীর
পৌনপুনিকতা স্পষ্ট করে।
যাই হোক বিল পাস হয়েছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সাবালকত্বের ছাপ ১৮ থেকে কমে ১৬
বছর বয়সে লাগলে সমস্যার সমাধান হবে তো? অতীতে রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশুর অধিকার
সংক্রান্ত সনদে ভারত কিন্তু ১৮ বছর পর্যন্ত মানুষকে নাবালক হিসাবে গণ্য করার পক্ষে
রায় দিয়েছে। বহু দেশ অপরাধের ক্ষেত্রে ১৬ বছরকেই সাবালত্ব ধরে নেয়, যেখানে অনেক
দেশ আবার ঘৃণ্য প্রাপ্তবয়সস্ক অপরাধের বেলা বয়সকে বিবেচনায় আনারই পক্ষপাতী নয়। এ
ক্ষেত্রে বয়ঃসীমা নয় অপরাধের গুরুত্ব ও পদ্ধতিগত নিষ্ঠুরতাই বিবেচ্য হওয়া উচিত, যদিও
ফাঁসির চেয়ে কঠিন শাস্তি ঘোষণা গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। তবে
সিঙ্গাপুরের মতো ধনতান্ত্রিক দেশেও ছেলেছোকরা বেচারাদের মামুলি ইভ টিজ়িং করারও
স্বাধীনতা নেই, ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের ন্যূনতম শাস্তি বেত্রাঘাত, যার ফলে দেশটা একেবারে
অপরাধশূন্য না হলেও নারী ও শিশু নিগ্রহ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
ওদিকে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী করুণা নন্দী আফ্রোজ়ের জেহাদি আদর্শের প্রতি
আকৃষ্ট হওয়ারও সাফাই দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, এর জন্য সংশোধনাগারের আভ্যন্তরীণ
পরিবেশই দায়ী, আঠারো আইনে কোনও ত্রুটি নেই। অর্থাৎ একই যুক্তিতে পরোক্ষে বলা,
অপরাধ যতই গুরুতর হোক, তার জন্যও সমাজ দায়ী, অপরাধকারী নয়, তাই মার্জনাতেও সমস্যা
নেই। বলা বাহুল্য সংখ্যাগুরু অপরাধীর সংখ্যালঘু নামের মাহাত্ম্যই এই অনুপম উদারতার
অনুচ্চারিত কারণ।
কারও মতে তিন বছর আগেই তো এই শাস্তি ওরফে পুরস্কার নির্ধারিত হয়েছিল, তাহলে
এতদিন লাগাতার প্রতিবাদ ছিল না কেন? সত্যিই কি ছিল না? ঘটনা কি একটাই? এর মধ্যে
কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, রোহতক, ধূপগুড়ি, কাকদ্বীপ ইত্যাদি অসংখ্য অসংখ্য অসংখ্য ঘটনা
কি ঘটে যায়নি? তখন যে নির্ভয়াকে ছেড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে নিজেদের মেয়েদের
যন্ত্রণা নিয়ে ক্ষোভ আর হাহাকারে ফেটে পড়তে হয়েছে। আর বাদবাকিদের ভূমিকা যেন
প্রতিকারহীন অচলায়নে শ্মশানকর্মীদের মতো লাশের প্রতীক্ষা করা। শ্মশানকর্মীরা
চিতা বা চুল্লি জ্বেলে শব সৎকার করে, আর আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে কাল্পনিক বিদেহীকে
সান্ত্বনা দিই।
রচিত: ২২.১২.১৫
প্রকাশিত: সান্ধ্য
আজকাল: ডিসেম্বর ২০১৫