সংরক্ষণ কতটা সঙ্গত: প্রসঙ্গ মাতৃভূমি
“সবাই সাবধান, আমেরিকায় বা রাশিয়ায় আইএস জঙ্গি
ধরা পড়লে সে বেঁচে যেতে পারে, কিন্তু মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ যাত্রী উঠে পড়লে প্রাণ
নিয়ে ফেরা অসম্ভব”। অথবা অভিনেতা চিরঞ্জীবের ছবির দৃশ্যের সঙ্গে লেখা, “বৌ গেলে
বৌ পাওয়া যায়, মা গেলে মাও পাওয়া যায় যদি বাপ আবার বিয়ে করে, কিন্তু মাতৃভূমি
লোকালে চড়লে প্রাণ ফিরে পাওয়া যায় না রে পাগলা!” বলা বাহুল্য ফেসবুক, হোয়াস্অ্যাপ
ছেয়ে ফেলা এই রসিকতাগুলো গত ১৭ই নভেম্বর মাতৃভূমি লোকালে ঘটে যাওয়া জনৈক মহিলা
কনস্টেবল দ্বারা এক অনিচ্ছাকৃত হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
এই উষ্মার পেছন একটি ইতিবৃত্তও আছে।
সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জনসাধারণ থেকে
মিডিয়া যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। স্বাভাবিক। খুনে ধর্ষক বাঘা বাঘা অপরাধীরা যেখানে
পার পেয়ে যায়, সেখানে হিন্দ-মোটরের নিরীহ দীপু শর্মার শুধুমাত্র তাড়াহুড়োয় ‘লেডিস
স্পেশাল’এ উঠে পড়ার অপরাধে প্রাণ গেল? হম্বিতম্বি করেনি, পরবর্তী স্টেশনে নেমে
যাওয়ার নাকি প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু অতি বাড় বেড়ে যাওয়া মহিলা কনস্টেবল তার
পরেও এমন ধাক্কা মারে, যে টাল সামলাতে না পেরে সোজা চলন্ত ট্রেনের বাইরে। ঐ
পুলিসকর্মী যে অন্যায় করেছে, সে ব্যাপারে মতবিরোধের কোনও জায়গায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন
খুনটা ইচ্ছাকৃত ছিল, নাকি দুর্ঘটনাকে খুন বলে চালানোটা ইচ্ছাকৃত? আরও প্রশ্ন, মেয়েরা কি সত্যিই পুরুষদের প্রতি
মাত্রাতিরিক্ত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে? উত্তরটা যদি হ্যাঁ-ও হয়, তাহলে প্রশ্ন, হাজার
কোটি নারী নিগ্রহের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনার অভিঘাতে সেটা কি অস্বাভাবিক? কিন্তু
পুরুষ নিগ্রহের ক্ষেত্র, প্রাবল্য, সংখ্যা ও নৃশংসতার মাত্রা খতিয়ে দেখলে এর
সমর্থন পাওয়া যাবে না। এই ক্ষেত্রে শাস্তিটা যদিও লঘু পাপে অতি গুরু দণ্ড হয়ে গেছে,
তবু দুর্ঘটনা বা ধরা যাক নিগ্রহের শিকার হওয়া পুরুষটি সামান্য হলেও আইন লঙ্ঘন করেছিল। অন্যদিকে মেয়েরা প্রতিনিয়ত যে ভয়ানক অত্যাচারের শিকার হয়,
তা কিন্তু পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের অপরাধে নয়, সর্বজনীন বিচরণ
ক্ষেত্রে, এমনকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া
গৃহাভ্যন্তরেও।
বৌ পোড়ানো বা অন্য উপায়ে খুনের প্রতিক্রিয়ায়
কিন্তু জামাই পোড়ানোর হিড়িক কেন বিচ্ছিন্ন ঘটনাও শোনা যায় না। ধর্ষণের যোগ্য
শাস্তি বা খুনের বদলা খুন নিছক রূপোলি পর্দার ফ্যান্টাসি। স্বামী হত্যার দু একটি
নজির যেমন পাওয়া যায়, ধরা পড়লে তাদের অতি তৎপরতার সঙ্গে ধরপাকড় ও শাস্তিদানের
উদাহরণও প্রায় সমান সমান। বিপরীত ক্ষেত্রে ঘটনার সংখ্যা যেমন বেশি, সেগুলো
প্রতিরোধে সমানুপাতিক শৈথিল্য। একটা ঘটনা মনে পড়ছে, বেশ কয়েক বছর আগে তামিলনাড়ুর
এক মহিলা অভিনেত্রীকে তার বিবাহিত পুরুষটি দিনের পর দিন অশ্লীল ছবিতে অভিনয়ের জন্য
যখন চাপ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন অভিযোগ জানিয়ে সাহায্য চাওয়া সত্ত্বেও পুলিস কানামুড়ো
নাড়েনি। অথচ সেই মহিলা যখন মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষার্থে কয়েকজন বন্ধুর
সাহায্য নিয়ে স্বামী নামের ঐ নরকের কীটটিকে হত্যা করায়, তখন রাজ্য পুলিস অতি
তৎপরতার সাথে তাকে সদলবলে গ্রেপ্তার করে। মাতৃভূমি কাণ্ডের ওই মহিলা কনস্টেবলের
শাস্তি এমনকি ফাঁসির দাবিতে মানুষ যেভাবে সরব হয়েছে, তাতে কি একবারও মনে হচ্ছে না,
আইন ভঙ্গকারীকে বাধা দিতে গিয়ে অসাবধানে বাড়াবাড়ি করে ফেলা পুলিসকর্মীর শাস্তি যদি
মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে বলাৎকার করে খুন করা অথবা বাড়ির বৌকে নিষ্ঠুর উপায়ে মেরে
ফেলা মানুষগুলোর শাস্তি হিসাবে সাত দিনের ফাঁসিও যথেষ্ট নয়?
সমস্যার বীজ ২০১০ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রীত্বের সময় রোপিত হয়েছিল কিনা বলা যায় না, যদিও সেটা ছিল সমাধানেরই প্রয়াস। প্রতি নিয়ত যানবাহনে ও অন্যান্য প্রকাশ্য ক্ষেত্রে মেয়েদের
যে শারীরিক ও যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়, কম পেশিবল নিয়ে খুব বেশি ভিড়ে পুরুষদের ধাক্কা সামলানো যা দুরূহ,
উপরন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে এখনও অধিকাংশ মহিলার পোষাকও যেমন অসুবিধাজনক, তাতে মেয়েদের জন্য
আলাদা ব্যবস্থাপনার দাবিকে কখনই নস্যাৎ করা যায় না। আর সেই ব্যবস্থাপনার পক্ষে নয়
কামরার লোকালে সামনে পেছন আধা-আধা করে একটি মাত্র কামরা যে প্রয়োজনের চেয়ে নেহাৎই
অপ্রতুল, সে ব্যাপারেও ভিন্ন মতের জায়গা নেই। তাই
‘মাতৃভূমি’ নামে যখন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ট্রেন চালু হল, তাতে মহিলা
নিত্যযাত্রীদের সাথে সাথে তাদের বাড়ির পুরুষ আত্মীয়রাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
প্রসঙ্গত মজার ব্যাপার, ভিড়ের মধ্যে জেনারেলে উঠতে গেলেও কিন্তু মেয়েদের প্রায়ই
শুনতে হয় ‘লেডিসে যান’, যেখানে দৈনন্দিন ব্যবহারে জেনারেল কামরা ‘জেন্টস্ কামরা’র
সমার্থক হয়ে যায়। কোনও ঠ্যাঁটা মহিলা মরিয়া হয়ে সর্বসাধারণের কামরায় উঠে পড়লে অনেক
ক্ষেত্রেই সহযোগিতা যেমন পায়, তেমনি তাকে কতভাবে শায়েস্তা করা যায়, তা বাচ্চা মেয়েরাও
জানে।
যাই হোক, দেখা গেল চূড়ান্ত ব্যস্ত সময় যেখানে
অন্যান্য ট্রেনে মানুষ ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছে সেখানে লেডিস স্পেশালগুলো যথেষ্ট ফাঁকা।
ফাঁকা মানে কিন্তু সিট ফাঁকা নয়, আমরা ভর্তি কামরা বলতে যা বুঝি, সেই তুলনায় প্রায়
৭০% খালি। সুতরাং প্রমিলা-স্পেশালে নয়টির মধ্যে তিনটি কামরা পুরুষ
যাত্রীদের জন্য অনুমোদন করার দাবিটা একেবারে অযৌক্তিক নয়। রেল মন্ত্রক ও রাজ্য
সরকার যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তা গণ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েই মাতৃভূমির তিনটি
কামরা জেনারেল ঘোষণা করে। কিন্তু ১৭ আগস্ট শিয়ালদা-রাণাঘাট মাতৃভূমিতে পুরুষ
যাত্রীদের স্রোত দেখে মহিলারা কেউ কিছুটা জেনে ও অনেকে না জেনে ‘পুনর্মুষিক ভব’র
আশঙ্কায় ভুগতে শরু করে, যার জেরে খড়দা স্টেশনে মাতৃভূমিকে কেবলমাত্র মেয়েদের জন্য
সংরক্ষিত রাখার দাবিতে রেল লাইন আটকে অবরোধ শুরু হয়। নতুন নিয়মের কথা সবাই না জানায় পুরুষ যাত্রীদের নেমে যেতেও
জোর করা হয়। দু পক্ষের বিক্ষুব্ধরা পরস্পরের দিকে ইঁট পাথর ইত্যাদি সহ
চড়াও হয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও এক মহিলাসহ
চারজনকে গ্রেপ্তার দ্বারা সামাল দিতে হয়। আহত হয় আটজন যাত্রী এবং এক মহিলা কনস্টেবলসহ
এগারোজন পুলিসকর্মী। বিক্ষোভের জেরে ৪০টি ট্রেন বাতিল হয় ও প্রায় ১ লক্ষ যাত্রী
বিকল্প বাহনের সন্ধানে যেতে বাধ্য হয়।
২১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় ও রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু ‘মাতৃভূমি’কে পুনরায় শুধুমাত্র মহিলাদের
জন্য ঘোষণা করে পরিস্থিতির সামলাতে চাইলে ২৪ আগস্ট যা হল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব।
হাবরা লাইনের অশোকনগর, হৃদয়পুর ইত্যাদি একাধিক স্টেশনে শতাধিক পুরুষ মাতৃভূমি
লোকাল বাতিলের দাবিতে গাড়ি আটক করে মেয়েদের ওপর উন্মত্ত হামলা চালায়। শুধু
মাতৃভূমির যাত্রী নয় স্টেশনে উপস্থিত অন্য ট্রেনের মহিলা যাত্রী এমনকি আশপাশের
মেয়েরাও আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায় না। আক্রমণকারীরা সকলে রেলযাত্রীও ছিল না, কিন্তু
তারা মেয়েদের প্রতি একটা জাতক্রোধ নিয়ে স্বজাতির স্বার্থরক্ষায় সুসংগঠিত হামলায়
নেমেছিল।
একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, যে লাইনে মেয়েরা
প্রতিবাদ জানিয়েছিল, সেই মেইন লাইনে নয়, গোলমাল বাঁধল বনগাঁ লাইনে। প্রসঙ্গত
বারাসাত, বনগাঁ, হাবরা রুটের বাসে ‘লেডিস সিট’ বলে কিছু নেই। নিজের অভিজ্ঞতায়
দেখেছি ঐ সব পথের শক্তসমর্থ পুরুষ যাত্রী বা অল্প বয়সী ছেলেছোকরারা কোনও গর্ভবতী
মহিলাকেও আসন ছেড়ে দিতে রাজি নয়। ভাবটা এমন ‘মেয়ে তো কী, সব সমান”। সমান যে নয় উত্তর ২৪
পরগণার বারাসাত, মধ্যমগ্রাম, কামদুনিতে ঘটে যাওয়া একাধিক নারকীয় ঘটনা তার সাক্ষী।
বরং যেসব রুটে মহিলা আসনের সংরক্ষণ চালু, সেসব দিকের পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে ভদ্রতা
ব্যাপারটা তবু চোখে পড়ে। অর্থাৎ ‘সব সমান’ ঘোষণা করে শারীরিক শক্তির তারতম্যটা
অস্বীকার করলে সব ভয়ানক রকম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কে জানে হয়তো, বনগাঁ, বারাসাত
অঞ্চলের পুরুষদের দাবিতেই ওদিকের বাসে মহিলা আসন রাখা যায়নি। তারা
মেয়েদের ওপর চিরাচরিত অত্যাচার তো করবেই, বদলে অবলা জ্ঞানে তাচ্ছিল্যপূর্ণ
দাক্ষিণ্যও করতে নারাজ।
মেয়েরা যত বেশি বহির্জগতে আসছে ও সাফল্যের সঙ্গে
নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে তাদের ওপর পুরুষালি অত্যাচার ততই জাতি বিদ্বেষের চেহারা
নিচ্ছে। গণধর্ষণের প্রতিকার হচ্ছে না, অথচ মেয়েরা বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে এই
ঈর্ষায় স্ত্রী-পুরুষ দাঙ্গা বেধে যাচ্ছে! এই ভয়াবহ প্রবণতা যেন ১৭ নভেম্বরের
মাতৃভূমি লোকাল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারী মৃগয়ায় ইন্ধন না পেয়ে যায়।
রচিত: ২.১২.১৫
প্রকাশিত: সান্ধ্য
আজকাল: ডিসেম্বর ২০১৫