অপরাধের লাইসেন্স ও জেন্ডার
সিমেট্রি
প্রকৃতি পুরুষ মানুষকে যা সুবিধা দিয়েছে, আর মেয়েদের
শারীরিকভাবে হীনবল করার সাথে সাথে এত রকম প্রাকৃতিক অসুবিধায় আপাদ মস্তক নিগড়
পরিয়ে রেখেছে, যে পুরোনো আপ্তবাক্য “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা” প্রতিবাদযোগ্য মনে হলেও
অস্বীকার করার উপায় থাকে না। এর ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সংযম পুরুষের অভিধানে না
থাকলেও চলে, যেখানে এই গুণগুলো নারীর সামাজিক, পারিবারিক এমনকি প্রাকৃতিক ভূমিকা
পালনেও আবশ্যিক হয়ে পড়ে। শরীরবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব ও সমাজ মনস্তত্ত্বের একাধিক
পরীক্ষা নিরীক্ষাজাত সিদ্ধান্ত হল, পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন ও অ্যান্ড্রোজেন
লিবিডোর সাথেসাথে প্রতিযোগীসুলভ ও আক্রমণাত্মক মনোভাবেরও জন্ম দেয়। টেস্টোস্টেরোন
নারী দেহেও কামোত্তেজনা সৃষ্টিতে সহায়ক। সুতরাং অপরাধমূলক কাজে মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের
অধিকতর অংশগ্রহণ স্বাভাবিক, মানে ক্ষমা করা যেতেই পারে।
কিছু
পরিসংখ্যান:
২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগারে নিক্ষিপ্ত আসামির মধ্যে পুরুষের
সংখ্যা (৫০,৩৭,০০০) মাহিলাদের (৫,৮১,০০০) তুলনায় ৯ গুণেরও বেশি। ২০১৪ সালে
অসামাজিক কাজের জন্য গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের ৭৩% ছিল পুরুষ। এর মধ্যে হিংসাত্মক
অপরাধের জন্য ধরা পড়া পুরুষের সংখ্যা ৮০.৪% এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধের জন্য
৬২.৯%। United States Department of Justice ১৯৮০ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে খুনের (homicide)
একটা পরিসংখ্যান একত্রিত করে। দেখা যায় – মোট অপরাধের ৯০.৫% করেছে ছেলেরা। খুনের
অপরাধে ধৃতদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ সংখ্যাগুরু। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুকে হত্যা
করার অপরাধে জাগতিক মায়ের তুলনায় জাগতিক বাবাদের সংখ্যা কিছু বেশি। মা বাবা ছাড়া অন্য কারও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুকে হত্যা
করার পরিসংখ্যানে পুরুষরা অনেক এগিয়ে, ৮০%।
অপরাধের শিকারকে মেরে ফেলাতেও পুরুষেরা অপ্রতিদ্বন্দী, ৭৬.৮%। গার্হস্থ্য খুনের বলির সংখ্যা মেয়েরা ৬৩.৭% এবং যৌন
নির্যাতনের পর খুন হওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি (৮১.৭%)। প্রসঙ্গত পুরুষরা সচরাচর যৌন হিংসার শিকার হয়
পুরুষদের দ্বারাই। ড্রাগ সেবনে মৃতের সংখ্যায়
ছেলেরা এগিয়ে (৯০.৫%) এবং তাই নিয়ে গোষ্ঠী কোন্দলের ফলে বলিও পুরুষেরা বেশি হয় (৯৪.৬%)। ২০১১-র
গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরুষ অপরাধীর সংখ্যা – বল পূর্বক ধর্ষণে ৯৮%,
ডাকাতিতে ৮৯%, বন্ধ ঘর ভেঙে ডাকাতি (burglary)-তে ৮৫%, অগ্নিসংযোগে ৮৩%,
মোটরগাড়ি চুরিতে ৮১.১%, সম্পত্তি চুরিতে ৮১.৭%, গুণ্ডামিতে ৮১.৭%, নিজের পরিবার ও
সন্তানের প্রতি অপরাধে ৭৯.৭%, জখম করায় (vandalism) ৭৭.৮%, জালিয়াতিতে
৫৮.৭%, মামুলি চুরিতে ৫৭.৩%।
কানাডায় ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে পুরুষদের অপরাধের হার দ্বিগুণ
হয়েছে যেখানে মহিলা অপরাধীর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। কিন্তু
মেয়েদের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির হার বেশি হলেও অপরাধের মোট পরিসংখ্যানে পুরুষেরা এমনকি
বাচ্চা ছেলেরাও চাম্পিয়ান। ২০০২ সালে কানাডায় বার্ষিক মোট অপরাধী
চিহ্নিত মানুষের মধ্যে পরিণত পুরুষ ৩,২৬,৫৩৬ জন, পরিণত মহিলা ৭১,০৫৮ জন, অপরিণত ছেলে ৭৪,৫১৩ জন এবং অপরিণত মেয়ের সংখ্যা ২৪,৪৮৭ জন। দেখা যাচ্ছে ছেলেরা অপরিণত বয়সেও মেয়েদের তুলনায় বেশি
অপরাধ করে থাকে, এমনকি পরিণত নারীদের চেয়েও বেশি। ২০১৩-১৪-তে বেআইনি কার্যকলাপে পুরুষের সংখ্যা ৮৫% যেখানে মেয়েদের সংখ্যা ১৫% ।
অপরাধ ও হিংসার ধরণ:
মেয়েরা অপরাধ করলেও গুরুতর জখম, খুন ইত্যাদিতে তেমন দড় নয়, বদলে শপ লিফ্টিং,
চুরি, জালিয়াতি এই জাতীয় অপরাধে সীমাবদ্ধ থাকে। তাছাড়া দলবদ্ধ ডাকাতি, অন্যকে
হ্যানস্থা, র্যাগিং বা বুলিং এসবেও তারা অনেক পিছিয়ে। তাছাড়া এই অপরাধের নথিকরণে
তৃতীয় লিঙ্গের সমকামী বা রূপান্তরকামীরা অধিকাংশ আদতে পুরুষ হলেও নারী অপরাধীর দলভুক্ত
হয়ে তথ্যে জল মেশায়। না হলে প্রকৃত নারী অপরাধীর অনুপাত হয়তো আরও কম।
একমাত্র দেহ ব্যবসা ছাড়া আর সব ধরণের অপরাধেই মেয়েরা সব দেশেই অনেক পিছিয়ে। আর
দেহ ব্যবসায় অধিকাংশ মেয়ে নাবালিকা অবস্থাতেও বাধ্য হয়ে আসে। বাধ্য মানে শুধু অভাবের তাড়না নয়, তাদের হাত পা বেঁধে জোর করে যৌনদাসত্বের নরকে ছুঁড়ে
ফেলা হয়। যারা
স্বেচ্ছায় উপার্জনের রাস্তা হিসাবে দেহ বিনিময় বেছে নেয়, সাধারণত
প্রশাসনিক তৎপরতায় তাদেরকেই ধরা হয়। নাইট ক্লাব, পিপ শো এই জাতীয় প্রমোদ ভবন
তো রীতিমতো সরকারকে খাজনা দিয়েই যৌন ব্যবসায় মেয়েদের ব্যবহার করে চলেছে। এমনকি পর্নোগ্রাফিক ফিল্ম
দুনিয়া যেখানে বহু মেয়েকেই জোর করে নেশাগ্রস্ত করে ঘিনঘিনে কাজ করানো হয়, সেটাও এখন মোটামুটি স্বীকৃত ইনডাস্ট্রি।
তবে পশ্চিমি দুনিয়ায় নাকি মহিলারাও মারের বদলে অনেক সময় পাল্টা মার দিয়ে ফেলে,
যার ফলাও করে নাম রাখা হয়েছে gender symmetry। তবে শারীরিক শক্তির বা মানসিক কাঠিন্যের অভাবে মেয়েরা
পুরুষ সঙ্গীকে আঘাত করলেও তা সাধারণত গুরুতর হয় না। গবেষক Dekeseredy তাই বলেছেন, "studies finding
about equal rates of violence by women in relationships are misleading because ........, there is a difference between someone who uses violence to fight back
or defend oneself and someone who initiates an unprovoked assault.” অর্থাৎ এই সিমেট্রির মধ্যে
গোলমাল আছে; কারণ আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রত্যাঘাত ও স্বতঃপ্রণোদিত হিংসা এক নয়। তবে
কিছু মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় দেখা গেছে মনে প্রচণ্ড রাগ ও আঘাত করার ইচ্ছা পুষে
রাখায় মেয়েরা সামান্য এগিয়ে। স্বাভাবিক। স্বামী মদে বা অন্য
মহিলার পাল্লায় কিংবা জুয়ায় টাকা উড়িয়ে দিচ্ছে, স্ত্রীর বাক্য ও অশ্রুবর্ষণ
কোনওটাই কাজে লাগছে না, উল্টে স্ত্রী বাধা দিতে গেলে আক্রান্ত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে –
এমন অবস্থায় বাস্তবে মারধোর করতে না পারলেও সেটা করার ইচ্ছা জন্মানো খুব
স্বাভাবিক, আবার অশান্তির ভয়ে সেই ইচ্ছা অবদমনটাও চরম বাস্তব। সুতরাং সব রকম
পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সমীক্ষাই সামাজিক ও পারিবারিক হিংসায় পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে
(যার ফলে মেয়েরা মেয়েদের প্রতিই হিংস্র হয়ে ওঠে) অবিসংবাদিত বিজয়ী ঘোষণা করে।
আবার সভ্য সমাজে সমীক্ষা করে দেখা গেছে
non-reciprocal partner violence-এ মানে একতরফা মারায় নাকি মেয়েদের
অংশগ্রহণ পুরুষদের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে ভেবে
দেখলে এই non-reciprocal partner violence-এর উদাহরণ বা ক্ষেত্রগুলো অনুমান
করা যায়। খুনসুটি বা মান অভিমানের জেরে হালকা চড় মারা, চুলের মুঠি ধরা, কান মোলা,
খিমচে দেওয়া, বুকে কিল মারা ইত্যাদি জাতীয় আক্রমণ মেয়েরা তাদের পুরুষ সঙ্গীকে হয়তো
করে থাকে, যাতে সত্যিকারের আঘাত করার ইচ্ছা নয়, থাকে অনুযোগ লজ্জা উৎকণ্ঠা বা
অভিমানের প্রকাশ। পুরুষরা নিতান্ত রগচটা বেরসিক বা নারীবিদ্বেষী না হলে, সাধারণত
এই জাতীয় আচরণে হয় মজাই পায়, নয়তো অগ্রাহ্য করে এবং এগুলো সচরাচর হিংসা (violence)-র
আওতায় পড়েই না। হয়তো এর মধ্যে মেয়ে বলে ক্ষমা করা বা ছাড় দেওয়ার একটা শিভালরি কাজ
করে যার দৌলতে ‘lady’s first’, ‘lady’s
seat’, গাড়িতে ওঠার সময় দরজা খুলে
দেওয়া, বসার চেয়ার এগিয়ে দেওয়া এই ধরণের ভদ্রতা তথা সৌজন্য জন্ম
নিয়েছে। তবে এই জাতীয় নির্বিষ আক্রমণও যদি কোনও
পুরুষ কোনও মেয়েকে বা মহিলাকে করে, তা অভদ্রতা অসভ্যতা বলে প্রতিভাত হয়। যেমন একটা বাচ্চা তার মা কি বাবার কোলে উঠে হাত পা ছুঁড়ে
মারলে তা ভায়োলেন্স বা অ্যাবিউজ হয় না, কিন্তু বড়রা বাচ্চাদের মারলে
সেটা মার বলেই গণ্য হবে। মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে নেই এই শিক্ষা
সভ্য সমাজ দিয়ে থাকে। কিন্তু উল্টোটায় আইনত বা সৌজন্যত ততটা দোষ নেই বলে আদুরে
চড় সত্যিকারের চড়ও হয়ে যেতে পারে। সীমারেখাটা খুব সূক্ষ্ম।
তবে reciprocal partner violence-এর ক্ষেত্রে অর্থাৎ মারামারি
লাগলে বলা বাহুল্য মেয়েরা অনেক বেশি গুরুতর আহত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে Violence and Victims-এর এক রিভিউ পরিষ্কার
জানাচ্ছে ছোটখাটো তাৎক্ষণিক মারামারিতে স্ত্রী পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ মোটামুটি সমান
হলেও গুরুতর আঘাত ও অত্যাচারের পরিসংখ্যানে মেয়েরা পুরুষের পাশে দাঁড়াতেই পারে না।
মেয়েরা সাধারণত আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণ করে থাকে যেখানে পুরুষরা নারী ও পরিবারের
ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের বাসনায় ও যৌনতার দাবিতে স্বতত আগ্রাসী হয়ে ওঠে। Trauma Violence Abuse জার্নালে ২০১১-তে প্রকাশিত
রিভিউও একই কথা জানায় – মহিলারা আক্রমণাত্মক হয় অবদমিত রাগে, অবহেলিত থেকে মনোযোগ
আকর্ষণের জন্য, অথবা নিছক আত্মরক্ষার তাগিদে।
২০১১-য় প্রকাশিত Aggression and Violent Behavior জার্নালের সমীক্ষাও দেখায় ছোটখাটো আঘাতে দু পক্ষই
সমান হলেও সঙ্গীকে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো বিপজ্জনক আঘাত পুরুষরাই হেনে থাকে।
আঘাতের উপাচার চয়ন থেকেই স্ত্রী ও পুরুষের আক্রমণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়।
মেয়েরা যেখানে কিছু ছোঁড়া, চড় মারা, হাল্কা কিল, আঁচড়, কামড় ইত্যাদির আশ্রয় নেয়,
পুরুষেরা সেখানে লাথি, ঘুষি, লাঠি বা বেল্ট দিয়ে পেটানো, গলা টিপে ধরা বা গলায়
ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করা – এই জাতীয় গুরুতর জখমকারী প্রাণঘাতী আক্রমণ করে থাকে।
তবে এই শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। জেন্ডার সিমেট্রির শৌখিন
ধারণার বাইরে যদি বাস্তব হিংসাত্মক ঘটনাগুলি দেখি, সেগুলি কিন্তু আদতে
নন-রেসিপ্রোকালই, যেখানে পুরুষরা একতরফা আগ্রাসী আচরণ করে। গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন হিংসা
বা যে কোনও প্রচলিত নারী নির্যাতনে মেয়েরা একতরফা মার খায়, পাল্টা মার দেয় না বা
দিতে পারে না – কারণটা শারীরিক দুর্বলতা, সংস্কার বা সমাজের অসহযোগিতা – যাই হয়ে
থাক। সুতরাং যাকে ‘নন রেসিপ্রোকাল’ বলা হচ্ছে সেগুলি আদতে হিংসা নয়, আর
রেসিপ্রোকাল পার্টনার ভায়োলেন্স সত্যিই রেসিপ্রোকাল না কার্যত পুরুষালি আগ্রাসন তা
নিয়ে আমি সন্দিহান। প্রসঙ্গত পুরুষতান্ত্রিক জগৎকে Androgenic world বলা হয়। অ্যান্ডোজেন
একটি পুরুষ হরমোন। সুতরাং
নামকরণেই অপরাধের লাইসেন্স আদায় করা আছে!
রচিত: ২৫.৪.১৬
প্রকাশিত: সান্ধ্য আজকাল:
সান্ধ্য আজকাল মে ২০১৬