আসামের ভাষা আন্দোলনে বৃন্তের অপর কুসুম
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলাভাষা আন্দোলনে ২১শে ফেব্রুয়ারির পাশাপশি ১৯শে মে তারিখটাও বিগত দশকে আলোচনায় উঠে এসেছে যদিও ঘটনাটা প্রায় ৬০ বছর আগেকার। আব্দুল বরকতদের মতো শহীদ স্মৃতিস্মৃতিস্তম্ভে খোদিত না হলেও ক্রমশ উল্লিখিত হচ্ছে ১৯৬১-র ১৯শে মের ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরোকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদরঞ্জন দাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর; অথবা কদাচিত ১৬ই আগস্ট ১৯৭২-এ করিমগঞ্জে নিহত বিজন চক্রবর্ত্তী কিংবা ২১শে জুলাই করিমগঞ্জে শহিদ জগন্ময় দেব, দিব্যেন্দু দাস, কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস এঁদের নামও। দিনটিকে ‘ভাষা শহীদ দিবস’ রূপে পালন করার প্রস্তাবও উঠেছে।
১৯৩১ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার ১৬ বছর আগের এক গণনায় দেখা তথাকথিত আসামরাজ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল অসমীয়াভাষীর দ্বিগুণ। স্বাধীনতার পরেও তাই স্বাভাবিক ভাবে বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই গেছে। এখন ২০১১-র সর্বেশেষ জনগণনা অনুযায়ী বরাক উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ৪২% হিন্দু, ৫০% মুসলিম, ৪% খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ৪%। কাছাড় জেলায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬০%, কিন্তু করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ – যথাক্রমে ৫৩% ও ৫৮%।[১] পুরো উপত্যকায় মুসলমান বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বরাকের বাংলাভাষা আন্দোলনে তাদের বিস্ময়কর অনুপস্থিতি! কিন্তু তাই নিয়ে কোনও পর্যবেক্ষককেই আমি প্রশ্ন তুলতে দেখিনি। মুসলিমদের তরফে অংশগ্রহণ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সাল থেকে, আর তৎপরতা চোখে পড়ছে ২০১০-এ ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার (NPR) প্রস্তুাবের পর। আমার গল্পটা এখানেই।
পরাধীন ভারতে মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর ১৯০৬ সাল থেকেই প্রথমে নবাব সেলিমুল্লার নির্দেশে, ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে ফাঁকতালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সাইদুল্লার সদিচ্ছায় এবং স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ থেকে কংগ্রেসে এসে ১৯৫৭-য় একেবারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়ে বসা মইদুল হক চৌধুরীর সক্রিয়তায় আসামে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে অবাধে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটে উপত্যকার জনবিন্যাসটাই বদলে দিয়েছে। মাঝে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদোলই ও মইনুলের মন্ত্রীসভারই মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিয়া অনুপ্রবেশে রাশ টানার চেষ্টা করেও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের অসহযোগিতায় সক্ষম হননি। মাঝখান থেকে পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত শরণার্থী স্রোত ও অনুপ্রবেশে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৫৫ সালেই শুরু হয়ে যায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রচারিত ধারণা হল, ঔপনিবেশিক কাল থেকে বাঙ্গালীদের শিক্ষা ও পেশায় অগ্রসরতার ফলে অসমীয়াদের মনে জন্মানো ঈর্ষাবোধের বিস্ফোরণ ছিল ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন, আর তাতে নাকি ইন্ধন জুগিয়েছিল মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা। দেখা যাক ইতিহাস কী বলে।
আসামের ভাষা আন্দোলনে মুসলিমদের আংশগ্রহণ:
১৯৬০ সালে ‘বঙ্গাল খেদা’নো রীতিমতো প্রদেশিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ৪ঠা জুলাই থেকে টানা দশদিনের হিংসায় বাঙ্গালী নরমেদযজ্ঞ শেষে ২৪শে অক্টোবর আসাম বিধানসভায় “একক অসমীয়া ভাষা বিল” পাস হয়ে গেল। বঙ্গভাষীরা না হয় ভেদ্য লক্ষ্য, বিবেচিত হল না বিপুল সংখ্যক পার্বত্য জনজাতির কথাও। অগ্রাহ্য করা হল রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশও (State Recognisation Commission, Report, Pg-211, sec 733, Para 719)।
বাঙ্গালীরা দেখল একতরফা সমঝোতা করেও শান্তিরক্ষার বদলে ক্রমশ তাদের অস্তিত্বই বিলুপ্তির পথে। তাই ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে আহূত হল ‘কাছাড় জেলা সম্মেলন’। সেখানে গৃহীত সংকল্প অনুযায়ী শুরু হল শান্তিপূর্ণ পিকেটিং ও একটানা ‘সত্যাগ্রহ’। সরকার নির্বিকার দেখে ১৯শে মে শিলচর স্টেশনে প্রথম রেল অবরোধ করা হয়। করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতেও সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিসের লাঠিচার্জ, কাটিগড়ায় সত্যাগ্রহীদের গাড়িতে আগুন ইত্যাদি করেও অবরোধ তোলা যায়নি। অতঃপর ২টো ৩৫মিনিটে শিলচর স্টেশনে শুরু হয় পুলিসের গুলিবৃষ্টি। এগারোজন ঘটনাস্থলেই শহীদ। আহত শতাধিক।
সুকুমার বিশ্বাসের লেখা “আসামে ভাষান্দোলন ও বাঙালি- প্রসঙ্গ ১৯৪৮-১৯৬১” গ্রন্থে পাওয়া যায় এর মাস খানেক পর ১৭ জুন বন্দী সত্যাগ্রহীদের জেল থেকে ছাড়া শুরু হয়। তৎসহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ” ও স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় সম্মত হওয়ায় আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত হল। কিন্তু পরিস্থিতি শমিত হয়ে আসার দু’ দিন পরেই ১৯ জুন হাইলাকান্দি শহরের তিন দিক থেকে দশ-পনেরো সহস্র উন্মত্ত জনতা মহকুমা শাসকের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে শহরে ঢুকে একটি মসজিদে নমাজ পড়ার জেদ করে। আইজি হায়দার হোসেনের চাপে মহকুমা শাসক প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পর বাঁধভাঙা নমাজিরা “আল্লা হো আকবর”, “চালিয়া সরকার জিন্দাবাদ”, “অসমীয়া শিখতে হবে” ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে পথের ধারের হিন্দুদের দোকানপাট লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি শুরু করে। মসজিদ থেকেও বেরিয়ে আসে প্রভূত অস্ত্রশস্ত্র। হাইলাকান্দি থেকে ৬ মাইল দক্ষিণে মনাছড়া এলাকাতেও দাঙ্গা ছড়ায় [পৃ.৩৭৩-৩৭৪]।
দাঙ্গার আভাস মে মাস থেকেই পাওয়া গিয়েছিল, যে কথা জেলাশাসক আর.কে. শ্রীবাস্তবও স্বীকার করেন। সংবাদে প্রকাশ, “ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য গত মাসাধিককালব্যাপী বিভিন্নমুখী চেষ্টা গতকাল অর্থাৎ ১৯শে জুন শিলচর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী মহকুমা হাইলাকান্দিতে উচ্ছৃঙ্খল আকার নেয়। জনতা গৃহদাহ, লুঠতরাজ এমন ব্যাপক আকারে আরম্ভ করে যে পুলিশকে দুবার গুলি চালাতে হয়, এবং তার ফলে রাত ৯টা পর্যন্ত অন্তত ৭ জন নিহত ও ৩০/৪০ জন আহত হয়। ....শহরে সন্ধ্যা থেকে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। একই সঙ্গে ১৪৪ ধারাও বলবৎ থাকে।” [পৃ.৩৭৪] তারপরেও সান্ধ্য আইন উল্লঙ্ঘন করে তারা রাতে হিন্দু উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে হামলার ফলে ২০০-র বেশি হিন্দু উদ্বাস্তু গৃহ ভস্মীভূত হয়, খুন হয় বেশ কয়েকজনকে। সরকারি রিপোর্টে অনুযায়ী পুলিস ও দাঙ্গাকারীদের অস্ত্রে ১০ জনের মৃত্যু হয় ও ১৫ জন আহত হয়। “কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর স্বগ্রাম সোনাবাড়িঘাট থেকে আরম্ভ করে শিলচুরী পর্যন্ত মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের ৪/৫ শো দুর্বৃত্ত বন্দুক ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে “আল্লা হো আকবর”, “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে শিলচুরীর সন্নিকটবর্তী পানি ভরা (পিতল বিল) উদ্বাস্তু কলোনী আক্রমণ করে।”[পৃ.৩৭৬]।
পরিস্থিতির চাপে রাজ্যপাল জেনারেল এস এম নাগেশ কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমাকে ‘উপদ্রুত এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা করেন। নামাতে হয় সেনা। পুরো অশান্তির কৃতিত্ব আপামর জনগণ তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীকেই দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক উচ্চাশা পূরণের জন্য কংগ্রেসের মতো অসাম্প্রদায়িক দলের আশ্রয় খুব কাজে লেগেছিল মুইনুলের[পৃ.৩৭৫]। মইনুল শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৯শে জুন হাইলাকান্দি পৌঁছান। কিন্তু তিনি ২০শে জুন হাইলাকান্দি ছাড়া্র দু ঘণ্টার মধ্যে “পকিস্তান জিন্দাবাদ” ধ্বনি সহযোগে চন্দ্রপুর, মোহনপুর, ফণিবোরার সমস্ত হিন্দু বসতি ও শিবির ভস্মীভূত হয়ে যায়। ৭৫০ জনের বেশি গৃহহারা। লুগাগলাচেরা, লালমুখ, বাগবাজার ইত্যাদি চা-বাগানের কোয়ার্টগুলো লুণ্ঠিত হয়। ২২ জুন উদ্ধার হয় ১৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অর্ধকবরস্থ দেহ[পৃ.৩৭৮]।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আশ্বাসে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ আন্দোলন স্থগিত হয়ে নয়াদিল্লীতে আলোচনার সিন্ধান্ত নেওয়ার পরেও যেভাবে দাঙ্গা ছড়িয়েছে, তা “স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তীকালে মুসলিমলিগের কার্যকলাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়...” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছেও সুস্পষ্ট, “মুসলমানদের জন্য সমগ্র আসাম দখল করবার উদ্দেশ্যে হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামাকারীরা মুসলিমলিগপন্থীদের অনুরূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।”[পৃ.৩৭৭]
সংবাদে ফাঁস হল, কাছাড়ে মেহেরপুরে(?) মইনুলের নিকটাত্মীয় জিলানী চৌধুরীর গৃহে মুসলমানদের এক গোপন সভায় ‘কাছাড় কল্যাণ সমিতি’ গঠিত হয়েছে। শিলচর বাজারে হিন্দুদের দোকান বর্জন এবং কাছাড়ের পাকিস্তানভুক্তির সপক্ষে মুসলমানদের পৃথক দোকান ও বাজার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাছাড়ে বসবাসকারী প্রায় এক লক্ষ পূর্বপাকিস্তানী মুসলমান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ জিগির তুলে অগ্নিসংযোগ ও লুঠতরাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে।[পৃ.৩৭৮]
বাধ্য হয়ে ২৩ জুন সমগ্র কাছাড় জেলাকেই তিন মাসের জন্য ‘উপদ্রুত এলাকা’ ঘোষণা করতে হয়। তদানীন্দন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও আইনমন্ত্রী খবর পেয়ে অবিলম্বে রথীন সেনসহ কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবর্গকে ১ ও ২ জুলাই দিল্লীতে আলোচনার জন্য ডাকেন।[পৃ.৩৭৯]
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিচিত্র যুক্তিতে আসামের কৃষিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে বলে দেন, “...আমি শ্রী হকের বিরুদ্ধে উল্লিখিত কোনও অভিযোগ গ্রহণেই রাজী নই।" সুকুমারবাবু লিখেছেন, “...অথচ তাঁরই(নেহেরুর) আওতাধীন গোয়েন্দা রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলে।” তাঁর বইটিতে বেশ কিছু গোপন রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে ‘It happened in Hilakandi’ শীর্ষক প্রতিবেদনে স্পষ্ট যে, হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামা পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কাছাড়ের হিন্দু বাঙ্গালীরা গোয়ালপাড়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষপাতী হলেও মুসলিমর বাংলাভাষীরা সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে গোয়ালপাড়াকে আসামেই রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১০ জুন শিলং-এ আয়োজিত মুরুব্বিদের এক গোপন বৈঠকের পর দেখা গেল, কাছাড়ের যে মুসলিম বাংলাভাষীরা বাংলাভাষার প্রবল সমর্থক ছিল, তারা রাতারাতি বাংলাভাষার বিরোধিতা ও অসমীয়াভাষার দালালি শুরু করল। এরপরই হাইলাকান্দি মহকুলায় মুসলিম জনতা ১৯ জুন তারিখ থেকে একত্রিত হয়ে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, গৃহদাহ, লুঠতরাজ, খুন শুরু করল। এই রিপোর্ট অনুযায়ী হাইলাকান্দিতে অন্তত ২০০টি, আলগাপুর, কালাছেড়া, মোনাছেড়া অঞ্চলে ১৫০-র ওপর, শিলচর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে সিভিটাভিসিয়ায় ৮০টি হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগানো হয় “আল্লা হো আকবর”, “পাকিস্তান জ়িন্দাবাদ”, “আসামে থাকতে অসমিয়া শিখতে হবে” স্লোগান সহযোগে, যাতে কমপক্ষে ৩০-৪০ জন আহত হয় [পৃ.৩৮১-৩৮২]। আহতদের কতজন নিহত সেই অনুসন্ধান আর কে করে? বাস থামিয়েও লুঠলাট চলে।!
ইতিমধ্যেই ‘কাছাড় জেলা শান্তি পরিষদ’ গঠিত হয়েছে যার কাজ হল রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতার ভান করে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমগ্র কাছাড়বাসীকে বিশেষত মুসলিমদের খেপিয়ে তোলা। ১৯৬১-র ২রা জুন পরিষদ একটি আবেদন পত্র লিখল, যার মর্মার্থ রাজ্যভাষা বিরোধী আন্দোলন থেকে কাছাড়বাসী বিশেষত সখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ যেন বিরত থাকে। প্রচার করে, সরল সহজ গ্রামবাসীরা নাকি এই অবৈধ আন্দোলনে “নীরব থাকিয়াও সংগ্রামকারীদের ভর্ৎসনা, জোরজুলুম ও ভীতিপ্রদর্শন হইতে মুক্ত হইল না।....পরিষদ ২১/৫/৬১ হইতে সেবাভার গ্রহণ করিয়া করনীয় ব্যবস্থাদি প্রায় সমাপ্ত করিয়াছে।” ঘোষিত উদ্দেশ্যের তালিকায় ছিল আসামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কাছাড়ে অসমীয়া মাধ্যম স্কুল খোলাও।
সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা হিসাবে হিন্দু বাঙ্গালী বসতিতে গুণ্ডামি লুঠতরাজ, আর অন্যদিকে বড়পেটা, করিমগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে হাজার হাজার পাকিস্তানি মুসলিমের অনুপ্রবেশ – দুটোই অ্যাহত ছিল। ২৫ জুন সরকারি সূত্রেই বলা হয়, কেবল বড়পেটা মহকুমার বিভিন্ন গ্রামেই গত ৪/৫ মাসে দশ হাজার পাকিস্তানি মুসলমান অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য, এক পাকিস্তানি মুসলমান ঔরঙ্গাবাদ থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানায় ৪ মাস পূর্বে বিনা পাসপোর্টে ভারতে প্রবেশ করে মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর গৃহে কাজ করছিল! তার মাসুতুতো ভাই আবার হাইলাকান্দি দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করে আহত! [পৃ.৩৮৩]
এর পরেও নেহেরু মইনুলের বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশের সব তথ্য অস্বীকার করে বিবৃতি দেন: “পাকিস্তান লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিকে ভারতে বাস করার জন্য পাঠাইয়াছে এরূপ কোনও তথ্য আমার জানা নাই। কিছু লোক আসিতে পারে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আসিয়াছে বলে আমার মনে হয় না।”[পৃ.৩৮৩]
ইমাদ উদ্দীন বুলবুলের লেখা ‘১৯শে মের ভাষা সংগ্রামে মুসলিম সমাজের ভূমিকা’ প্রবন্ধে আছে, “বরাক উপত্যকায় প্রথম দাঙ্গার দাপট ১৯৫০ সালে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়।” অবশ্য এ’জন্য তিনি অসমীয়া সম্প্রসারণবাদীদের মুসলমান সমাজকে ভুল বুঝিয়ে বাংলাভাষা বিরূপ করে তোলাকে দায়ী করেন। লিখেছেন, ১৯শে মে এগারোটি তাজা লাশ পড়ার পরেও সোনাই অঞ্চলে গোলাম গিলানী চৌধুরী ও প্রাক্তন বিধায়ক পুলকেশী সিংহ আয়োজিত জনসভায় অসমীয়া ভাষাকেই সমর্থন জানানো হয়। ১৯শে মের পর বরাকে শান্তি পরিষদ গঠনের হিড়িক পড়ে যায় এবং বাঙালি হয়েও বরাকের মুসলিমরা জিগির তুলেছিল, “বাংলাভাষা চাই না, অসমীয়া ভাষা চাই”। ১৯ জুন ১৯৬১ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বুলবুলও এজন্য মইনুলকেই দায়ী করেছেন, “বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে প্রমাণ হয় যে, মইনুল হক চৌধুরী নিজের ওপর উপত্যকার জনগণ কর্তৃক ন্যস্ত দায়িত্ব পালন না করে বরং বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন, যার পরিণতিতে আজ বাঙালি মুসলমানদের একাংশের ওপর মাতৃভাষার প্রতি বেইমানিজনিত কলঙ্কের ছাপ রয়ে গেছে।”[পৃ–৬১/১৪৫] এমনকি বাংলাভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরদ্ধেও লাগাতার প্রচার ও মুসলিম সমাজের আক্রমণ চলতে থাকে।[পৃ–৬১/১৪৬]
লেককের আফসোস ১৯৫২-য় ঢাকায় মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বাঙালি শহীদদের খবরটুকুও বরাকে কেউ পৌঁছে দেয়নি। তার জন্য একদিকে যদি ছিল ‘পাকিস্তানের চর’ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়, আর অন্যদিকে ছিল নেতৃত্বস্থানীয় মৌলানাদের নিস্পৃহতা। “ইসলাম ধর্মের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মৌলানারা চিন্তায় ডুবে থাকেন, ঝগড়া করেন, ...কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষার জন্য লড়াই করাও যে একটি বড় কর্তব্য, সেই দিক নির্দেশ সেদিন আলেম সমাজ দিতে পারেননি।”[পৃ-৬১/১৪৭] বস্তুত সেদিন কেন, কোনও দিনই দেয়নি। তবু এই সৎ স্বীকারোক্তির জন্য লেখকের অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, “বাংলা ভাষার প্রশ্নে বরাক উপত্যকার ব্যাপক অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানরা ১৯৬১ সালে যেভাবে বিরুদ্ধাচারণ করেছিল, তার তুলনা ইতিহাসে কোথাও দেখা যাবে না।”[৬১/১৪৮] বরাকের মুসলিমদের মধ্যে এই ‘বাঙালি জাতিসত্তা’র অভাবই সেদিন অসমীয়া সম্প্রসারণবাদীদের সুবিধা করে দিয়েছিল বলে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরিশেষে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ‘অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর আবেগও ব্যক্ত করেছেন। তবে সেই আবেগে বৃহত্তর অখণ্ড ভৌগোলিক বাংলাদেশ গঠনের উচ্চাশা নিহিত কিনা ভাবার বিষয়। বুলবুল সাহেবের আফসোস দেখে মনে হয়, সেই সময় আসামের অবোধ বাংলাভাষী মুসলিমরা হিন্দু বাঙ্গালীদের সঙ্গে ভাষার প্রশ্নে এক হলে একটা অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার ধারণা পোক্ত হতো। ইমাদ উদ্দীন নিজের জাতভাইদের যতই সরলমতী মনে করুন, আমার ধারণা সেই সময় আসামের অনুপ্রবিষ্ট মুসলিমরা ঠাওর করতে পারেনি পূর্ব পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌমত্ব লাভ করবে, তাও আবার ভারতেরই সাহায্য নিয়ে। তখনও তাদের কাছে জিন্নার স্বপ্ন ও তাঁর সাগরেদ মইনুলহক চৌধুরীর নির্দেশিকা অনুযায়ী যেনতেন প্রকারে ইসলামিক পাকিস্তানের সম্প্রসারণটাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই বরাক ও সমগ্র আসামে জনমানচিত্র দেখে ১৯৭১-এ সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘কৃতজ্ঞ’ প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমান বায়না ধরলেন আসামকেও তাঁর চাই। "Without the inclusion of Assam the East Bengal economy could not be balanced"। মরূভূমির উট আর সদাগরের সেই গল্পের মতো। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের মতোই অনুপ্রবেশ নীতিও বজায় রাখল বাংলাদেশ।
১৯৭২-এ তাদের পরিবর্তিত অবস্থান বুলবুলের প্রবন্ধেই ধরা পড়েছে [পৃ ৬১/১৫১]। এই বোধদয় সম্ভবত, সম্ভবত কেন, নিশ্চিত ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল দেখেই। মৌলানা উলেমাদের একটু দূরদৃষ্টি থাকলে ১৯৬১-তেও বাংলাভাষী মুসলমানরা বাংলাভাষার জন্যই লড়ত, যাতে সমগ্র আসাম না হলেও বরাক উপত্যকা ইসলামিক বাংলাদেশের দখলে থাকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেই ভুল শোধরানোর জন্যই আসামে মাতৃভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা অনুপ্রবিষ্ট বাংলাদেশী মুসলমানরা ভারতের নাগরিকপঞ্জী (NRC) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ (CAA) বিরোধী লড়াইয়ে প্রকৃত বাঙ্গালীদেরও পাশে থাকার ভান করছে।
‘আসাম বাণী’ সাপ্তাহিক পত্রিকার ১৮ আগস্ট ১৯৯৪ সংখ্যায় প্রকাশ, ১৯৭১-৯১-এর মধ্যে আসামে অনুপ্রবিষ্ট ১৬ লক্ষ বাংলাদেশীর মধ্যে সিংহভাগ বাঙালি মুসলমান, যারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নিজেদের অসমীয়া বলেই পরিচয় দেয়। তাহলে মুসলিম বঙ্গবাসী বঙ্গভাষীরা বাঙালি জাতিসত্তার দাবিদার হয় কোন সুবাদে? এই সময়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ৪১.৮৯% যেখানে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৭.৪২% -এই কারণে?
ভাষা সংঘাতের সমাধান হিসাবে বরাকে পৃথক বাংলাভাষী রাজ্যের দাবি তুলতে হিন্দু বাঙ্গালীরা ভয় পাচ্ছে এই সাম্প্রদায়িক জনবিন্যাসকেই। একদিকে উগ্র অসমীয়া জাতিসত্তার আঁচ, অন্য দিকে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের আগুন -- দুয়ের মাঝে ঝলসে নির্মূল হয়ে যাওয়াই যেন বাঙ্গালীর ভবিতব্য।
কিন্তু এতশত জটিলতায় কে যায়? তার ধর্মনিরপেক্ষতার ফাটা রেকর্ডে একই বৃন্তে দুটি কুসুমের গান বাজিয়ে আর আসামের বাংলাভাষী মানে ১৯শে মের ট্রাজেডি – এই সরলীকরণ দিয়েই তো সাংস্কৃতিক পর্যটনের পথ খোলা।
১.https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%95_%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%95%E0%A6%BE#cite_note-3
২. সুকুমার বিশ্বাস: “আসামে ভাষা্ন্দোলন ও বাঙালি- প্রসঙ্গ ১৯৪৮-১৯৬১”
৩. ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার (৬১র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে)’, উনিশে মে’র ইতিহাস: সম্পাদনা দিলীপকান্তি লস্কর; লালনমঞ্চ ভা.ব.ভা.স. ইতিহাস
[২০৩৪ শব্দ]
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলাভাষা আন্দোলনে ২১শে ফেব্রুয়ারির পাশাপশি ১৯শে মে তারিখটাও বিগত দশকে আলোচনায় উঠে এসেছে যদিও ঘটনাটা প্রায় ৬০ বছর আগেকার। আব্দুল বরকতদের মতো শহীদ স্মৃতিস্মৃতিস্তম্ভে খোদিত না হলেও ক্রমশ উল্লিখিত হচ্ছে ১৯৬১-র ১৯শে মের ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরোকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদরঞ্জন দাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর; অথবা কদাচিত ১৬ই আগস্ট ১৯৭২-এ করিমগঞ্জে নিহত বিজন চক্রবর্ত্তী কিংবা ২১শে জুলাই করিমগঞ্জে শহিদ জগন্ময় দেব, দিব্যেন্দু দাস, কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস এঁদের নামও। দিনটিকে ‘ভাষা শহীদ দিবস’ রূপে পালন করার প্রস্তাবও উঠেছে।
১৯৩১ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার ১৬ বছর আগের এক গণনায় দেখা তথাকথিত আসামরাজ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল অসমীয়াভাষীর দ্বিগুণ। স্বাধীনতার পরেও তাই স্বাভাবিক ভাবে বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই গেছে। এখন ২০১১-র সর্বেশেষ জনগণনা অনুযায়ী বরাক উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ৪২% হিন্দু, ৫০% মুসলিম, ৪% খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ৪%। কাছাড় জেলায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬০%, কিন্তু করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ – যথাক্রমে ৫৩% ও ৫৮%।[১] পুরো উপত্যকায় মুসলমান বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বরাকের বাংলাভাষা আন্দোলনে তাদের বিস্ময়কর অনুপস্থিতি! কিন্তু তাই নিয়ে কোনও পর্যবেক্ষককেই আমি প্রশ্ন তুলতে দেখিনি। মুসলিমদের তরফে অংশগ্রহণ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সাল থেকে, আর তৎপরতা চোখে পড়ছে ২০১০-এ ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার (NPR) প্রস্তুাবের পর। আমার গল্পটা এখানেই।
পরাধীন ভারতে মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর ১৯০৬ সাল থেকেই প্রথমে নবাব সেলিমুল্লার নির্দেশে, ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে ফাঁকতালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সাইদুল্লার সদিচ্ছায় এবং স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ থেকে কংগ্রেসে এসে ১৯৫৭-য় একেবারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়ে বসা মইদুল হক চৌধুরীর সক্রিয়তায় আসামে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে অবাধে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটে উপত্যকার জনবিন্যাসটাই বদলে দিয়েছে। মাঝে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদোলই ও মইনুলের মন্ত্রীসভারই মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিয়া অনুপ্রবেশে রাশ টানার চেষ্টা করেও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের অসহযোগিতায় সক্ষম হননি। মাঝখান থেকে পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত শরণার্থী স্রোত ও অনুপ্রবেশে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৫৫ সালেই শুরু হয়ে যায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রচারিত ধারণা হল, ঔপনিবেশিক কাল থেকে বাঙ্গালীদের শিক্ষা ও পেশায় অগ্রসরতার ফলে অসমীয়াদের মনে জন্মানো ঈর্ষাবোধের বিস্ফোরণ ছিল ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন, আর তাতে নাকি ইন্ধন জুগিয়েছিল মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা। দেখা যাক ইতিহাস কী বলে।
আসামের ভাষা আন্দোলনে মুসলিমদের আংশগ্রহণ:
১৯৬০ সালে ‘বঙ্গাল খেদা’নো রীতিমতো প্রদেশিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ৪ঠা জুলাই থেকে টানা দশদিনের হিংসায় বাঙ্গালী নরমেদযজ্ঞ শেষে ২৪শে অক্টোবর আসাম বিধানসভায় “একক অসমীয়া ভাষা বিল” পাস হয়ে গেল। বঙ্গভাষীরা না হয় ভেদ্য লক্ষ্য, বিবেচিত হল না বিপুল সংখ্যক পার্বত্য জনজাতির কথাও। অগ্রাহ্য করা হল রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশও (State Recognisation Commission, Report, Pg-211, sec 733, Para 719)।
বাঙ্গালীরা দেখল একতরফা সমঝোতা করেও শান্তিরক্ষার বদলে ক্রমশ তাদের অস্তিত্বই বিলুপ্তির পথে। তাই ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে আহূত হল ‘কাছাড় জেলা সম্মেলন’। সেখানে গৃহীত সংকল্প অনুযায়ী শুরু হল শান্তিপূর্ণ পিকেটিং ও একটানা ‘সত্যাগ্রহ’। সরকার নির্বিকার দেখে ১৯শে মে শিলচর স্টেশনে প্রথম রেল অবরোধ করা হয়। করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতেও সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিসের লাঠিচার্জ, কাটিগড়ায় সত্যাগ্রহীদের গাড়িতে আগুন ইত্যাদি করেও অবরোধ তোলা যায়নি। অতঃপর ২টো ৩৫মিনিটে শিলচর স্টেশনে শুরু হয় পুলিসের গুলিবৃষ্টি। এগারোজন ঘটনাস্থলেই শহীদ। আহত শতাধিক।
সুকুমার বিশ্বাসের লেখা “আসামে ভাষান্দোলন ও বাঙালি- প্রসঙ্গ ১৯৪৮-১৯৬১” গ্রন্থে পাওয়া যায় এর মাস খানেক পর ১৭ জুন বন্দী সত্যাগ্রহীদের জেল থেকে ছাড়া শুরু হয়। তৎসহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ” ও স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় সম্মত হওয়ায় আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত হল। কিন্তু পরিস্থিতি শমিত হয়ে আসার দু’ দিন পরেই ১৯ জুন হাইলাকান্দি শহরের তিন দিক থেকে দশ-পনেরো সহস্র উন্মত্ত জনতা মহকুমা শাসকের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে শহরে ঢুকে একটি মসজিদে নমাজ পড়ার জেদ করে। আইজি হায়দার হোসেনের চাপে মহকুমা শাসক প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পর বাঁধভাঙা নমাজিরা “আল্লা হো আকবর”, “চালিয়া সরকার জিন্দাবাদ”, “অসমীয়া শিখতে হবে” ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে পথের ধারের হিন্দুদের দোকানপাট লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি শুরু করে। মসজিদ থেকেও বেরিয়ে আসে প্রভূত অস্ত্রশস্ত্র। হাইলাকান্দি থেকে ৬ মাইল দক্ষিণে মনাছড়া এলাকাতেও দাঙ্গা ছড়ায় [পৃ.৩৭৩-৩৭৪]।
দাঙ্গার আভাস মে মাস থেকেই পাওয়া গিয়েছিল, যে কথা জেলাশাসক আর.কে. শ্রীবাস্তবও স্বীকার করেন। সংবাদে প্রকাশ, “ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য গত মাসাধিককালব্যাপী বিভিন্নমুখী চেষ্টা গতকাল অর্থাৎ ১৯শে জুন শিলচর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী মহকুমা হাইলাকান্দিতে উচ্ছৃঙ্খল আকার নেয়। জনতা গৃহদাহ, লুঠতরাজ এমন ব্যাপক আকারে আরম্ভ করে যে পুলিশকে দুবার গুলি চালাতে হয়, এবং তার ফলে রাত ৯টা পর্যন্ত অন্তত ৭ জন নিহত ও ৩০/৪০ জন আহত হয়। ....শহরে সন্ধ্যা থেকে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। একই সঙ্গে ১৪৪ ধারাও বলবৎ থাকে।” [পৃ.৩৭৪] তারপরেও সান্ধ্য আইন উল্লঙ্ঘন করে তারা রাতে হিন্দু উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে হামলার ফলে ২০০-র বেশি হিন্দু উদ্বাস্তু গৃহ ভস্মীভূত হয়, খুন হয় বেশ কয়েকজনকে। সরকারি রিপোর্টে অনুযায়ী পুলিস ও দাঙ্গাকারীদের অস্ত্রে ১০ জনের মৃত্যু হয় ও ১৫ জন আহত হয়। “কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর স্বগ্রাম সোনাবাড়িঘাট থেকে আরম্ভ করে শিলচুরী পর্যন্ত মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের ৪/৫ শো দুর্বৃত্ত বন্দুক ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে “আল্লা হো আকবর”, “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে শিলচুরীর সন্নিকটবর্তী পানি ভরা (পিতল বিল) উদ্বাস্তু কলোনী আক্রমণ করে।”[পৃ.৩৭৬]।
পরিস্থিতির চাপে রাজ্যপাল জেনারেল এস এম নাগেশ কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমাকে ‘উপদ্রুত এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা করেন। নামাতে হয় সেনা। পুরো অশান্তির কৃতিত্ব আপামর জনগণ তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীকেই দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক উচ্চাশা পূরণের জন্য কংগ্রেসের মতো অসাম্প্রদায়িক দলের আশ্রয় খুব কাজে লেগেছিল মুইনুলের[পৃ.৩৭৫]। মইনুল শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৯শে জুন হাইলাকান্দি পৌঁছান। কিন্তু তিনি ২০শে জুন হাইলাকান্দি ছাড়া্র দু ঘণ্টার মধ্যে “পকিস্তান জিন্দাবাদ” ধ্বনি সহযোগে চন্দ্রপুর, মোহনপুর, ফণিবোরার সমস্ত হিন্দু বসতি ও শিবির ভস্মীভূত হয়ে যায়। ৭৫০ জনের বেশি গৃহহারা। লুগাগলাচেরা, লালমুখ, বাগবাজার ইত্যাদি চা-বাগানের কোয়ার্টগুলো লুণ্ঠিত হয়। ২২ জুন উদ্ধার হয় ১৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অর্ধকবরস্থ দেহ[পৃ.৩৭৮]।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আশ্বাসে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ আন্দোলন স্থগিত হয়ে নয়াদিল্লীতে আলোচনার সিন্ধান্ত নেওয়ার পরেও যেভাবে দাঙ্গা ছড়িয়েছে, তা “স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তীকালে মুসলিমলিগের কার্যকলাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়...” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছেও সুস্পষ্ট, “মুসলমানদের জন্য সমগ্র আসাম দখল করবার উদ্দেশ্যে হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামাকারীরা মুসলিমলিগপন্থীদের অনুরূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।”[পৃ.৩৭৭]
সংবাদে ফাঁস হল, কাছাড়ে মেহেরপুরে(?) মইনুলের নিকটাত্মীয় জিলানী চৌধুরীর গৃহে মুসলমানদের এক গোপন সভায় ‘কাছাড় কল্যাণ সমিতি’ গঠিত হয়েছে। শিলচর বাজারে হিন্দুদের দোকান বর্জন এবং কাছাড়ের পাকিস্তানভুক্তির সপক্ষে মুসলমানদের পৃথক দোকান ও বাজার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাছাড়ে বসবাসকারী প্রায় এক লক্ষ পূর্বপাকিস্তানী মুসলমান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ জিগির তুলে অগ্নিসংযোগ ও লুঠতরাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে।[পৃ.৩৭৮]
বাধ্য হয়ে ২৩ জুন সমগ্র কাছাড় জেলাকেই তিন মাসের জন্য ‘উপদ্রুত এলাকা’ ঘোষণা করতে হয়। তদানীন্দন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও আইনমন্ত্রী খবর পেয়ে অবিলম্বে রথীন সেনসহ কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবর্গকে ১ ও ২ জুলাই দিল্লীতে আলোচনার জন্য ডাকেন।[পৃ.৩৭৯]
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিচিত্র যুক্তিতে আসামের কৃষিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে বলে দেন, “...আমি শ্রী হকের বিরুদ্ধে উল্লিখিত কোনও অভিযোগ গ্রহণেই রাজী নই।" সুকুমারবাবু লিখেছেন, “...অথচ তাঁরই(নেহেরুর) আওতাধীন গোয়েন্দা রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলে।” তাঁর বইটিতে বেশ কিছু গোপন রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে ‘It happened in Hilakandi’ শীর্ষক প্রতিবেদনে স্পষ্ট যে, হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামা পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কাছাড়ের হিন্দু বাঙ্গালীরা গোয়ালপাড়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষপাতী হলেও মুসলিমর বাংলাভাষীরা সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে গোয়ালপাড়াকে আসামেই রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১০ জুন শিলং-এ আয়োজিত মুরুব্বিদের এক গোপন বৈঠকের পর দেখা গেল, কাছাড়ের যে মুসলিম বাংলাভাষীরা বাংলাভাষার প্রবল সমর্থক ছিল, তারা রাতারাতি বাংলাভাষার বিরোধিতা ও অসমীয়াভাষার দালালি শুরু করল। এরপরই হাইলাকান্দি মহকুলায় মুসলিম জনতা ১৯ জুন তারিখ থেকে একত্রিত হয়ে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, গৃহদাহ, লুঠতরাজ, খুন শুরু করল। এই রিপোর্ট অনুযায়ী হাইলাকান্দিতে অন্তত ২০০টি, আলগাপুর, কালাছেড়া, মোনাছেড়া অঞ্চলে ১৫০-র ওপর, শিলচর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে সিভিটাভিসিয়ায় ৮০টি হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগানো হয় “আল্লা হো আকবর”, “পাকিস্তান জ়িন্দাবাদ”, “আসামে থাকতে অসমিয়া শিখতে হবে” স্লোগান সহযোগে, যাতে কমপক্ষে ৩০-৪০ জন আহত হয় [পৃ.৩৮১-৩৮২]। আহতদের কতজন নিহত সেই অনুসন্ধান আর কে করে? বাস থামিয়েও লুঠলাট চলে।!
ইতিমধ্যেই ‘কাছাড় জেলা শান্তি পরিষদ’ গঠিত হয়েছে যার কাজ হল রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতার ভান করে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমগ্র কাছাড়বাসীকে বিশেষত মুসলিমদের খেপিয়ে তোলা। ১৯৬১-র ২রা জুন পরিষদ একটি আবেদন পত্র লিখল, যার মর্মার্থ রাজ্যভাষা বিরোধী আন্দোলন থেকে কাছাড়বাসী বিশেষত সখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ যেন বিরত থাকে। প্রচার করে, সরল সহজ গ্রামবাসীরা নাকি এই অবৈধ আন্দোলনে “নীরব থাকিয়াও সংগ্রামকারীদের ভর্ৎসনা, জোরজুলুম ও ভীতিপ্রদর্শন হইতে মুক্ত হইল না।....পরিষদ ২১/৫/৬১ হইতে সেবাভার গ্রহণ করিয়া করনীয় ব্যবস্থাদি প্রায় সমাপ্ত করিয়াছে।” ঘোষিত উদ্দেশ্যের তালিকায় ছিল আসামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কাছাড়ে অসমীয়া মাধ্যম স্কুল খোলাও।
সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা হিসাবে হিন্দু বাঙ্গালী বসতিতে গুণ্ডামি লুঠতরাজ, আর অন্যদিকে বড়পেটা, করিমগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে হাজার হাজার পাকিস্তানি মুসলিমের অনুপ্রবেশ – দুটোই অ্যাহত ছিল। ২৫ জুন সরকারি সূত্রেই বলা হয়, কেবল বড়পেটা মহকুমার বিভিন্ন গ্রামেই গত ৪/৫ মাসে দশ হাজার পাকিস্তানি মুসলমান অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য, এক পাকিস্তানি মুসলমান ঔরঙ্গাবাদ থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানায় ৪ মাস পূর্বে বিনা পাসপোর্টে ভারতে প্রবেশ করে মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর গৃহে কাজ করছিল! তার মাসুতুতো ভাই আবার হাইলাকান্দি দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করে আহত! [পৃ.৩৮৩]
এর পরেও নেহেরু মইনুলের বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশের সব তথ্য অস্বীকার করে বিবৃতি দেন: “পাকিস্তান লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিকে ভারতে বাস করার জন্য পাঠাইয়াছে এরূপ কোনও তথ্য আমার জানা নাই। কিছু লোক আসিতে পারে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আসিয়াছে বলে আমার মনে হয় না।”[পৃ.৩৮৩]
ইমাদ উদ্দীন বুলবুলের লেখা ‘১৯শে মের ভাষা সংগ্রামে মুসলিম সমাজের ভূমিকা’ প্রবন্ধে আছে, “বরাক উপত্যকায় প্রথম দাঙ্গার দাপট ১৯৫০ সালে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়।” অবশ্য এ’জন্য তিনি অসমীয়া সম্প্রসারণবাদীদের মুসলমান সমাজকে ভুল বুঝিয়ে বাংলাভাষা বিরূপ করে তোলাকে দায়ী করেন। লিখেছেন, ১৯শে মে এগারোটি তাজা লাশ পড়ার পরেও সোনাই অঞ্চলে গোলাম গিলানী চৌধুরী ও প্রাক্তন বিধায়ক পুলকেশী সিংহ আয়োজিত জনসভায় অসমীয়া ভাষাকেই সমর্থন জানানো হয়। ১৯শে মের পর বরাকে শান্তি পরিষদ গঠনের হিড়িক পড়ে যায় এবং বাঙালি হয়েও বরাকের মুসলিমরা জিগির তুলেছিল, “বাংলাভাষা চাই না, অসমীয়া ভাষা চাই”। ১৯ জুন ১৯৬১ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বুলবুলও এজন্য মইনুলকেই দায়ী করেছেন, “বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে প্রমাণ হয় যে, মইনুল হক চৌধুরী নিজের ওপর উপত্যকার জনগণ কর্তৃক ন্যস্ত দায়িত্ব পালন না করে বরং বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন, যার পরিণতিতে আজ বাঙালি মুসলমানদের একাংশের ওপর মাতৃভাষার প্রতি বেইমানিজনিত কলঙ্কের ছাপ রয়ে গেছে।”[পৃ–৬১/১৪৫] এমনকি বাংলাভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরদ্ধেও লাগাতার প্রচার ও মুসলিম সমাজের আক্রমণ চলতে থাকে।[পৃ–৬১/১৪৬]
লেককের আফসোস ১৯৫২-য় ঢাকায় মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বাঙালি শহীদদের খবরটুকুও বরাকে কেউ পৌঁছে দেয়নি। তার জন্য একদিকে যদি ছিল ‘পাকিস্তানের চর’ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়, আর অন্যদিকে ছিল নেতৃত্বস্থানীয় মৌলানাদের নিস্পৃহতা। “ইসলাম ধর্মের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মৌলানারা চিন্তায় ডুবে থাকেন, ঝগড়া করেন, ...কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষার জন্য লড়াই করাও যে একটি বড় কর্তব্য, সেই দিক নির্দেশ সেদিন আলেম সমাজ দিতে পারেননি।”[পৃ-৬১/১৪৭] বস্তুত সেদিন কেন, কোনও দিনই দেয়নি। তবু এই সৎ স্বীকারোক্তির জন্য লেখকের অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, “বাংলা ভাষার প্রশ্নে বরাক উপত্যকার ব্যাপক অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানরা ১৯৬১ সালে যেভাবে বিরুদ্ধাচারণ করেছিল, তার তুলনা ইতিহাসে কোথাও দেখা যাবে না।”[৬১/১৪৮] বরাকের মুসলিমদের মধ্যে এই ‘বাঙালি জাতিসত্তা’র অভাবই সেদিন অসমীয়া সম্প্রসারণবাদীদের সুবিধা করে দিয়েছিল বলে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরিশেষে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ‘অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর আবেগও ব্যক্ত করেছেন। তবে সেই আবেগে বৃহত্তর অখণ্ড ভৌগোলিক বাংলাদেশ গঠনের উচ্চাশা নিহিত কিনা ভাবার বিষয়। বুলবুল সাহেবের আফসোস দেখে মনে হয়, সেই সময় আসামের অবোধ বাংলাভাষী মুসলিমরা হিন্দু বাঙ্গালীদের সঙ্গে ভাষার প্রশ্নে এক হলে একটা অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার ধারণা পোক্ত হতো। ইমাদ উদ্দীন নিজের জাতভাইদের যতই সরলমতী মনে করুন, আমার ধারণা সেই সময় আসামের অনুপ্রবিষ্ট মুসলিমরা ঠাওর করতে পারেনি পূর্ব পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌমত্ব লাভ করবে, তাও আবার ভারতেরই সাহায্য নিয়ে। তখনও তাদের কাছে জিন্নার স্বপ্ন ও তাঁর সাগরেদ মইনুলহক চৌধুরীর নির্দেশিকা অনুযায়ী যেনতেন প্রকারে ইসলামিক পাকিস্তানের সম্প্রসারণটাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই বরাক ও সমগ্র আসামে জনমানচিত্র দেখে ১৯৭১-এ সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘কৃতজ্ঞ’ প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমান বায়না ধরলেন আসামকেও তাঁর চাই। "Without the inclusion of Assam the East Bengal economy could not be balanced"। মরূভূমির উট আর সদাগরের সেই গল্পের মতো। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের মতোই অনুপ্রবেশ নীতিও বজায় রাখল বাংলাদেশ।
১৯৭২-এ তাদের পরিবর্তিত অবস্থান বুলবুলের প্রবন্ধেই ধরা পড়েছে [পৃ ৬১/১৫১]। এই বোধদয় সম্ভবত, সম্ভবত কেন, নিশ্চিত ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল দেখেই। মৌলানা উলেমাদের একটু দূরদৃষ্টি থাকলে ১৯৬১-তেও বাংলাভাষী মুসলমানরা বাংলাভাষার জন্যই লড়ত, যাতে সমগ্র আসাম না হলেও বরাক উপত্যকা ইসলামিক বাংলাদেশের দখলে থাকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেই ভুল শোধরানোর জন্যই আসামে মাতৃভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা অনুপ্রবিষ্ট বাংলাদেশী মুসলমানরা ভারতের নাগরিকপঞ্জী (NRC) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ (CAA) বিরোধী লড়াইয়ে প্রকৃত বাঙ্গালীদেরও পাশে থাকার ভান করছে।
‘আসাম বাণী’ সাপ্তাহিক পত্রিকার ১৮ আগস্ট ১৯৯৪ সংখ্যায় প্রকাশ, ১৯৭১-৯১-এর মধ্যে আসামে অনুপ্রবিষ্ট ১৬ লক্ষ বাংলাদেশীর মধ্যে সিংহভাগ বাঙালি মুসলমান, যারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নিজেদের অসমীয়া বলেই পরিচয় দেয়। তাহলে মুসলিম বঙ্গবাসী বঙ্গভাষীরা বাঙালি জাতিসত্তার দাবিদার হয় কোন সুবাদে? এই সময়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ৪১.৮৯% যেখানে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৭.৪২% -এই কারণে?
ভাষা সংঘাতের সমাধান হিসাবে বরাকে পৃথক বাংলাভাষী রাজ্যের দাবি তুলতে হিন্দু বাঙ্গালীরা ভয় পাচ্ছে এই সাম্প্রদায়িক জনবিন্যাসকেই। একদিকে উগ্র অসমীয়া জাতিসত্তার আঁচ, অন্য দিকে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের আগুন -- দুয়ের মাঝে ঝলসে নির্মূল হয়ে যাওয়াই যেন বাঙ্গালীর ভবিতব্য।
কিন্তু এতশত জটিলতায় কে যায়? তার ধর্মনিরপেক্ষতার ফাটা রেকর্ডে একই বৃন্তে দুটি কুসুমের গান বাজিয়ে আর আসামের বাংলাভাষী মানে ১৯শে মের ট্রাজেডি – এই সরলীকরণ দিয়েই তো সাংস্কৃতিক পর্যটনের পথ খোলা।
১.https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%95_%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%95%E0%A6%BE#cite_note-3
২. সুকুমার বিশ্বাস: “আসামে ভাষা্ন্দোলন ও বাঙালি- প্রসঙ্গ ১৯৪৮-১৯৬১”
৩. ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার (৬১র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে)’, উনিশে মে’র ইতিহাস: সম্পাদনা দিলীপকান্তি লস্কর; লালনমঞ্চ ভা.ব.ভা.স. ইতিহাস
[২০৩৪ শব্দ]
About
ESSAYS AND FEATURES