ভারতে অভিন্ন আইনের অদৃষ্ট: প্রসঙ্গ তিন তালাক



ভারতে অভিন্ন আইনের অদৃষ্ট:
প্রসঙ্গ তিন তালাক



শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়






Bharate Abhinno Ainer Adristo: Prasango Tin Talaq (Assessing the Fate of Uniform Civil Code in India: Context Triple Talaq)
by
Sriparna Bandyopadhyay

প্রথম প্রকাশ
১৪২ (ইং ২০১)

ISBN: 978-93-5311-322-3

কপিরাইট
লেখিকা কর্তৃক সংরক্ষিত

প্রচ্ছদ
প্রবীর মজুমদার
বর্ণসংস্থাপন ও অলঙ্করণ
প্রবীর মজুমদার ও শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
(ব্যবহৃত সমস্ত আলোকচিত্র ও কিছু চিত্র বা অংশবিশেষ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

প্রকাশক
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
ফ্ল্যাট- ৩এ, জগদীশ অ্যাপার্টমেন্ট, ২৬ জীবনকৃষ্ণ চ্যাটার্জী রোড,
পোস্ট: সোদপুর, কলকাতা-১১০,
চলভাষ: ৯০০৭৫১১৪৫৭, ইমেইল: sriparna405@gmail.com


মূল্য: ১৫০ টাকা


উৎসর্গ

ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাকে
















লেখিকার অন্যান্য বই

এবং আবহমান (কবিতা)
এনট্রপি (কবিতা)
বাঘের মাসি ও সাঙ্গ-পাঙ্গ (ছোটদের গল্প)
অণু-কল্প (অণুগল্প):
আগাছা (ছোটগল্প)
শুভমস্তু (কবিতা)
ক্ষণিক আবর্তে (কবিতা)
ছুটি (ছোটগল্প)
সত্য সেলুকাস: ফিচার সংগ্রহ


সূচিপত্র

অবতারণা
সূত্রপাত
তালাকের প্রকারভেদ ও ভারতীয় প্রেক্ষিত
ভারতে শরিয়তি ঐতিহ্য ও ইসলামি আইনের বিবর্তন
১১
ইসলামি আইন সংশোধন: মুসলিম বিশ্ব বনাম ভারত
২০
প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ: শাহবানু মামলা
৩২
দেওবন্দ্ ফতোয়া: এক ঐতিহাসিক ব্যতিক্রম
৪৩
তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও হালালা বিরোধী আন্দোলন ও চাপান উতোর
৪৮
নেপথ্যের মামলা ও তাৎক্ষণিক তিন তালাকে নিষেধাজ্ঞা
৬১
তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকারী বিল নিয়ে অচলাবস্থা ও অভিন্ন দেওয়ানি আইনের অদৃষ্ট
৬৫
১০
অভিন্ন আইন ও ভারতীয় সংবিধান
৭০
১১
প্রসঙ্গত
তথ্যসূত্র ও নির্দেশিকা
৭৮






“I personally do not understand why religion should be given this vast, expansive jurisdiction so as to cover the whole of life and to prevent the legislature from encroaching upon that field.”

Dr. B. R. Ambedkar



“ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা বুঝতে পারি না, ধর্মকে কেন এতটা বিশাল দুর্মুল্য এক্তিয়ার দেওয়া হবে যাতে মানুষের পুরো জীবন তার আওতায় চলে যায়, যেখানে আইনেরও হস্তক্ষেপ চলে না।”

ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর




অবতারণা

কতগুলো শব্দ ছোটবেলা থেকে বই অথবা কাগজে যেমন পড়েছি তেমনভাবেই গ্রহণ করেছি, মেনে নিয়েছি। সংখ্যালঘু তেমনই একটি শব্দ। কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতি সংবেদনশীলতা ছিল খুব ছোট থেকেই; আর সেই ব্যাপারে লঘু-গুরুর ফারাকবোধ রপ্ত হয়নি কোনও দিনই।
মেয়েদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও বৈবাহিক অপরাধগুলো হয় সচরাচর ধর্মের দোহাই দিয়ে। সহনসীমার মধ্যে থাকলে অনেক অন্যায় বঞ্চনা অবমাননা আমরা মেনে নিতেই অভ্যস্ত। কিন্তু মেনে নেওয়ার এই অভ্যাস থেকেই প্রশ্রয় পায় নৃশংসতম হিংস্রতা যার ধারাবাহিকতা প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই। হিন্দু পরিবারে জন্মের কারণে হিন্দু রীতিনীতি সম্পর্কে যতটা পরিচিত অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে স্বভাবতই ধারণা ততটাই পল্লবগ্রাহী। তাছাড়া হিন্দু শাস্ত্র আচার প্রথা বিশ্বাস ইত্যাদির সমালোচনা বা প্রতিবাদ করা ভারত উপমহাদেশে যতখানি নিরাপদ, তথাকথিত সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণ বা প্রথার বিরুদ্ধে মুখ খোলা ততটাই বিপজ্জনক। মুহূর্তে প্রগতিশীল থেকে প্রতিক্রিয়াশীল, মুক্তমনা থেকে সাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী থেকে মনুবাদী হিসাবে চিহ্নিত হতে হয়।
১৯৮৬-তে যখন শাহবানু মামলার শুনানি ও মুসলিম মহিলা বিল নিয়ে দেশ উত্তাল তখন স্কুলে পড়তাম, খুব তলিয়ে ভাবিনি। ক্রমশ নারীবাদ, মানবতাবাদ এসবের পাশাপাশি মৌলবাদ সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে দেখলাম নিজের অনেক বক্তব্য আছে, কর্তব্যও আছে। কিন্তু বক্তব্যগুলো প্রকাশ করতে গিয়েই রীতিমতো কালঘাম ছোটাতে হয়েছে মূলত আমাদের দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নামক মুখোশটির জেরে
২০১১-র ডিসেম্বরে Forum of Empowerment of Women (FEW) in India দ্বারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা সভাগৃহে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত হিসাবে হাজির ছিলাম, যার মুখ্য বিষয় ছিল “ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের অধিকার: আজকের পরিপ্রেক্ষিতে” আসলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কবি শঙ্খ ঘোষ সহ কিছু বিশিষ্টজনকে যেখানে উপস্থিতির সৌজন্যে ফাঁকতালে আমিও ডাক পাই। বিশিষ্টরা কেউ যেতে না পারলেও আমি আমার অবিশিষ্ট মাথা ঘামানোর জন্য ছুটে গিয়েছিলাম এবং শেষ অব্দি ছিলাম। 
যদিও সংগঠনটির সঙ্গে পরে আর যোগাযোগ রাখা যায়নি, তবে দেশ-বিদেশের পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা আমাকে ধারাবাহিকভাবে মুসলিম মহিলাদের লড়াইয়ের এক নেপথ্য পর্যবেক্ষক ও সমর্থকের ভূমিকায় ধরে রেখেছে। যদিও নেতৃস্থানীয় মুসলিম মহিলারা আমার সমর্থন চাইলেও লেখালিখির মাধ্যমে পরোক্ষ অংশগ্রহণের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি, হয়তো ধর্ম নিয়ে স্পর্শকাতরতার কারণেই মনে করেছেন অনধিকার চর্চা, তবু দেশের একজন নাগরিক ও নারী হিসাবে নিজের তাগিদেই কলম নিয়ে তাদের পাশে থেকেছি।
তবে ২০১৭-র আগস্টে সুপ্রীম কোর্টের তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকারী ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা ও ডিসেম্বর মাসে সংসদে সেই সংক্রান্ত বিল পেশের আগে লেখার ঠিকমতো উপাদান ও ভরসা কোনওটাই পাচ্ছিলাম না। সমাধানসূত্র এখনও মেলেনিতবু অমীমাংসিত সমস্যাটার সম্যক পর্যালোচনা করার এটাই যথার্থ সময় মনে হল। সেই তাগিদ থেকেই এই গ্রন্থনা


                                       

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বিতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে

তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী Womens’ Prtection of Rights on Marriage Bill প্রথমে ২০১৭-র ২৮ ডিসেম্বর সংসদের লোকসভায় পাস হলেও পরে রাজ্যসভায় গতিরুদ্ধ হয়। এর আট মাস পরে ৯ আগস্ট ২০১৮-য় কিছু সংশোধনসহ বিলটি পুনরায় পেশ করা হয়। প্রবল বিরোধিতার জেরে সেবারেও বিলটি রাজ্যসভায় পাস করানো না গেলেও ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮-য় বিলটির ওপর একটি নির্বাহী আজ্ঞা বা অর্ডিন্যান্স জারি হয়। অতঃপর ৩০ জুলাই ২০১৯ লোকসভার পর রাজ্যসভাতেও উত্তীর্ণ হল তিন তালাক বিল। অবসান হল দীর্ঘ টানাপোড়েনের। এবার পালা সামনে তাকানোর যদিও অভিন্ন আইনের পথ এখনই তৈরি হল কিনা সেই অনুমানে যাচ্ছি না।
বছর খানেক আগে শুরু করা ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা সম্পূর্ণ করতেই দ্বিতীয় সংস্করণের অবতারণা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের পারিবারিক আইনের সংশ্লিষ্ট অংশ বিশদে অন্তর্ভুক্ত করেছি। তাছাড়া পাঠক মহলে বেশি করে উপলব্ধ করানোর দায় তো ছিলই।


                                        শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়







সূত্রপাত

অনিচ্ছুক সঙ্গীর সঙ্গে জোর করে জীবন কাটানো নিশ্চই খুব কাঙ্খিত ব্যাপার নয়, কিন্তু সম্পর্ক যখন একটি সামাজিক চুক্তি, দায় দায়িত্বহীন সহবাস নয় এবং তার জেরে যখন নতুন জীবন ও দায়িত্বের জন্ম হয়, তখন ইচ্ছা অনিচ্ছাটা শুধু খামখেয়ালের বশে চলতে পারে না, কিছু কার্য-কারণ সামঞ্জস্য ও দায়বদ্ধতাও থেকে যায়আর এই সম্পর্ক, সহবাস, ইচ্ছা, অনিচ্ছা— কোথাও যখন নারীর মতামতের জায়গা নেই, আছে শুধু প্রকৃতিদত্ত শারীরিক অসুবিধা, সন্তানধারণের একক যন্ত্রণা ও সামাজিক অনিরাপত্তা, তখন মনের অন্তস্ল বিচ্ছেদ চাইলেও বাইরের শ্বাপদসঙ্কুলতা তাকে নির্লজ্জের মতো সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য ব্যাকুল হতে বাধ্য করে।
২০১১-র ডিসেম্বরে Forum of Empowerment of Women (FEW) in India কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা সভাগৃহে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে যার  মুখ্য বিষয় ছিল “Rights of Indian Muslim Women: Today’s perspective” অর্থাৎ আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় মুসলিম মেয়েদের অধিকার আমন্ত্রিত ছিলাম শ্রোতা হিসাবে নৈতিক সমর্থন দিতে। মূলত তিন তালাক ও বহুবিবাহের সমস্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কাছে তাদের দাবি ছিল ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’-র বেশ কিছু সংশোধন ঠিক অভিন্ন ‘দেওয়ানি আইন’-এর কথা সোচ্চার না থাকলেও মুসলিম নারী পুরুষদের জন্য অভিন্ন আইনের দাবি অবশ্যই ছিল। তাদের দাবি সনদে ছিল:
১. তালাক দেওয়ার সম-অধিকার (নারী-পুরুষের) থাকবে এবং তালাক হবে আদালতের মাধ্যমে।
২. একাধিক স্ত্রী (বহু বিবাহ) নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. উত্তরাধিকার সম্পত্তির ওপর পুত্র কন্যাকে সমান অধিকার দিতে হবে।
৪. দত্তক আইন চালু করতে হবে।
৫. নির্যাতিতা, তালাকপ্রাপ্তা, স্বামীপরিত্যক্তা ও বিধবা মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য প্রকল্প চালু করতে হবে।
আমন্ত্রিত ছিলেন বহু তথাকথিত শিক্ষিত বা বলা যায় বুদ্ধিজীবী মুসলমান পুরুষ— সাংবাদিক, সাহিত্যিক, পত্রিকা সম্পাদক, প্রকাশক ইত্যাদি এঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ বিচিত্র। একজন তো মানতেই চাইলেন না এমন কোনও দাবি দাওয়া থাকতে পারে বলে বা থাকলেও তাতে কর্ণপাত করা উচি। আর একজন  হজরত মহম্মদের কাছে স্বামীসংসর্গ বঞ্চিতা নারীর অভিযোগের কাহিনী ইনিয়ে বিনিয়ে অনাবশ্যক দীর্ঘ করে শুনিয়ে কী সাব্যস্ত করতে চাইলেন সেটাই পরিষ্কার হল না। নারীর মঙ্গল ও নিরাপত্তার জন্যই নাকি তাকে যখন তখন তালাক দেওয়া এবং একাধিক বিয়ে করা যেতে পারে এটা প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করে ক্ষান্ত হলেন। বোধহয় বলতে গিয়ে নিজেই টের পাচ্ছিলেন, পুরুষের যখন তখন তালাক দেওয়াটা কোনও সমস্যা নয়, কিন্তু পুরুষের আশ্রয় ও সান্নিধ্য লাভ করতে না পারাটা নারীর পক্ষে অবশ্যই সমস্যাএই দুটো সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতির সমন্বয় সাধন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। প্রায় কেউ মানলেন না, পুরুষের বহুবিবাহ বা একতরফা তালাকের অধিকারে কোনও সমস‍্যা থাকতে পারে। ন্যূনতম চক্ষুলজ্জার খাতিরে জনৈক বুদ্ধিজীবী পুরুষ যদিও বা সমস্যার কথা স্বীকার করলেন, তার সমাধানের সম্ভাবনাকে কিছুতেই আমল দিলেন না।
বলা বাহুল্য, কেউই প্রকারান্তরে এই কথা মানতে চাইলেন না যে, একই দেশের নাগরিকদের জন্য ফৌজদারি আইন যখন অনুরূপ, তখন দেওয়ানি আইনটাও বৈষম্যহীন হওয়া উচি। আর হিন্দুদের জন্য আইন প্রণয়ন কালে যেখানে শংকরাচার্য বা মনুর বিধান অনুসরণ করা হয়নি, খ্রীস্টানদের জন্যও বাইবেলকে আইনের ওপর ঠাঁই দেওয়া হয়নি, হয়েছে যথাসম্ভব যুগোপযোগী দৃষ্টিকোণ ও সংবিধানকে, সেখানে একটি বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের জন্য কেন শরিয়তি খবরদারি বলবৎ থাকবে, সেই প্রশ্ন তো উত্থাপিতই হয়নি পরবর্তী পর্যায়ে এই নিয়ে লেখালিখি করতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখলাম, তুলনা স্বরূপ সতীদাহ রদের প্রসঙ্গ তোলায় সেটাকেও স্বাগত জানাতে তাঁদের যথেষ্ট কুণ্ঠা। এমনকি প্রথাটি যে বর্বর ছিল, সে ব্যাপারেও নাকি মন্তব্য করা অনুচিত, কারণ উচি কিনা সেটা ঠিক করবে হিন্দু পুরুষবর্গ। আলোচ্য সম্প্রদায়ের তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষরা নিজেরা কী ধরণের স্বাধীনতা চাইছেন তা খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেদিন
ভারি অবাক হয়েছিলাম তখন। বুঝতে পেরেছিলাম আফ্রোজা খাতুনরা (ফিউ ইন্ডিয়ার সম্পাদিকা) সভাগৃহ অলংকৃত করার জন্য কয়েকজন মুসলিম পুরুষকে সাজিয়ে রাখতে সমর্থ হলেও তাঁদের পথটা অপরিমেয় দীর্ঘ, বন্ধুর। কারণ এদেশের ব্যালট গণতন্ত্র তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরুষদের এবং পুরুষতান্ত্রিক মৌলবাদের তোষামোদিকেই রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও ভিত্তি বানিয়ে রেখেছে। মুসলিম মেয়েরা সম্ভবত সেই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারপরেও দুরাশা জন্মেছিল, হিন্দু মেয়েদের আংশিক মুক্তি কিছু যুগপুরুষের হাত ধরে আসায় তারা এখনও যেমন পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক রয়ে গেছে, ওদের বেলায় বুঝি তা হবে না, কারণ তারা নিজেরাই দাবি আদায়ের পথে নেমেছে
তারপর গঙ্গা-পদ্মা-সিন্ধু দিয়ে আরও অনেক জল ও জলের মতো রক্ত বয়ে গেছে। তালিবানদের টেক্কা দিয়ে ধর্মরক্ষা ও ধর্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে মহতী আইএসআইএস। কাঁধ ও হাত অবশ্য শুধু হাতিয়ারের দায়িত্বে, ধর্ম পালনের মহত্তম দায়িত্বটা তাদের লিঙ্গই পালন করে। যে কোনও নারী এমনকি অবৈধ হলে নিজের কন্যাকেও বিবাহ ও ভোগ দখল করা মুসলমান পুরুষের ইসলাম অনুমত অধিকার এবং অমুসলিম নারীকে ভোগ, ধর্ষণ, অত্যাচার ও হত্যা করা তাদের ইসলাম প্রদত্ত কর্তব্য বলে দিকে দিকে ঘোষিত হয়েছে। যাঁরা ঘোষণা করেছেন তাঁরা সবাই তালিবান, আইসিস বা সন্ত্রাসী নন তাঁরা কেউ আইনজীবী, অধ্যাপক এমনকি অধ্যাপিকাও
মিশরের কায়রোর বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামপন্থী অধ্যাপিকা সুয়াদ সালেহ এক টেলিভিশনে সাক্ষাত্কারে দাবি করেন, আল্লাহ মুসলিম পুরুষদের অমুসলিম নারীদের লজ্জা দেওয়ার জন্য ধর্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন সংবাদমাধ্যম দি ইনকুইজ়িটর (The Inquisitor) মারফত সংবাদটি সংগ্রহ করেছে ‘জ়ি নিউজসুদাহ সালেহ-র আরও দাবি আল্লাহ স্বয়ং মুসলমান পুরুদের যৌনদাসীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পথ খোলা রেখেছেনতাই এটা ইসলামি বিধানসম্মত তবে তাঁর মতে কেবল মুসলিম ও তাদের শত্রুদের মধ্যে বিবাদ বা যুদ্ধের সময় যৌনাচারের খাতিরে শত্রুপক্ষের নারীদের দাসী করা যেতে পারে শত্রুর উদাহরণ হিসেবে অধ্যাপিকা ইসরায়েলের নাম করে বলেন, ইসরায়েলি নারীদের যৌনদাসী বানানো এবং ধর্ষণ করা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য অন্যদিকে মিশরের এক সালাফি মতাদর্শী ধর্মীয় নেতা মাজেন-আল-সারসই আবার দাবি করেছেন নিজের ঔরসজাত কন্যা যদি অবৈধ হয়, তাকেও বিবাহ ও ভোগ করা নাকি ইসলাম অনুমত যেহেতু সে উক্ত পুরুষটির পিতৃপরিচয় পায়নি, তার প্রতি বাপের কোনও দায়ও নেইবক্তার মতে এই বিধানের সূত্র ইমাম আল শাফেয়ী প্রণীত নীতিমালা। নিজের কন্যাকে বিয়ে করা এই দুটির মধ্যে কোনটিকে অধিকতর চমকপ্রদ বলব – কোনও নারীর তাও আবার শিক্ষয়িত্রীর ধর্ষণের হয়ে সাফাই গাওয়াকে, নাকি নারীকে ভোগ দখলের ফন্দি ফিকির বার করতে সমস্ত সম্পর্কের আগল খোলার বিধানকে, ভেবে পাই না। দিকে দিকে ধর্মপ্রাণরা পুরুষের যথেচ্ছ বিকৃতকামকে ধর্ম বলে চালানোর যে তুমুল আয়োজন করছে এবং সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে তা নিমেষে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে ভারতীয় পিতৃতন্ত্রে জারিত মুসলিমরা (বলা বাহুল্য পুরুষরা) আর বেশি কী চেয়েছে?





তালাকের প্রকারভেদ
ও ভারতীয় প্রেক্ষিত

‘তালাক’ শব্দটি আরবি যার অর্থ ভেঙে ফেলা, ছিন্ন করা বা ত্যাগ করা। মুসলিম আইনে তালাক স্বামী-স্ত্রী দুজনে একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। যদি বিবাহিত জুটির উভয়ের বা কোনও একজনের পক্ষে একত্রবাস  সম্ভব না হয়, তাহলে তারা দু’জনেই কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে, যার একটি হল তালাক। অর্থাৎ তালা হল ইসলামিক আইনানুসারে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করার একটি পদ্ধতি যাতে স্বামীদেরই একচ্ছত্রাধিকার। তবে তালাক ছাড়াও বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। দেখা যাক কতরকম।
তালাক (Talaq): স্বামীর দেওয়া বিবাহবিচ্ছেদ
খুলা ( Khula): পারস্পরিক সমঝোতায় সম্পর্কের ইতি। ভারতে এটি মেয়েদের চাওয়া বিবাহবিচ্ছেদ।
তালাক-এ-মুবারা (Talaq-e-Mubara): পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বিচ্ছেদ।
ফকশ্‌-এ-নিকাহ্‌(Faskh-e-Nikah): বিবাহ বাতিল (dissolution)
তাফউইদ-এ-তালাক (Tafweedh-e-Talaq): স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার প্রদান করায় স্ত্রীর দেওয়া বা নেওয়া বিচ্ছেদ] এটি ‘তালাক-এ-তাফউইজ়’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে এটি ‘তালাক-এ-তৌফিজ’ নামে উল্লিখিত।
অর্থাৎ স্ত্রীদেরও বিচ্ছেদ দেওয়া বা নেওয়ার অধিকার আছে। তবে তা অনেক বেশি শর্তসাপেক্ষ, যা সময় ও রাষ্ট্র ভেদে পরিবর্তিত হতে থেকেছে। আর ভারতে তো আইনে থাকলেও স্বীকারই করা হয় না।
এখন দেখা যাক তালাকের কোন কোন প্রকারভেদ প্রচলিত। ‘আসান’ বা সর্বোৎকৃষ্ট তালাক পদ্ধতি একমাত্র ‘তুহর’ বা স্ত্রী ঋতুমতী নয় এমন অবস্থায় দেওয়া যায়। একবার ‘তালাক’ দেওয়ার এক মাস পরে দ্বিতীয় বার এবং তারও একমাস পরে তৃতীয় বার তালাক দিলে বিচ্ছেদ পাকাপোক্ত হয় যা অপ্রত্যাহারযোগ্যকিন্তু এই তিন চান্দ্রমাস সময় হল ‘ইদ্দত’-এর সময় যার মধ্যে পতিদেবের মনমর্জি বদলালে তালাক ফিরিয়ে নিতে পারে। এই তালাকের সুবিধা বা উদারতা হল বিচ্ছিন্ন জুটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম সময়ের ব্যবধানে চাইলে পুনরায় বিয়ে করতে পারে। সেজন্য কোনও তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ প্রয়োজন হয় না।
এর পর আছে ‘তালাক-এ-হাসান’ বা ‘ভালো’ পদ্ধতি। নিয়মটা ‘আসান’-এর মতোই, তবে তালাক দাতা স্বামী নিজের খামখেয়ালে বৌকে ফিরে পেতে চাইলে ব্যাপারটা আর ‘মিঞা-বিবি রাজি’ হওয়া দ্বারা নিষ্পত্তি হয় না, ‘হালালা’ আবশ্যক; অর্থাৎ তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকেও পুনর্বিবাহ করে পুনরায় ‘তালাক’ আদায় করে আসতে হবে। সোজা কথায় ‘হারাম’ বলে পরিত্যক্ত স্ত্রীকে ফিরে পেতে গেলে পরপুরুষের স্পর্শেই তাকে ‘হালাল’ করতে হবে।
সম্ভবত পুরুষমানুষকে মাথা গরম করে স্ত্রী পরিত্যাগ করা থেকে নিবৃত্ত করতেই হালালার মতো প্রায়শ্চিত্তের বিধান। কিন্তু হালালার দায়িত্ব নেয় যে পুরুষ, তার উদ্দেশ্য মধুর দাম্পত্যর বদলে নিছক ভোগ হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ সে ত্যাগ করার চুক্তিতেই ভোগের সাময়িক অনুমতি পেয়েছে। প্রত্যাশিতভাবে এই ‘হালালা’ বা পবিত্রকরণের মহান দায়িত্ব সচরাচর ধর্ম ব্যাখ্যার ঠিকাদাররাই পালন করে থাকেন তার বিনিময়ে মৌলবিরা রীতিমতো নারীর শরীর ও অর্থ দুটোই ভোগ করার ব্যবসা চালানোর সুযোগ পায়। পুরো ব্যাপারটাতে কোথাও নারীর সম্মতির প্রশ্ন নেই। সে আদৌ আবার বিয়ে করে অন্য কারও অঙ্কশায়িনী হতে চায় কিনা, কিংবা যে ‘শওহর’ তাকে তাড়িয়ে দিল তাকে পুনরায় ফিরে পেতে চায় কিনা, সেটা জানা পিতৃতন্ত্রে অনাবশ্যক। সুতরাং পাপ পুরুষ করলেও তার প্রায়শ্চিত্তের দায় অবশ্যম্ভাবীরূপে স্ত্রীর ওপর বর্তায়।
আমার আরও একটি অনুমান ‘আসান’ পদ্ধতি অনুযায়ী তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় ফিরে পেতে যেহেতু দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়, সম্ভবত সেটা সংক্ষিপ্ত করতেই এই হালালা প্রথার উদ্ভাবন, যেটা সময়সীমা নিরপেক্ষ হলেও পুনর্মিলনের ব্যাপারটা অত্যধিক জটিল করে তুলেছেআর এইসব আজগুবি বিধান যারা দেয়, তারা যে নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেই দেয় এটা অনুমান করা কঠিন নয়। ‘হালালা’ বা পবিত্রকরণের বিনিময়ে দক্ষিণা গ্রহণের ঘটনাও শোনা যায়। গরিব অশিক্ষিত মানুষকে বৌয়ের বিরুদ্ধে উস্কে তালাক দেওয়াও, তারপর তার বৌকে ফোকটে ভোগ করো এবং সেই সঙ্গে খানিক উপার্জন করে নাও। এই শোষণচক্র থেকে মুসলিম সমাজ মুক্ত হলে শুধু মেয়েরা নয়, পুরুষরাও যে উপকৃত হবে, এই উপলব্ধি মুষ্টিমেয় কিছু পুরুষমানুষেরও হয়েছে। তাই তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও হালালা বিরোধী আন্দোলনে গুটিকয় পুরুষদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, যাদের প্রতিনিধিত্ব ২০১১-র সেমিনারে ততটা চোখে পড়েনি।
সুন্নি সম্প্রদায় আবার ‘তালাক-উল-বিদ্দত’-এর নামে তালাক দান পদ্ধতিটিকে আরও শর্টকাট করে নিয়েছে। এক নিশ্বাসে যে কোনও অজুহাতে তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে বৌকে তাড়িয়ে দাও। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল বিয়ের সময় কাজি ও পরিবার পরিজনদের সাক্ষী রেখে যে দেনমোহর বা কন্যাপণের প্রতিজ্ঞা করেছিল বর, তাড়াহড়োয় সেটা বেমালুম চেপে যাওয়া যায়পুরুষালি যথেচ্ছাচারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর হয় না। কারণ হিসাবে দেরিতে ঘুম ভাঙা, কি হাঁটতে গিয়ে এগিয়ে যাওয়া যা হোক একটা অজুহাত খাড়া করলেই হল।
কিন্তু এত সহজে সামনা সামনি, ফোনে, বা এসএমএস বার্তা লিখে তালাক দিয়েই রেহাই পাওয়া গেলে মধ্যসত্ত্বভোগী ধর্মব্যাপারী মাতব্বরদের চলে কী করে? তাই বৌকে একবস্ত্রে কানাকড়ি না ঠেকিয়ে তাড়ানোর পদ্ধতিটা সহজ সংক্ষিপ্ত করা হলেও তাকে ফিরে পাওয়ার পদ্ধতিটা একই রকম জটিল করে রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত “Introduction to Islamic Law বইতে তার দুই লেখক ডঃ তাহির মাহ্‌মুদ ও ডঃ সইফ মাহ্‌মুদ লিখেছেন “Three consecutive tuhrs (menses-free time) are the minimum period allowed for this periodcertainly not a fixed period for it to be followed in every case.”তাঁরা এই প্রসঙ্গে ‘দেওবন্দি’ ধর্ম ব্যাখ্যাকার আশরফ আলি থানভিকে (১৮৬৩-১৯৪৩) উদ্ধৃত করেছেন,A man pronounces a revocable talaq. He reconciles and resumes cohabitation. A few years later under some provocation he pronounces a revocable talaq once again. On recovering from provocation he again resumes cohabitation. Now two talaqs are over. Thereafter whenever he pronounces a talaq it will be counted as the third talaq which will dissolve the marriage forthwith.অর্থাৎ পুনর্বিবেচনার তথা তালাক প্রত্যাহারের যথেষ্ট সময় সুযোগ দেওয়ার জন্য তিন মাস কেন, দরকারে অনেক দীর্ঘতর সময় এমনকি বছর কয়েকও নেওয়া যেতে পারে।
তা কোরানে যতই আল্লার সিংহাসন কাঁপার কথা বলুক, আর দু-চারজন শুভবুদ্ধির কোরানবিদ (Clerics) যাই ব্যাখ্যা দিন, পুরুষ মানুষকে একতরফা সুবিধা দিতে মহম্মদের অব্যবহিত পর বা অনেকের মতে তাঁর সময় থেকেই এক ঝটকায় ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলা, বা বেয়াড়া বৌকে শাস্তি দেওয়ার এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। সুতরাং All-India Muslim Personal Law Board-এর তীব্র প্রতিক্রিয়া একদিক থেকে কোরান অমান্য হলেও অন্যদিক থেকে দেখলে প্রায় চোদ্দশো বছর ধরে ভোগ করা এক ঐতিহাসিক আবদার।
‘সুন্নি’ বিশ্বাসের চারটি স্বীকৃত শাখা– ‘হানাফি’, ‘মালিকি’, ‘হানবলি’ ও ‘শাফি’। পারস্পরিক কিছু মতভেদ থাকলেও এক ঝটকায় তিন-তালাক দেওয়ার পক্ষে এই চারটি শাখারই পণ্ডিতদের মধ্যে ক্রমশ যথেষ্ট মতৈক্য তৈরি হয়সুবিধাবাদ ছেড়ে ভিন্ন পথে যদি কেউ কেউ হেঁটেও থাকে, তারা কালক্রমে সংখ্যালঘু কিংবা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েযদিও পরে হানাবলি, শিয়া ও আহমদিয়ারা তালাক-এ-বিদ্দত থেকে সরে ‘তদ্দত’-এর জন্য ন্যূনতম তিন মাস দেওয়ার পক্ষে আইন বানায়। কিন্তু ভারত উপমহাদেশে সুন্নি ধারারই দাপট বরাবর বেশি। সুতরাং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB) আচমকা FEW India, প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ বা ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA)-এর মতো কতগুলো অর্বাচীন মহিলা সংগঠনগুলোর দাবি মেনে নেবে কেন?






ভারতে শরিয়তি ঐতিহ্য ও ইসলামি আইনের বিবর্তন

যদিও ভারত ভূখণ্ডে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ৭১২ সালে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পরেই, তবে ১২০৬-এর আগে এই দেশে শরিয়তি আইনের কোনও প্রমাণ নেই। ইসলামি আইন ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দিল্লিতে সলতনত্‌ গড়ে ওঠার পর। মুসলিমদের ব্যক্তিগত বিষয়ে মুফতি নিয়ন্ত্রিত শরিয়তি কানুনের প্রচলন দেখা যায় দাস বংশ (১২০৬-১২০৯), খলজি বংশ (১২৯০-১৩২১), তুঘলক বংশ (১৩২১-১৪১৩), লোদি বংশ (১৪৫১-১৫২৬) এবং সুর বংশ (১৫৩৯-১৫৫৫) – এদের শাসনকালে। শরিয়তি আইন তখন দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল
এর মধ্যে আলাউদ্দিন খলজি নিজের রাজকার্যে মুফতি মৌলানাদের খবরদারি পছন্দ না করলেও সাধারণের জন্য শরিয়তি কানুন জারি রেখেছিলেনদিল্লির অন্যান্য সুলতানরা তো রাজকার্যেও মৌলবি উলেমাদের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হতেন। শের শাহ সুরির সময় শরিয়তি কানুনের ক্ষমতা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ইসলামি আইনের কিছু যুগোপযোগী পরিবর্তনও সাধিত হয়। মুঘল শাসক বাবর ও হুমায়ুনের শাসনকালে পূর্বতন নিয়ম ফিরে আসে যাতে আইনি ব্যাপারে উলেমাদের প্রভাব যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। আকবরের সময় ধর্মীয় মুরুব্বি ও রক্ষণশীল সুন্নি কানুনের ক্ষমতা বেশ খানিকটা ছেঁটে ফেলা হয় মূলত বাদশাকে প্রাধান্য দিতে। সুবিচারক বলে পরিচিত জাহাঙ্গির নাক-কান কাটা বা নিষ্ঠুর মৃত্যুদণ্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্রাটের অনুমতি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক করে দেন। ঔরঙ্গজ়়েব পুনরায় কট্টর সুন্নি বিধান ফিরিয়ে এনে জটিল অনমনীয় আইন-কানুন চালু করেন।
শের শাহ সুরি
প্রসঙ্গত মুঘল বাদশারা কিন্তু ‘সতীদাহ’ নামক বর্বরতা বন্ধের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। হুমায়ুন এই প্রথা রদ করতে গিয়েও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। খুব স্বস্তিতে তো ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি। পুত্র আকবরও চেয়েছিলেন হিন্দু প্রজাদের না চটিয়ে সতীদাহের সংখ্যা যতটা কমানো যায় তার চেষ্টা করতে। তিনি কোনও বিধবার সতী হওয়ার সিদ্ধান্ত একটি কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষ করে দিয়েছিলেন, আর সেই কমিটিকে নির্দেশ দেন যেন দেরিতে বিধান দেয় যাতে ঝোঁকের মাথায় নেওয়া পুড়ে মরার সিদ্ধান্ত থেকে মেয়েটি সরে আসতে পারেঅবশ্য তাতে লাভ বিশেষ হয়নি, কারণ আদতে সিদ্ধান্তগুলো হোত ‘পুড়ে মরা’র নয় ‘পুড়িয়ে মারা’রশাহজাহান তো সন্তান থাকা বিধবাদের সতী হওয়া একেবারে নিষিদ্ধ করে দেন। এমনকি বহুনিন্দিত আওরঙ্গজ়েবও মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে সতীদাহ প্রথাটাই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেন, যদিও রাজধানীর বাইরে চোরাগোপ্তা পুণ্যসঞ্চয় তাতে আটকানো যায়নি। তবে যে শাসকরা হিন্দু প্রজাদের ওপর জিজিয়া, তীর্থযাত্রা মাসুল ইত্যাদি বসিয়ে তাদের নিজভূমে পরবাসী করে রেখেছিলেন, নিজেদের হারেমে রাজপ্রাসাদ থেকে সাধারণ গৃহস্থবাড়ি – যেখান থেকে পেরেছেন শত সহস্র হিন্দু নারীকে লুঠ করে এনে যৌনদাসী বানিয়ে রাখতেন, তাঁদের কোনও সদিচ্ছাকেও যদি হিন্দুরা ধর্মাচরণে ব্যাগড়াদান কিংবা রক্ষকই ভক্ষক হিসাবে সন্দেহ করে থাকে, তাহলে আশ্চর্য কিছু নয়। ‘সতী’ প্রথার নিকটাত্মীয় ‘জওহর’ ব্রতর ব্যপকতা তো মুসলিম শাসকদের যৌন নির্যাতন এড়াতেই। তাছাড়া ক্ষমতায় আসীন থাকার চেয়ে সমাজ সংস্কারের সদিচ্ছা জোরালো হতে পারে না। হিন্দু প্রজাদের কাছ থেকে চাহিদা মতো শুল্ক উসুল হলে তাদের নিজস্ব প্রথার সু-কু নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলত।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গুরু নানকও নাকি সতীদাহের বিরুদ্ধে ছিলেন বলে। তবে সেই নিয়ে কোনও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বা নিজের প্রণীত ধর্মে নিষিদ্ধ করেছিলেন বলে শোনা যায় না। 
রাজা রামমোহন রায়
পরে ইংরেজ আমলে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেই রামমোহন প্রমুখের মাধ্যমে সংস্কারের তাগিদ জাগে, তখন প্রথাটি আইনত নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়। ১৮২৯- ভারতবর্ষে সতীদাহ আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। এর বহু আগে পঞ্চদশ শতাব্দীতেই পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়াতে সতীপ্রথা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সেখানে এর তেমন জনপ্রিয়তাও ছিল না। ফরাসি ও ডাচ কলোনি চন্দনগরুঁচুড়াতেও এই বর্বর প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতকে অপেক্ষা করতে হয় ১৮২৯ পর্যন্ত বা বলা ভালো ১৮৩২-এ প্রিভি কাউন্সিলের সুপারিশ পর্যন্ত, যা করিয়ে আনা গিয়েছিল মুষ্টিমেয় সংখ্যক হলেও হিন্দুরা উদ্যোগী হওয়ার পরেই। বেশ কিছুকাল পরে ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের বাইরে ত্রিপুরাতেও সতীদাহ নিষিদ্ধ হয় রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের আদেশেওদিকে নেপালে বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত নারী দহন উৎসব ঘটা করে পালিত হয়েছে।
খ্রীস্টান মিশনারিরা অনেকদিন ধরেই এর বিরোধিতা করছিল। কিন্তু কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে সংশোধনের তাগিদ না জন্মালে তাকে সংস্কার করা অমিত ক্ষমতাবান শাসকের পক্ষেও সম্ভব না। রামমোহন রায়ের মতো গুটিকয় নেতৃত্বস্থানীয় হিন্দুসন্তানের সক্রিয় সহযোগিতার ফলেই ইংরেজ শাসকদের পক্ষে সতীদাহ রদ থেকে হিন্দু বিধবা মহিলার স্বামীর সম্পত্তি লাভের মতো সমাজ সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলনও সম্ভব হয়েছিলশিক্ষা-দীক্ষায় এই সংস্কার যদি ইংরেজদের প্রশাসনিক স্বার্থে হয়েও থাকে তা ভারতীয় সমাজকে এক ধাক্কায় পাশ্চাত্য দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু এই সংস্কার তথা উন্নয়নে মূলত হিন্দু ও হিন্দু সংস্কৃতিজাত শিখ বৌদ্ধ জৈন বা তার বাইরে পার্সি ইত্যাদি সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করলেও মুসলিম সমাজ ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানকে পরাধীন ভারতে কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছিল
উল্লেখ্য রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিয়ে ও ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়ে পরবর্তীকালে কিছু উন্নাসিক শিক্ষিত হিন্দু নিজেদের হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলেও ব্রাহ্মধর্মের প্রণেতা স্বয়ং রামমোহন নিজেকে অহিন্দু হিসাবে দাবি করেননি। করেননি বলেই সতীদাহ বন্ধ থুড়ি সতীদাহ বিরোধী আইন প্রণয়ন করাতে পেরেছিলেন।
এরপর ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয় করিয়ে বিদ্যাসাগরমশাই তো হিন্দু সমাজে এক কথায় বিপ্লব নিয়ে আসেন। বহুবিবাহ নিষিদ্ধকারী আইন তখনই চালু না হলেও বহুবিবাহ ও কৌলিন্য বিরোধী যে জনমত তিনি সংগঠিত করতে পেরেছিলেন, তাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
স্ত্রী শিক্ষা চালু করে জীবদ্দশায় নিজে চরম সংকটে পড়লেও মৃত্যুর পর তার স্থায়ী উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি তথা সমস্ত ভারতীয়দের আবার সম্পূর্ণ প্রান্তিক থেকে অন্তজ শ্রেণীর জোতিবা ফুলে ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী ফুলে, বিশেষত সাবিত্রী লাগাতার নিগ্রহ অপমান ও প্রাণনাশের হুমকি সহ্য করে বা উপেক্ষা করে স্ত্রী শিক্ষার প্রসার, অসহায় বিধবাদের পুনর্বাসন ইত্যাদির জন্য প্রাণপাত করেছেন কোনওরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
অন্যদিকে মিশ্র সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের ভূমি ভারতবর্ষে মুসলিমদের মূল পথপ্রদর্শক কোরান হলেও কিছু কিছু সমস্যা তারা যেখানে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী মেটাত, সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে মুসলমানদের জন্য ইসলামি কানুন পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। The Regulation 11 of 1772 by Sec. 27 অনুযায়ী "in all suits regarding inheritance, succession, marriage and caste and other religious usages or institutions, the laws of the Quran with respect of Mohamedan and those of the Shastras with respect to Gentoos (Hindus) shall be invariably adhered to." ১৮২২ সালে প্রিভি কাউন্সিল শিয়া মুসলিমদের নিজস্ব আইন চালুর অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়। সম্ভবত ঔপনিবেশিক শাসকরা এই সম্প্রদায়টিকে বশে রাখার টোটকা যে ধর্মীয় ভাবাবেগে অক্সিজেন দেওয়া, তা ভারতের মাটিতে পা দিয়েই বুঝে গিয়েছিল।
দেখা গেছে হিন্দু সম্প্রদায় যখন ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় কিছু কিছু সমাজ সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে, আবার পরবর্তীকালে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে জাতীয়তাবোধ দেশাত্নবোধে জারিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছে, সেখানে মুসলিম সমাজ বরাবর উন্নয়নকে সন্দেহের চোখে দেখেছে, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দরাদরি করেছে এবং সর্বোপরি নিজেদের জন্য সময় সময় পৃথক আইন, পৃথক ইলেক্টোরেট বা পৃথক রাষ্ট্র চেয়ে নিয়েছে। এর ফলে পুরুষপ্রধান সমাজের চিরন্তন নারী নির্যাতনের কায়েমি ব্যবস্থাটি তাদের বেলা এক প্রকার আইনি বৈধতা পেয়ে এসেছে। মুসলিম মেয়েদের অবস্থা ভারতীয় পিতৃতন্ত্রের ঐতিহ্যে যে জটিলতর আকার ধারণ করেছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সদিচ্ছা এই সমাজে কখনই দেখা যায়নি।
তাই হয়তো লাগাতার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জেরে যখন ভারতে রাজ্যস্তরে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন (Provincial Autonomy) দেওয়ার উদ্দেশ্যে Government of India Act, 1935 বলবৎ হল, তখন প্রথম যে আইনটি প্রণীত হয় তা হল, Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 যার দ্বারা মুসলিম পারিবারিক বিষয় নিয়ন্ত্রিত হবে। এই আইনটি পূর্ববর্তী "Anglo-Mohammedan Law"-কে প্রতিস্থাপিত করে। শরিয়ত ব্যাখ্যার অধিকার চলে যায় উলমাদের হাতে। ভারতের হানাফি সুন্নি সম্প্রদায়ের উলমারা তাৎক্ষণিক তিন তালাককেই অপরিবর্তনীয় করে তোলে। অবশ্য সেক্ষেত্রে শর্ত, তালাক হতে হবে কয়েকজন মুসলিম সাক্ষীর সামনে।
তবে ‘আহ্‌ল-ই-হাদিত’, ‘টুয়েলভার’ ও ‘মুস্তালি’ ধারার উলমারা এই পদ্ধতির পক্ষপাতী নয়। গবেষক অপর্ণা রাও জানিয়েছেন এই নিয়ে উলমাদের মধ্যে বিস্তর তর্ক বিতর্কও হয়েছে। ভারতে মুসলমানদের বিয়েটাও ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে মেনে নেওয়া আছে যদি না তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে Special Marriage Act of 1954 দ্বারা নথিকরণ করায়। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা শরিয়তি আইন স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার সময় শুধু যে অপরিবর্তিত থেকেছে, তাই নয়, সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষার নামে তা সংরক্ষণের অ্যাজেন্ডা হিসাবেও গৃহীত হয়েছে যদিও  মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে যে কোনও আইন সংশোধনের নীতিও সংবিধানে আছে, তবু এমন ঐতিহাসিক সমাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতের পক্ষে পুরুষ মানুষের একতরফা তালাক দেওয়ার প্রথা রদ করা খুব সহজ ছিল না বা এখনও নয়, বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক অনৈতিকতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। 
কিন্তু শরিয়তি আইন সর্বৈব চরম নারী বিদ্বেষী এই ধারণাটাও ভুল। মহম্মদ আলি জিন্নার রাজনৈতিক উচ্চাশা চরিতার্থ করার জন্য দরকার ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে নিখিল-ভারতীয় ইসলামি পরিচয় (pan-Indian Muslim identity
মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌
গড়ে তোলা। তাই মিশ্র সংস্কৃতি থেকে ভারতীয় মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন শরিয়তি আইনের অধীনস্থ করার আয়োজন হল। জিন্নার আশা ছিল পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ ভালো ফল করবে যেখানে জমিদার
সামন্তপ্রভুদের রাজত্ব। কিন্তু ১৯৩৭-এ ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা (Central Legislative Assembly) দ্বারা যে শরিয়ত আইন (Shariat Act in 1937) লাগু হল, তাতে মুসলিম মেয়েদেরও পিতার সম্পত্তিতে কিছুটা ধিকার দেওয়া আছে দেখে পাঞ্জাবের জমি মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েকারণ পাঞ্জাবে হিন্দু মুসলমান বা শিখ কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যেই কন্যাসন্তানের বাবার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার স্বীকৃত ছিল না। তাদের বাধায় পাঞ্জাবের ভূমি বণ্টন ব্যবস্থাকে শরিয়তি আইনের বাইরে রাখা হলেও এই দিক থেকে শরিয়তি আইন যে প্রচলিত রীতির চেয়ে অনেকটা উদার সেটা মানতেই হবে।
শুধু তাই নয়, ১৯৩৭ সালের ৭ আক্টোবর মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্টের সেকশন ৫ মুসলিম মহিলাদেরও ক্ষেত্রবিশেষে বিচ্ছেদ দেওয়ার অধিকার দিয়েছিল যার নাম ‘খুলাখুলা বলতে অবশ্য মিঞা-বিবির মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বিচ্ছেদকে বোঝায়। এই ধারাটি ১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে আইন সংশোধনের দাবিতে Dissolution of Muslim Marriages Act দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয় যেখানে মুসলিম মেয়েদের খুলা চাইবার কারণ বা ক্ষেত্রগুলি নির্দিষ্ট করা হয়মানে যা আদালতের বাইরে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় হতে পারত, তার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। তাই বা মন্দ কী? এতে পুরুষদের একতরফা বিচ্ছেদ দেওয়ায় রাশ না থাকলেও মেয়েদের জন্যও একটা রাস্তা খোলা ছিল, যে অধিকার হিন্দু রমনীদের পেতে কিন্তু লেগে গিয়েছিল আরও দুই দশক। Dissolution of Muslim Marriages Act অনুযায়ী মুসলমান মহিলারা যেসব ক্ষেত্রে খুলা চাইতে পারে সেগুলো হল:
১. বিগত চার বছর ধরে যদি বরের কোনও খোঁজ খবর না থাকে,
২. যদি দুই বছর বা তার অধিক সময় ধরে পুরুষটি স্ত্রীকে অবহেলা করে বা তার খরচাপাতি দিতে অপারগ হয়,
৩. বর যদি সাত বছর বা তার অধিক সময়ের জন্য জেলে থাকে,
৪. পুরুষটি যদি তিন বছর ধরে বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়
৫. স্বামীর যদি বিবাহের সময় ও পরে যৌন অক্ষমতা থাকে,
৬. দু বছর বা তার বেশি সময় ধরে বিবাহিত পুরুষটি যদি মানসিক ভারসাম্যহীনতা, কুষ্ঠ বা বিপজ্জনক যৌন রোগে আক্রান্ত থাকে,
৭. স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতা করে, তা মানসিক নিষ্ঠুরতা হলেও
৮. স্ত্রীর যদি ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে
৯. বর যদি মন্দ চরিত্রের মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে বা বদনামের ভাগী হয় অথবা বৌকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করতে চায়,
১০. স্বামী যদি স্ত্রীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে অথবা সম্পত্তি ভোগ দখলে বাধা দেয়,
১১. পুরুষটি যদি স্ত্রীর ধর্মীয় আচারবিধিতে বাধা দেয়,
১২. স্বামীর যদি একাধিক স্ত্রী থাকে এবং সবার সাথে কোরানের নির্দেশ মেনে সমান ব্যবহার করতে না পারে,
১৩. তাছাড়া স্বামী অন্য কোনও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ করলে
     তাছাড়া এই আইনে খুব স্পষ্ট করে ‘দেনমোহর’-এর কথা বলা আছে। বৈবাহিক চুক্তিতে এটি স্ত্রীর প্রাপ্য অর্থ বা সম্পদ। মোহর দুই ভাবে দেওয়া যায়— তাৎক্ষণিক মোহর (prompt mahr) যা বিয়ের সময়ই বিবিকে দেওয়া হয় অথবা বিলম্বিত মোহর (deferred mahr) যা দেওয়া হয় বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর ফলে দাম্পত্যের ইতি ঘটলে। এই আইনটি বাংলাদেশের বৈবাহিক আইনেও প্রতিফলিত ও পরিবর্ধিতরূপে বিরাজ করছে।
     কিন্তু কালক্রমে মেয়েদের খুলা চাইবার পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এবং নিকাহ কবুল করার সময় কনেপণ স্বরূপ দেনমোহরের প্রতিজ্ঞা করা হলেও সেই প্রতিজ্ঞা বাধ্যতামূলকভাবে না বিয়ের সময় রাখা হয়, না তালাক দিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার সময় মনে রাখা হয়। আর দীর্ঘ অভ্যাস বশত এইসব বেআইনি কাজকর্মগুলোই মানুষ আইন বলে মেনে নিয়েছে।
শরিয়তি আইন মা-বাবার সম্পত্তিতে পুত্রকে কন্যা সন্তানের দ্বিগু পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। আর বিধবা নারীকে ছেলেমেয়ে না থাকলে এক অষ্টমাংশ ও সন্তান থাকলে এক চতুর্থাংশ লাভের অধিকার দিয়েছে। সুতরাং সাম্য না থাকলেও একেবারে বঞ্চনার আয়োজন শরিয়তি আইনেও নেই যেটা আজ হচ্ছে। আর তলিয়ে দেখলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করার মধ্যে শরিয়ত অমান্য নয়, তা ঠিকমতো পালন করানোর উদ্যোগই চোখে পড়বে।
দেওয়ানি পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে যায় ১৯৭৩ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় All India Muslim Personal Law Board  (AIMPLB)  স্থাপিত হওয়ার পর। এর উদ্দেশ্য হল ১৯৩৭-এর Muslim Personal Law (Shariat) Application Act-কে সুরক্ষিত রাখা যাতে করে বিয়ের মতো দেওয়ানি ও ব্যক্তিগত বিষয়ে শরিয়তি আইন বলবৎ থাকে। মোটামুটি সব সম্প্রদায়ের মুসলিমের প্রতিনিধিত্ব ছিল এই বোর্ডে। কিন্তু মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের নিয়ম-কানুন শিয়া ও আহমদিয়া মুসলিমদের অনুসারী নয় বলে তাহির মাহমুদ, আরিফ মোহাম্মদের মতো কিছু কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবী এই বোর্ড তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। বিরোধিতা করেন সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজুও। ২০০৫ সালে তৈরি হয় পৃথক All India Shia Personal Law Board এবং মুসলিম মহিলাদের সংগঠন All India Muslim Women's
ইন্দিরা গান্ধী
Personal Law Board-ওতবে তারা মুসলিম সমাজ বা সরকার কারও কাছ থেকে সেভাবে সমর্থন না পাওয়ায় মুসলিম আইন-কানুনের দায়িত্ব কার্যত ৫১ জন উলমা স ২০১ সদস্য নিয়ে গড়া AIMPLB-র হাতেই কুক্ষিগত থাকে।
কালক্রমে উৎকট লিঙ্গ বৈষম্যবাদী সুন্নি প্রথাই জনপ্রিয়তা পেতে থাকেউপেক্ষিত বা কার্যত নস্যাৎ হতে থাকে ক্ষেত্রবিশেষে নারীর তালাক দানের বা ‘খুলা’র অধিকার যা ভারতীয় শরিয় অ্যাক্ট ১৯৩৭-এরই সেকশন ৫-এ দেওয়া আছে। ধর্ম ও ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যা যারা দেবে সেই উলমা, ইমাম, মৌলানাদের সৌজন্যে আইন অমান্যটাই এতদিন আইন হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তাই খুল্লা কথাটাই অনেকে আজ প্রথম শুনলাম
১৯৮৬ সালে শাহবানু মামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত হয় মুসলিম মহিলা আইন বা The Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act বিচ্ছেদ প্রাপ্ত মুসলিম মহিলাদের আর্থিক অধিকার রক্ষার চেষ্টায়গোয়াতে যেহেতু সব ধর্মের মানুষকেই গোয়া সিভিল কোড মানতে হয়, তাই আইনটি গোয়া ছাড়া ভারতে অন্য সব রাজ্যে প্রযোজ্য। তাছাড়া Special Marriage Act, 1954 দ্বারা বিবাহ পঞ্জিকৃত হলেও আইনটি প্রযোজ্য নয়। দরকারও হয় না, কারণ সচরাচর এই পদ্ধতিতে বিয়ে দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে যাতে কোনও সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান আবশ্যক নয়। তাছাড়া এই আইনে বিবাহ হলে বিবাহ বিচ্ছেদ একমাত্র আদালতের মাধ্যমেই সম্ভব; সুতরাং কনের ধর্ম যাই হোক, খামখেয়ালি বা স্বার্থাণ্বেষী তালাকের বৈধতা এমনিতেই থাকে না। কিন্তু এই আইনের সুবিধা কতজন মুসলমান মহিলা নিতে পারে সেটাই মস্ত প্রশ্ন। তাদের জীবন যৌবন বিবাহ বিচ্ছেদ পুনর্বিবাহ ইত্যাদি সবই ইসলামি কানুনের ঘেরাটোপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যে কানুনের ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ কোনওটাই মেয়েদের হাতে নেই।
বলা বাহুল্য তাৎক্ষণিক তিন তালাক, হালালা প্রথা থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে বৈষম্য ইত্যাদি দ্বারা মেয়েদের হাত পা বেঁধে রেখে The Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act-এর মতো একটি চোখধোয়া আইনের সাহায্যে যে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।





ইসলামি আইন সংশোধন:
মুসলিম বিশ্ব বনাম ভারত

সুন্নি বিশারদদের যোগসাজশে প্রথম ভিন্ন মত প্রকাশ করেন হানবালি পণ্ডিত ইবন তাইমিয়া (১২৬৮-১৩২৮)। তাঁর বক্তব্য ছিল এক সাথে তিন তালাক উচ্চারণ করলে তা একবার বলেই গণ্য হবে। ‘ইদ্দত’-এর জন্য ন্যুনতম তিনমাস দিতেই হবে। কিন্তু ক্রমশ এই মতটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে ও ২০টি দেশ তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বৈধতা দেয়। ভারতবর্ষ ও তার প্রতিবেশী মুসলিম শাসিত অঞ্চলগুলি ছিল এদের মধ্যে অন্যতম।
     পুনরায় জনপ্রিয় (পুরুষপ্রিয়) বিদ্দত পদ্ধতি থেকে সরে আসা শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে। শুরু করে মিশর ১৯২৯ সালে প্রণীত আইনের ২৫ নং ধারায় বলা হল এক নিঃশ্বাসে যতবার খুশি তালাক উচ্চারিত হোক না কেন, তা একবার বলেই গণ্য হবে এবং তা প্রত্যাহারযোগ্য থাকবে। পরপর তিনটি ‘তহ্‌র’-এ বা অ-ঋতুমতী অবস্থায় তালাক দিলে তবেই বিচ্ছেদ গ্রাহ্য হবে। ১৯৩৫ সালে সুদানও অনুরূপ আইন চালু করে। এমনকি সিরিয়ার মতো দেশ যা আজ ‘ইসলামিক স্টেট’ আন্দোলনের সৌজন্যে বিশ্ব ত্রাস, সেখানেও ১৯৫৩ সালে মিশর ও সুদানের আইন মিলিয়ে তালাক আইন প্রণীত হয়। ডঃ মুনির লিখেছেন, “The Syrian law of 1953 combined the provisions of the Egyptian and the Sudanese laws by providing that if a divorce is coupled with a number, expressly or impliedly, not more than one divorce shall take place and every divorce shall be revocable except a third divorce, a divorce before consummation, and a divorce with consideration, and in this law such a divorce would be considered irrevocable.”
     অধিকাংশ মুসলিম দেশ যেমন ইরাক, জর্ডন, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস, ইন্দোনেশিয়া, কাতার ইত্যাদি বিংশ শতাব্দীতে তাইমিয়ার বিধানই গ্রহণ করে তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করে। টিউনিশিয়া আর একটু অগ্রসর হয়ে আদালতের বাইরে বিবাহবিচ্ছেদকে অবৈধ ঘোষণা করে। যথেষ্ট কারণ দর্শিয়ে মিটমাটের জন্য উপযুক্ত সময় নেওয়ার পরেও যদি মিটমাট না হয়, তখনই বিচ্ছেদ সম্ভব। আলজিরিয়াও অনুরূপ আইন প্রণয় করে মিটমাট বা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য তিন মাস সময় ধার্য করে
১৯১৯ থেকে ’২১ সাল পর্যন্ত চলা আতাতুর্ক মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা তুর্কি বিপ্লবে তুরস্কের খলিফার শোচনীয় পরাজয়ের পর ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের স্বপ্নও অস্তমিত হয়। ১৯২৪ সালে রিপাবলিক অব টার্কি (Republic of Turkey) গঠিত হলে খলিফার কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা চলে যায় Grand National Assembly of Turkey-তে। এরপর ১৯২৬

মুস্তাফা কামাল পাশা
 

সালে গৃহীত হয় সুইস সিভিল কোড (Swiss Civil Code)। সুইস কোডকে সমগ্র ইওরোপের সবচেয়ে প্রগতিশীল আইন মনে করা হয়। বলা বাহুল্য ইসলামিক বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইনের জায়গা সেখানে নেই। ১৯৮০ সালে তুরস্কের সুইস কোডের কিছু পরিবর্তন হলেও তাতে ইসলামি মৌলবাদ থাবা বসাতে পারেনি। পরবর্তীকালে সাইপ্রাস আবার তুরস্কের সিভিল কোড (Turkish Civil Code) গ্রহণ করে।
এখন ভারতের প্রগতিশীল মুসলিম সংগঠনগুলি তথা সংখ্যালঘু (পুরুষ) স্বার্থবিরোধীরা ইসলামি আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য যেসব মুসলিম রাষ্ট্রর উদাহরণ দেয় সেগুলো হল:
মরক্কো: ১৯৮৬ সালে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হয়
টিউনিশিয়া: ১৮৫৭ সালে ‘ইসলামিক ল অব পার্সোনাল স্টেটাস’ দ্বারা বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয়আদালতের বাইরে যে কোনও তালাক এই আইনের ৩০ নং ধারা অনুযায়ী অবৈধ।
ইরান: শিয়া আইন অনুযায়ী তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বৈধতাই নেই।
ইরাক: ১৯৫৯ সালে ইরাকের ‘ইসলামিক ল অব পার্সোনাল স্টেটাস’-এ বলা আছে কাজি যদি মনে করে স্ত্রীদের প্রতি বৈষম্য হবে না ও পুরুষটির একাধিক বৌ রাখার আর্থিক সঙ্গতি বজায় থাকবে তাহলেই দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিতে পারে।
ইয়েমেন: রাষ্ট্রপতি নিজে আইন করে আদেশ দিয়েছেন অযথা তালাক না দিতে।
তুরস্ক: দ্বিতীয় বিবাহ করতে গেলে আদালত কর্তৃক প্রথম বিবাহের অবসান চাই অথবা পূর্বতন স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে তার প্রমাণ।
মিশর, জর্ডন: মহিলাদেরও স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
আলজেরিয়া: ১৯৫৯ সালে তালাক দানে পুরুষ ও স্ত্রীকে সমান অধিকার দেওয়া হয়। আদালতে যথেষ্ট কারণ দর্শাতে পারলে তবেই বিচ্ছেদ
মালয়েশিয়া: আদালতের বাইরে তালাক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া: ১৯৭৫ সালে যে আইন হয় তাতে স্ত্রী-পুরুষ সকল নাগরিকদের সম-মর্যাদা, সম-অধিকার এবং সমস্ত বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়।
মোট যে ২টি দেশের (অরাজক আফগানিস্তানকে ধরলে ২৩) উদাহরণ দেওয়া হয় তাদের অধিকাংশ ‘শিয়া’ তাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী সুন্নি অধ্যুষিত দেশে বর্তমান আইন কানুন ও তার সংশোধনের দিকে একটু বিশদে যাচ্ছি; বিশেষত বাংলাদেশ, যার ভারতীয় অংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আইনের সর্বাধিক আপত্তি উঠেছে। দুটি রাষ্ট্রেই তালাক আইনের ভিত্তি অবিভক্ত ভারতের শরিয়ত আইন ১৯৩৭ (Shariat Act in 1937)১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939)। ‘সুন্নি’ মতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক বা ‘তালাক-এ-বিদ্দত’ সম্পূর্ণ বৈধ দোহাই দিয়ে ভারতে যে আইনগুলো অগ্রাহ্য করে নারীর তালাক দেওয়ার অধিকার হরণ করে রাখা আছে, সেগুলো ঐ দুই দেশে অনুসৃত হয়; উপরন্তু পরবর্তীকালে মেয়েদের সুরক্ষায় আরও কিছু সংস্কারও হয়েছে।

পাকিস্তান:
ধর্মের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠা পাকিস্তানকেও এ ব্যাপারে অনেক অগ্রসর ভূমিকায় দেখা গেছে যেহেতু ইসলামিক কট্টরতা ও সংখ্যালঘু আবেগ সেখানে সমার্থক নয়, আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির আবেগ নিয়ে তারা ভাবিতও নয়১৯৫৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলি বোগরা প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে নিজের সেক্রটারিকে বিয়ে করলে তুমুল হৈচৈ পড়ে যায়পুরুষের বহুগামিতা ইসলাম সমর্থিত হলেও এই ঘটনায় All Pakistan Women’s Association তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় যার জেরে ১৯৫৬ সালে একই সময় তিনবার তালাক উচ্চারণকে তিন-তালাক নয় একবার তালাক ধরার আইন চালু হয়। শুধু তিনটি তুহর বা ঋতুমুক্ত সময় কাটানোর বাধ্যবাধকতা নয়, বৈবাহিক ও পারিবারিক কোর্ট (matrimonial and family court)-এর অনুমোদন ছাড়া তালাক আদৌ কার্যকরী হবে না। মৌলানা এহেতেশাম-উল-হক থানভি নামে জনৈক মৌলবি ও তাঁর মতো কিছু র্মবেত্তা এর তীব্র প্রতিবাদ জানালেও ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে Muslim Family Law Ordinance (MFLO) প্রবর্তিত হয়। Muslim Family Law Ordinance 1961 দ্বারা তিন তালাক নিষিদ্ধ করা হয়। আদালতে যথেষ্ট কারণ না দেখিয়ে তালাক দেওয়া যাবে না। ১৯৯৫ সালে Islamic Legal Reform: The Case of Pakistan and Family Law দ্বারা স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে আহত হয়ে মুমতাজ বিবিকে তালাক দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
এর দ্বারা তালাককে আদালতের রায় সাপেক্ষ করে তোলা হয়। এই আইনের তালাক সংক্রান্ত বিভাগ ৭-এর ৬টি উপধারা আছে:
Any man after pronouncing “talaq in any form” has to give notice to the Chairman of the Union Council (an elected local government body) informing him about it and also supply a copy to his wife.
Failure to do so could invite punishment up to one year jail or a fine of Rs 5,000.
A talaq will not be effective until the expiry of 90 days after the man had served notice to the chairman. Within 30 days of receiving the notice, the chairman is required to constitute an arbitration council for reconciling the couples. If the wife is pregnant, the talaq shall not be effective until the expiry of 90 days or the pregnancy, whichever is later;
“Nothing shall debar a wife whose marriage has been terminated by talaq effective under this section from marrying the same husband, without an intervening marriage with a third person, unless such termination is for the third time, so effective.”
এর ফলে তালাক-উল-বিদ্দত তো পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে যায়ই, আসান ও হাসান পদ্ধতিতেও আদালতের নির্দেশ বাধ্যতামূলক করা হয়। সর্বোপরি ৬ নং উপধারা দ্বারা ‘হালালা’ প্রথাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ডঃ মুনির ব্যাখ্যা করেছেন, “remarriage between the two parties after the divorce without an intervening marriage or halala, which, under section 7, becomes imperative following the third such pronouncement (of talaq).”
     ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে রূপান্তরিত হলে তারা মুসলিম পারিবারিক আইন অর্ডিনান্স বা MFLO উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে।

      বাংলাদেশ:
১৯৬১ সালে পাকিস্তান প্রণীত Muslim Family Law Ordinance (MFLO)-এর ভিত্তিতেই রচিত বাংলাদেশের পারিবারিক আইন বিধিমালা অনুযায়ী মুসলিম স্ত্রী তিনভাবে তালাক দিতে পারে– তালাক-ই-তৌফিজ়, খুলা ও আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ।
তালাক-ই-তৌফিজ - তালাক-ই-তৌফিজ (তালাক-এ-তাফউইজ়) হল স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে প্রদত্ত তালাক প্রদানের ক্ষমতা। স্বামী বিয়ের ফর্ম বা কাবিন নামায় স্ত্রীকে যদি বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষমতা অর্পণ করে থাকে, তাহলে স্ত্রীর বিচ্ছেদ চাইতে পারে। এই জাতীয় তালাকের নাম ‘তালাক-ই-তৌফিজ’। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের আশ্রয় ছাড়াই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। তালাক-ই- তৌফিজের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ ধারায় বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। স্ত্রী তালাকের নোটিস স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়ে তার এক কপি স্বামীর কাছে পাঠাবে। নোটিস প্রাপ্তির পরবর্তী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। এখন নিকাহনামার বা রেজিস্ট্রি ফর্মের বর্তমান ১৮ নাম্বার ঘরটি যদি কোনও পুরুষ পূরণ না করে অথবা কেবল সীমিত দু-তিনটি বা একটি ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা দিয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর তালাক দেওয়ার ক্ষমতাও সীমিত হয়ে যায়। তখন মেয়েদের জন্য বিকল্প একটি উপায় হল ‘খুলা’
খুলা: খুলা হল স্বামী এবং স্ত্রীর আলোচনা সাপেক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদ। স্বামীকে এভাবে বিচ্ছেদে রাজি করানোর দায়িত্ব স্ত্রীর; প্রয়োজনে স্ত্রী স্বামীকে কোনো কিছু বিনিময় প্রদান করবে। সাধারণত বিনিময় বা ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্ত্রী নিজের আর্থিক দাবির কোনো অংশ ত্যাগ করে থাকে। পুরুষটি রাজি হলে এভাবে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। খুলা তালাকের ক্ষেত্রে অন্য কোনও চুক্তি না থাকলে স্ত্রী মোহরানার হকদার হবে না; কিন্তু সে গর্ভবতী হলে ইদ্দত পালনকালে গর্ভের সন্তানের জন্য স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী এখানে প্রস্তাবক যেহেতু স্ত্রী, সেহেতু স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে তালাকের নোটিস পাঠানোর দায়িত্বও তার।
আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ: সম্পর্কের ইতি একান্ত জরুরি, কিন্তু তালাক-ই-তৌফিজ় বা খুলার মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটানোর উপায় নেই, এমন অবস্থায় মেয়েরা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। পারিবারিক আদালতে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে স্ত্রী তালাকের আবেদন করতে পারে। আদালতের ডিক্রিমূলে স্ত্রীর তালাক কার্যকর হবে। আইনস্বীকৃত কারণগুলি (হেতুবাদ)–  
১. চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
২. দুই বছর স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।
৩. স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি কারাদণ্ড হলে।
৪. স্বামী কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর যাবত দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫. বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
৬. স্বামী দুই বছর ধরে অপ্রকৃতিস্থ বা পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠরোগে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
৭. বিয়ে অস্বীকার করলে, অর্থাৎ যদি কোন‌ও মেয়ের অভিভাবক তাকে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে দেয় এবং সে ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে, তাহলে সে বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। তবে শর্ত হলো, মেয়েটির সঙ্গে স্বামীর দাম্পত্য সম্পর্ক (সহবাস) যদি স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনই কেবল বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাওয়া যাবে।
৬. স্বামী বহুবিবাহ করলে। অর্থাৎ স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
৭. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে। ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে – (ক) অভ্যাসগত আচরণে স্ত্রীকে দৈহিক বা শোচনীয় মানসিক আঘাত করা, (খ) অন্য কোনও খারাপ নারীর সঙ্গে জীবনযাপন বা মেলামেশা, (গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করা, (ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করা, (ঙ) স্ত্রীকে নিজস্ব ধর্মপালনে বাধা দেওয়া, (চ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, কিন্তু তাদের সঙ্গে পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুসারে সমান ব্যবহার করতে না পারা, (ছ) এছাড়া মুসলিম আইনে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য বৈধ বলে স্বীকৃত অন্য যে কোনো কারণে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে তালাক দাবি করতে পারে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, যে কোনও মানসিক নির্যাতনও অন্তর্ভুক্ত। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইনে ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন হাসিনা আহমেদ মামলায় আদালত মন্তব্য করেছেন যে স্ত্রীর অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করা হলে স্ত্রী আদালতে বিচ্ছেদ চাইতে পারবে। এমনকি হোসনে আরা বেগম মামলায় আদালত রায় দিয়েছিল, সচ্ছল পরিবার থেকে আনা গৃহকর্মে অনভ্যস্থ স্ত্রীকে প্রাত্যহিক গৃহকর্ম করতে বাধ্য করাটাও নিষ্ঠুরতা বলে গণ্য হবে।
তবে সব ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারেন। আদালত ডিক্রি দিলে পরবর্তী সাতদিনের মধ্যে একটি প্রত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউপি/ পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে পাঠাতে হবে। স্বামীর অবস্থান জানা না থাকলে মুসলিম বিয়ে-বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯-এর ধারা ৩ অনুসারে তার উত্তরাধিকারদের কাছে নোটিস দিতে হবে। স্বামীর চাচা ও ভাই থাকলে তারা উত্তরাধিকারী না হলেও অবশ্যই ঐ পক্ষভুক্ত হবে। ১৯৬১ সালের মুসলি পারিবারিক আইনের অধ্যাদেশ অনুযায়ী তালাকের নোটিস পাওয়ার পর চেয়ারম্যান আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। চেয়ারম্যানের নোটিস পাওয়ার ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে। গর্ভাবস্থায় বিচ্ছেদ হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। সে ক্ষেত্রে ৯০ দিন বা সন্তান প্রসব – যেটি পরে হবে, সেদিন থেকে তালাক কার্যকর থাকবে।
দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক ভারতের ১৯৩৭-এর শরিয়ত আইনেই (Shariat Act in 1937) মুসলিম মেয়েদেরকে তালাক দেওয়ার এই অধিকার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইনের (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939) দ্বারা মেয়েদের তালাক চাইবার ওপর কিছু শর্ত আরোপিত হয়। সেই আইনের ২ নং ধারায় কোন কোন কারণে একজন স্ত্রী আদালতে তালাকের আবেদন করতে পারবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। অবিভক্ত ভারতের সেই আইন, যা ভারতে উপেক্ষিত, তারই কিঞ্চিত বিবর্তিত রূপ বাংলাদেশে কার্যকর।
স্ত্রী তালাক দিলেও কি মোহরানা পাবে: স্ত্রী তালাক দিলেও মোহরানার টাকা তাকে দিতে হবে এবং তালাক কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ভরণপোষণ করতে হবে। তবে দাম্পত্য মিলন না ঘটলে এবং মোহরানা সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকলে স্ত্রী মোহরানার অর্ধেকের অধিকারী। ১৯৩৯ আইনের ৫ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, এই আইন দ্বারা কোনও বিবাহিত নারীর বিবাহবিচ্ছেদের ফলে মুসলিম আইনানুসারে তার প্রাপ্য দেনমোহর বা তার কোনও অংশের ওপর কোনও অধিকারই প্রভাবিত হবে না। তবে আগের উল্লেখ থেকে দেখা যাচ্ছে, খুলা তালাকে স্ত্রীকে মোহরানার দাবি ছাড়তে হয়।
আইন অধিকার দিলেও তা বলবৎ হওয়া যেহেতু নির্ভর করে পুরুষশাসিত সমাজের ওপর, তাই পরবর্তীকালে ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রীকরণ) আইন, ১ঌ৭৪’ দ্বারা মেয়েদের সুরক্ষার্থে পুরুষের বহুবিবাহ ও পুরুষপ্রদত্ত তালাকের ওপর নানা শর্ত চাপানো হয়। সংশ্লিষ্ট অংশগুলি অসম্পাদিতরূপে উদ্ধৃত করছি –  
৬৷ বহু বিবাহ (Polygamy):
(১) সালিশী পরিষদের লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া কোন ব্যক্তি একটি বিবাহ বলবত থাকলে আরেকটি বিবাহ করতে পারবে না এবং পূর্ব অনুমতি গ্রহণ না করে এই জাতীয় কোন বিবাহ হলে তা মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪ (১৯৭৪ সনের ৫২নং আইন) অনুসারে রেজিষ্ট্রি হবে না।
(২) (১) উপ-ধারায় বর্ণিত অনুমতির জন্য নির্দিষ্ট ফিস্‌সহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে এবং আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত বিবাহের কারণ এবং বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্মতি নেওয়া হয়েছে কিনা, তা উল্লেখ করতে হবে।
(৩) উপরোক্ত (২) উপ-ধারা মোতাবেক আবেদনপত্র পাওয়ার পর চেয়ারম্যান আবেদনকারী এবং বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের প্রত্যেককে একজন করে প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে বলবেন এবং এইরূপে গঠিত সালিশী পরিষদ যদি মনে করেন যে, প্রস্তাবিত প্রয়োজন এবং ন্যায়সঙ্গত, তা হলে কোন শর্ত থাকলে উহা সাপেক্ষে, প্রার্থিত বিবাহের অনুমতি মঞ্জুর করতে পারেন।
(৪) আবেদনটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সালিশী পরিষদ সিদ্ধান্তের কারণসমূহ লিপিবদ্ধ করবেন এবং যে কোন পক্ষ, নির্দিষ্ট ফিস জমা দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট মুন্সেফের নিকট রিভিশনের (Revision) জন্য আবেদন দাখিল করতে পারবেন এবং সালিসী পরিষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং কোন আদালতে উহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
(৫) সালিশী পরিষদের অনুমতি ছাড়া কোন ব্যক্তি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে (ক) অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের “তাত্ক্ষণিক” অথবা “বিলম্বিত” দেনমোহরের (Prompt or deferred dower) যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে এবং উক্ত টাকা পরিশোধ করা না হলে উহা বকেয়া ভূমি রাজস্বের ন্যায় আদায়যোগ্য হবে। (খ) অভিযোগক্রমে দোষী সাব্যস্ত হলে সে এক বত্সর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।”
৭৷  তালাক (Talaq):
(১) কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, তিনি যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের একটি অনুলিপি (নকল) প্রদান করবেন।
(২) কোন ব্যক্তি (১) উপ-ধারার বিধান লংঘন করলে তিনি এক বত্সর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডনীয় হবেন।
(৩) নিম্নের (৫) উপধারার বিধান অনুসারে প্রকাশ্যে বা অন্য কোনভাবে তালাক, আগে প্রত্যাহার করা না হয়ে থাকলে, (১) উপধারা মোতাবেক চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কার্যকরী হবে না।
(৪) উপরোক্ত (১) উপধারা অনুযায়ী নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এই জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
(৫) তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে, (৩) উপধারায় বর্নিত সময়কালে অথবা গর্ভাবস্থা, যেটি পরে শেষ হয়, অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবত হবে না।
(৬) অত্র ধারা অনুযায়ী তালাক দ্বারা যে স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে সেই স্ত্রী, এই জাতীয় তালাক তিনবার এইভাবে কার্যকরী না হলে, কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে বিবাহ না করে পুনরায় একই স্বামীকে বিবাহ করতে পারবে।”
৮৷ তালাক ছাড়া অন্যভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ (Dissolution of marriage otherwise than by talaq): যেক্ষেত্রে তালাক দেয়ার অধিকার যথাযথভাবে স্ত্রীকে অর্পণ করা হয়েছে এবং স্ত্রী সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক বা স্ত্রী তালাক ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে চাহে, সেক্ষেত্রে ৭ ধারার বিধানাবলী প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ যথাসম্ভব প্রযোজ্য হবে।”
৯৷ ভরণ-পোষণ (Maintenance): (১) কোন স্বামী তার স্ত্রীকে পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণ বা খোরপোষ দানে ব্যর্থ হলে বা একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে তাহাদিগকে সমভাবে খোরপোষ না দিলে, স্ত্রী বা স্ত্রীগণ কেহ, অন্য কোন আইনানুগ প্রতিকার প্রার্থনা ছাড়াও চেয়ারম্যানের নিকট দরখাস্ত করতে পারেন। এইক্ষেত্রে চেয়ারম্যান বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং ঐ পরিষদ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ বাবদ প্রদানের জন্য টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে সার্টিফিকেট জারী (ইস্যু) করতে পারবেন।
(২) কোন স্বামী বা স্ত্রী নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান পূর্বক ঐ ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট খানা পুর্নবিবেচনা জন্য সংশ্লিষ্ট মুন্সেফের নিকট আবেদন করতে পারবেন এবং তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং কোন আদালতে এই সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
(৩) উপরের (১) অথবা (২) উপ-ধারা মোতাবেক দেয় কোন টাকা যথাসময়ে বা সময়মত পরিশোধ করা না হলে বকেয়া ভূমি রাজস্ব হিসাবে আদায় করা চলবে।”
১০৷ দেনমোহর (Dower): নিকাহনামা বা বিবাহের চুক্তিতে দেনমোহর পরিশোধের পদ্ধতি নির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত না থাকলে, দেনমোহরের সমগ্র অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য (দেয়) বলে ধরে নিতে হবে।”
          একমাত্র ৪ নং ধারা অনুযায়ী বিবাহিতা মুসলিম মহিলা ধর্মান্তরিত হলে আদালতের রায় ছাড়া বিচ্ছেদ পাবে না। অন্য ধর্মের মহিলা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়ার পর নিজের ধর্মে ফিরে গেলেও মুসলিম আইনের সুরক্ষা তার জন্য প্রযোজ্য নয়।
          প্রসঙ্গত বাংলাদেশে যেখানে বহু তৎসব ও তদ্ভব এমনকি দেশী শব্দকেও এলোপাতাড়ি আরবি ফার্সি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে বাংলা লেখা হয়, সেখানে ‘স্বামী’ নাম আধিপত্যবাচক সংস্কৃত শব্দটি তাদের আইনি কেতাবে জ্বলজ্বল করছে। সবই অ্যান্ড্রোজেনের কৃতিত্ব! তাছাড়া চেয়ারময়্যান, সালিশি পরিষদ, মুন্সেফ পুরো ব্যবস্থাটাই পুরুষপ্রধান হওয়ায় মেয়েদের সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা – সে অন্য প্রশ্ন।
কিন্তু যাই হোক দেখা যাচ্ছে,  ‘সুন্নি’ বিশ্বাসের দেশ হয়েও পকিস্তান বা বাংলাদেশের পক্ষে আইন সংশোধন সম্ভব হয়েছেকিন্তু ভারতে এই বিষয়টা নিয়ে ‘সংখ্যালঘু’ আবেগে (পুরুষালি অবশ্যই) মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শকাতরতাতাই যুক্তি মানলেও আইন সংস্কার মেনে নিলে যে ধর্মীয় পরিচয় আঁকড়ে অস্তিত্ব জাহির, তার যেন নৈতিক পরাজয়। এইখানে একটা সুবিধা প্রগতিশীল মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পায়, তা হল আত্মসংশোধন করতে গিয়ে তারা পরধর্মে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযুক্ত হয়না, যেটা ভারতের মতো বহু জাতিক, ভাষিক ও ধর্মাবলম্বী দেশের কাছে একটা দুর্লঙ্ঘ্য সমস্যা।
বাস্তবে ভারতে মুসলিমরা আদৌ সংখ্যালঘু নয়, দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু। কিন্তু মুসলিমরা যেখানে প্রকৃতই সংখ্যালঘু, মাত্র ১০% সেই শ্রীলঙ্কাতেও Sri Lanka’s Marriage and Divorce (Muslim) Act, 1951-র ২০০৬-এ আইন সংশোধন দ্বারা তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়ে যায়কারণ এই আইন অনুযায়ী বিচ্ছেদকামী পুরুষটিকে কাজির কাছে লিখিত নোটিস দিতে হয়। কাজি ৩০ দিন ধরে দুজনের মধ্যে মিটমাটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে কাজি ও আরও দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে পুরুষটি একতরফা তালাক দিতে পারেশরিয়া অ্যাকাডেমির অধ্যাপক ডঃ মুহম্মদ মুনিরের মতে তিন-তালাকের আদর্শতম বিধি (“most ideal legislation on triple talaq”) শ্রীলঙ্কাতেইলক্ষ্যনীয় এই আদর্শতম নিয়মও কিন্তু কোরানের তিন চান্দ্রমাসের নিয়মের অনুসারি নয়, আইনের চোখে যা যুক্তিপূর্ণ মনে হয়েছে তার ভিত্তিতে। মানে কোরানের নির্দেশের একটু আধটু রদ-বদলকে শরিয়া অ্যাকাডেমিই আদর্শ বলে মান্যতা দিয়েছে। অর্থাৎ শরিয়তি আইন পরিবর্তন করা যায় ভারতীয় ইসলামি পণ্ডিতদের মতেই।
প্রসঙ্গত এই তালাক আইন সংশোধনের সঙ্গে মৌলবাদী ও জঙ্গি কার্যকলাপের কোনও সম্পর্ক বা বিরোধ নেই। মিশর, ইরান বা সিরিয়ার মতো দেশ যেখানে অনেক আগেই ‘তালাক-উল-বিদ্দত’ খারিজ করেছে, ইদানিং সেসব দেশেই আবার কীভাবে মৌলবাদ ও সন্ত্রাস এত ভয়ানকভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, সেটা অন্য প্রশ্ন। হয়তো প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিলেই রক্ষণশীলদের ক্ষোভ ও তৎপরতা বাড়ে যার প্ররোচনা দেশের বাইরে থেকেও সরবরাহ করা যায়। তবে ইসলামি আইন সংশোধনের ফলে যে তা হয়নি তা জোর দিয়ে বলা যায়; হলে তুরস্কই হোত মৌলবাদের প্রজনন ভূমি।
অন্যদিকে একটা ব্যাপার লক্ষনীয়, যে সময়টায় (১৯৭৪) বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন রচিত হয়ে মহিলাদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, প্রায় সেই সময়ই (১৯৭৩) বাংলাদেশের সারোগেট মাদার ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার তাগিদে All India Muslim Personal Law Board  (AIMPLB) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! ভারতবর্ষে বিচ্ছিন্নভাবে তালাক সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় কিছু সদর্থক রায় হয়তো বেরিয়েছে, কিন্তু  সেগুলোকে সাংবিধানিক শীলমোহর দেওয়া যায়নি। ১৯৮৬-র শাহবানু মামলায় শাহবানু আদালতের রায়ে বরের কাছ থেকে খোরপোষের লাভের অধিকার পেলেও মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের চাপে তাকে আইনে পরিণত করা যাচ্ছিল না। দেশ জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ও আরিফ মহম্মদ খানের মতো সাংসদের সদিচ্ছায় শেষ পর্যন্ত সংসদে ‘মুসলিম মহিলা বিল’ নামে এক সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করানো গেলেও তাতে তালাক প্রাপ্ত মহিলাদের মেয়াদি ক্ষতিপূরণের দাবির কথা অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছিল। পরে দানিয়াল লতিফি মামলায় সুপ্রীম কোর্টে পুনরায় শাহবানুর ক্ষেত্রটি উত্থাপিত হলে ইদ্দদের সময়সীমার পরেও খোরপোষ পাওয়ার আইনি অধিকার লাভ করে মুসলিম মহিলারা। কিন্তু তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ তখন পর্যন্ত ওঠেনি, আন্দোলন হয়নি হালালার বিরুদ্ধেও।
তারপর থেকে সামাজিক ও গার্হস্থ্য হিংসা গত কয়েক দশকে বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে, বেড়েছে মেয়েদের অসম্মান করার সামগ্রিক প্রবণতা। অন্যদিকে মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বেড়েছে মাত্রাহীন। সব মিলিয়ে তিন তালাক ও হালালা উপসর্গ আরও ডালপালা মেলেছে যেখান থেকে মুক্তির তাগিদ অনুভূত হয়েছে বারবার। ২০০৮ সালে মাসরুর আহমেদ বনাম রাজ্য মামলায় দিল্লি হাইকোর্টের মুসলিম বিচারপতি বদর দুরেজ আহমেদ এক ধাক্কায় তিনবার তালাক উচ্চারণকে একবার হিসেবে গণ্য করার পক্ষে রায় দেন। জিয়াউদ্দিন বনাম আনওয়ারা বেগম মামলাতে গুয়াহাটি হাইকোর্টও তালাকের পেছনে যথেষ্ট কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়কিন্তু সে সব রায় বা নির্দেশ বলবৎ করার মতো আইনের অভাবে কার্যকর হয়নি কিছুই।
আসলে বৃহত্তর আইন সংশোধনীর ব্যাপারে পুরুষ শাসিত মুসলিম সমাজ তো বটেই, সেই সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক বাতাবরণও বিস্ময়কর অনীহা দেখিয়ে এসেছে। এখানকার মৌলবি নির্ভর বৃহত্তর মুসলিম সমাজ ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে বৌকে খেদিয়ে দেওয়া, আর ইচ্ছা হলে ‘হালালা’ করিয়ে ফিরিয়ে আনা অনৈস্লামিক প্রথাকেই আল্লাহ্‌র নির্দেশ প্রসূত কোরানের বাণী বলে জানে। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (MPLB) সযত্নে এই ভ্রান্তিকে জিইয়ে রেখেছে এবং তা দেশের ব্যালট গণতন্ত্রের সস্নেহ প্রশ্রয়েই
‘বিয়ের প্রথম রাতে বেড়াল মারা’র প্রবচনটি মনে পড়ে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাবি পুরণ করার পরেও যখন অবশিষ্ট ভারত ভূখণ্ডের সংবিধান রচনার সময় সব নাগরিকের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ অভিন্ন আইন নিশ্চিত করা যায় না, তখন সেই কাজটা পরবর্তীতে আরও দুরূহ হয়ে ওঠে। একবার নতি স্বীকার করলে বারবার করতে হয় এবং নতিস্বীকারটাই জাতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে। 





প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ: শাহবানু মামলা

মেয়েদের জন্য সামাজিক সংস্কারের পথে বহু ক্ষেত্রে মেয়েদেরকেই খুব একটা পাশে পাওয়া যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বিধবা বিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবীর সদর্থক ভূমিকা ছিল না, যদিও মানুষকে দান ধ্যান সাহায্যের বেলা তিনি বরাবর পুত্রকে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিতেন। পুত্রবধূ দিনময়ীকে পুত্র অক্ষর পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলে মা ভগবতীদেবী সেই অনাচার কিছুতেই মানতে না পেরে রীতিমতো বিদ্রোহ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের ছেলে নারায়ণচন্দ্র বিধবা কিশোরীকে বিয়ে করতে চাইলে তিনি সোৎসাহে সম্মতি দিলেও পরিবারে মূলত মা ও স্ত্রীর প্রবল আপত্তির কারণে গ্রামের বাড়িতে বিবাহ বাসর বসানো যায়নি। কলকাতায় কালীচরণ ঘোষের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন করতে বাধ্য হন বিদ্যাসাগরবরের মা বা ঠাকুমা কেউ উপস্থিত না থাকায় বধূবরণ করাতে হয় তারানাথ তর্কবাচস্পতির স্ত্রীকে দিয়ে। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ব্যবস্থাপনা সমাজে কায়েম রাখা যায় মূলত মেয়েদের অন্ধ আনুগত্যের সাহায্যেই।
Description: RAjiv GandhiText Box: রাজীব গান্ধীএকই ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল নাজমা হেপতুল্লাকে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়২৩ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে সুপ্রীম কোর্ট তালাকপ্রাপ্ত শাহবানুর আবেদনের ভিত্তিতে তার তালাক দানকারী বরকে ১৭৯ টাকা মাসোহারা দেওয়ার নির্দেশ দেয় সহায়সম্বনহীন স্ত্রীর ভরণ-পোষণের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা হলেও ভারতীয় আইনের ১২৫তম ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি হিসেবে মামলা রুজু করা হয়েছিল, যে ধারা সামাজিকভাবে অসহায় নিরাশ্রয় নির্ভরশীল আত্মীয়কে নিরাপত্তা দানের জন্য তৈরিএই ধারাটি আসলে ফৌজদারি আইনের (CrPC [Criminal Procedure Code] ) ৪৮৮ সেকশন বা ধারার একটি উপধারা ছিল যা আদৌ বৈবাহিক অধিকার রক্ষা বা ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত আইন নয়। এই আইন মোতাবেক কোনও পরিত্যক্ত ঘনিষ্ আত্মীয় তা সে মা, বাবা, কন্যা যেই হোক যদি জীবনধারণের ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর না হয়, তাহলে দিনানিপাতের উদ্দেশ্যে পরিত্যাগী আত্মীয়ের কাছ থেকে সামান্য খরচপত্র পাওয়ার দাবিতে আদালতে আবেদন করতে পারে। ১২৫ নং ধারায় প্রাথমিকভাবে অসহায় আত্মীয়ের তালিকায় স্ত্রীর কথা ছিলই না, মূলত সন্তান পরিত্যক্ত মা-বাবা বা পিতা পরিত্যক্ত শিশুর কথা ভেবেই এই আইন। শাহবানুর ক্ষেত্রটা বিবেচনা করে স্ত্রীকেও অনুরূপ বিপন্ন আত্মীয়ের মধ্যে শামিল করা হয়আদালত সবদিক বিচার করে দায়িত্ব এড়াতে চাওয়া ব্যক্তিকে ভরণপোষণ ভাতা (maintenance allowance) দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে, যার সর্বোচ্চ পরিমাণ সেই সময় মাসিক ৫০০ টাকার বেশি ছিল না
বস্তুত অসহায় মানুষকে সাহায্য করা, গরিবকে জাকাত বা দান করা ইসলামে পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হলেও রায় বেরোনো মাত্র ‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’ সেটাকে ইসলাম বিরোধী হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চাইল। অসহায়কে দয়া দেখানো হবে কিনা সেটা তাদের ব্যক্তিগত সাম্প্রদায়িক ব্যাপার, দেশের আদালতের কোনও এক্তিয়ার নেই সেখানে মাথা গলানোর বা ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে বিচার করারএতে ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে।
কিন্তু রাজীব গান্ধীর মন্ত্রীসভার তরুণ সদস্য আরিফ মহম্মদ খান আদালতের রায়কে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সংসদে তা রক্ষার বহু চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, “...it must not be lost sight of that the Constitution guarantees freedom of religion to each person and not to the communities and it does not accept any self-appointed group as the sole spokesman of any religion. In fact, the moment you give such recognition to one group, you deny freedom of religion to all others who do not agree with the understanding and interpretation by this group. I think this was the basic mistake which we committed in 1986, when we ignored the opinion of many leading Muslim scholars and accepted the views of the MPLB as the basis for the legislation to overturn the Supreme Court judgment.” অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা কোনও একদল মুষ্টিমেয় মানুষ স্থির করতে পারে না। কোনও নির্দিষ্ট সংস্থা বা গোষ্ঠীকে সেই অধিকার দেওয়া মানে যারা তাদের সঙ্গে সহমত নয় এমন অনেকের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করা। ১৯৮৬-তে বিদগ্ধ মুসলিমদের মত উপেক্ষা করে MPLB-র দৃষ্টিভঙ্গিতে আদালতের রায় অমান্য করে আইন প্রণয়ন করাটাই তাঁদের সরকারের মস্ত ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন প্রাক্তন কংগ্রেস মন্ত্রীআরিফ মহম্মদের মতে ধর্মের নাম করে ভারতীয় নারী সমাজের একটা বড় অংশকে ফৌজদারি বিধির ১২৫ নং ধারা দ্বারা প্রদত্ত নিরাপত্তা ও সুবিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছেতিনি জানিয়েছেন ধর্মীয় স্বাধীনতা না লিঙ্গ সাম্য এই অগ্রাধিকার স্থির করা সম্ভব হয়নি মন্ত্রীসভারই অনেক সদস্যের চাপে, যার ফলে পার্সোনাল ল বোর্ডের অনুমতিক্রমেই মুসলিম মহিলা আইন Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) পাস করাতে হয়েছিল; কয়েকজন মুসলিম বিদগ্ধ পুরুষের সমর্থন পেয়েও ঠিক মতো কাজে লাগানো যায়নি
শাহবানু
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শাহবানু মামলার সঙ্গে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সংঘাতের কোনও জায়গাই ছিল না। আইনজীবী স্বামী বিয়ের ৩০ বছর পর স্ত্রী শাহবানুকে হঠাৎ পরিত্যাগ করে। বছর তিনেক পর যখন শাহবানু আদালতের কাছে নিজের ভরণ পোষণ তথা জীবন ধারণের উপায় খুঁজতে মামলা করে, তখন তার মিঞা তিন মাসের খোরপোষের কড়ারে তিন তালাক দিয়ে দায় চোকাতে চায়শাহবানু বিদ্রোহ করেনি, বাঁচার জন্য সাহায্য চেয়েছিল মাত্র। ফৌজদারি ১২৫ নং ধারায় রুজু এই মামলার মীমাংসায় সুপ্রীম কোর্ট সেই সময় মাত্র ১৭৯ টাকা মাসিক ভাতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল শাহবানুর স্বামীকে। এই ধারা পরিত্যক্তের উত্তরাধিকার বা সম্পত্তিতে অধিকারের কথাও কিছু বলে না। সুতরাং সেটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু ছিল না।
১৯৭৩ পর্যন্ত বিষয়টা ছিল এমন ফৌজদারি সেকশনে যার অধীনে বিবাহ বিচ্ছিন্না স্ত্রীর কথা ছিল না; শাহবানু মামলার পরেই স্ত্রীর প্রতিও এই মানবিক কর্তব্যের আইনটি বলবৎ করা হয়। সম্প্রদায় নির্বিশেষে যখন তখন বিবাহিতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার চল আছে এই দেশেই। যখনই মেয়েরা অসহায় হয়ে আইনের দ্বারস্থ হয় তখন পুরুষরা তড়িঘড়ি বিবাহ বিচ্ছেদের পাল্টা মামলা ঠুকে দেয়। এই অবিচার অনাচার ঠেকাতেই ১২৫ নং ধারার অবতারণা যার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েমের অ্যাজেন্ডাও নেই
কিন্তু তৎকালীন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের চেয়ারম্যান মৌলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলি ওরফে ‘আলি মিঞা’ শাহবানু মামলার এই রায়কে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বিপজ্জনক বলে চিৎকার শুরু করেন। অথচ নিজের রচিত বইগুলিতে বারবার প্রমাণ করতে চেয়েছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের শত্রু’তাঁর কাছে আদর্শ হলেন জিয়া-উল-হল যিনি পাকিস্তান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষীণতম সম্ভাবনা দূর করেছিলেন এবং অনুসরণীয় ছিল সৌদি খিলাফতি শাসন। আলি মিঞার দু-মুখো অবস্থান যতই হাস্যকর হোক, সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের দ্বারাই চালিত হয়েছিল। লেখক আসগর আলি জানিয়েছেন, শাহবানু মামলার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানায় বিহারের সিওয়ানে লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয়ে। এই সমাবেশ মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড আয়োজন করেনি, করেছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু সিওয়ান জনসমাবেশ বোর্ডকে বার্তা দিতে পেরেছিল আন্দোলন হলে মুসলিম জনমতকে উত্তেজনা ছড়াতে একত্রিত করা যাবে
সুপ্রীম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে সংসদে আরিফ শানিত বক্তৃতা রাখেন। তাঁর মতে এই রায় ইসলাম বিরোধী তো নয়ই বরং ইসলাম মতে ‘ঈশ্বরের প্রতি সুন্দর ঋণ’ (“beautiful loan to God”)তাঁর বক্তৃতাকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী যথেষ্ট প্রশংসা করেন যেটা রাজীবের মতো তরুণ আধুনিক মনস্ক নেতার থেকে প্রত্যশিত ব্যাপার ছিল। বরং বিস্ময়কর ছিল রাজীবের পশ্চাদপসরণটাই। আর নেপথ্যের কারণটাও কম বিস্ময়কর নয়
MPLB-র তথা মুসলিম উলেমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ হচ্ছে বলে ক্ষেপে ওঠা ও লাগাতার চাপ সৃষ্টি করাটা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল নাতাদের বক্তব্য শুধু ‘ইদ্দত’-এর সময় যার ব্যাপ্তি মোটামুটি ৯০ দিন, সেই পর্যন্ত খোরপোষ দেওয়া শরিয়তের বিধান প্রতিশ্রুতি মতো দেনমোহর ও উপহার সামগ্রী ফিরিয়ে দিলে তিন মাস পরে বিবাহ বিচ্ছিন্ন পুরুষটির আর কোনও দায়িত্ব থাকে নাসহায় সম্বলহীন স্ত্রী বা আত্মীয়কে সাহায্য করা ইসলাম মতে প্রশংসনীয় হলেও বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু ভারতীয় দেওয়ানি আইনে বিচ্ছিন্ন স্ত্রী পুনরায় বিবাহ না করলে পুরুষটিকে স্ত্রীর জীবদ্দশায় অনির্দিষ্টকাল ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হয়।
আরিফ মহম্মদ খানের ভাষায়, “We are nowhere close to implementing a Uniform Civil Code; in fact, in the course of time, we have only moved in the opposite direction. According to the Directive Principles of State Policy, Article 44, the State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India. The founding fathers were acutely aware that we need to do lot of groundwork, like providing education and imparting a sturdy sense of security. Because it is only a well informed and confident populace that can save itself from becoming victim of the slogans like “religion in danger” and can move forward to realise the constitutional dreams into reality.অভিন্ন দেওয়ানি আইন বলবৎ করতে না পারা নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ ও হতাশা ফুটে ওঠে তাঁর লেখনীতে। প্রকৃত শিক্ষার অভাবেই যে ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ বাধর্ম বিপন্ন জাতীয় স্লোগান ওঠে, সেটাও বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। তারপরেও কিছু নেতা ও নেত্রীর প্ররোচনায় মুসলিম মহিলা বিল প্রস্তাবিত হয় শাহবানু মামলার রায়কে উপেক্ষা করে। পরে বিরোধী জনমত ও আরিফ মহম্মদদের মতো কিছু মানুষের চাপে সেটা কিছুটা সংশোধিত হয়ে Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act, 1986 নামে পাস হলেও তাতে মেয়েদের যথেষ্ট সুরক্ষা দেওয়া যায়নি
নাজমা হেপতুল্লা
কিন্তু যেটা বিস্মিত করেছিল তা হল তৎকালীন ডেপুটি স্পীকার নাজমা হেপতুল্লার ভূমিকা যিনি ছিলেন পার্সোনাল ল বোর্ড ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার দায়িত্বে। সেই নাজমা ২০০৪ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য হয়ে ২০০৭-এ দলের সহ-সভাপতিত্ব লাভ করেন এবং ২০১৬ থেকে মণিপুরের রাজ্যপাল হিসাবে নিয়োজিত হন। এই মুহূর্তে তিনিও তালাক-এ-বিদ্দত বিরোধী মুসলিম নারীমুক্তির একটি পরিচিত কণ্ঠ, কারণ তাঁর দলের সরকার মুসলিম মহিলাদের তিন তালাকের অভিশাপ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাচ্ছে! অথচ এক সময় আলি মিঞা নিজের আত্মজীবনীতে শাহবানু রায়ের বিপক্ষে সফল ঘৌঁট পাকানোর জন্য নাজমা হেপতুল্লাকে পূর্ণ কৃতিত্ব দিয়েছেন
যদিও পরিবেশ মন্ত্রী জাফর আলি আনসারির নামও জড়িয়েছিল রাজীবকে প্রভাবিত করানোর নেপথ্যে, তবে নাজমাই বোর্ডের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকগুলো আয়োজন করতেন যার দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করা গিয়েছিলপ্রাক্তন মন্ত্রী সি কে জাফর শরিফও বৈঠকে থাকতেন, তবে ইসলামিক আইন সম্পর্কে তাঁর বিশেষ ধ্যান ধারণা ছিল না। শুধু আলি মিঞা যখন বলছেন তখন তা অভ্রান্ত এই বিশ্বাসের জোরে বোর্ডকে অযৌক্তিক সমর্থন দিয়ে গেছেন। এঁরা ছাড়াও আর এক নেত্রীও বোর্ডের পক্ষ অবলম্বন করেন যাঁর নাম আবিদা আহমেদ। মজার কথা, পার্লামেন্টে আরিফকে বক্তৃতার জন্য অভিনন্দন জানানোর আট দিনের মধ্যে নাজমা হেপতুল্লা মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের হয়ে ময়দানে নেমে পড়েন। নাজমা ও আবিদার মতো দুই উচ্চপদস্থ মুসলিম নারী যখন আদালতের রায়ের বিপক্ষে নারীবিদ্বষী মৌলবাদী শিবিরকে সমর্থন দেন তখন আসন্ন একবিংশ শতাব্দীর স্বপ্ন দেখানো রাষ্ট্রনায়কের পক্ষেও এগোনো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে আরিফের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এনডি তিওয়ারি, অর্জুন সিং প্রমুখ হিন্দু কংগ্রেসি নেতাদের ওপর যাঁরা রাজীবকে বুঝিয়েছিলেন, মুসলিমরা পিছিয়ে থাকতে চাইলে হিন্দুদের কী দায় পড়েছে তাদের জন্য ঝামেলা পোয়ানোর। আরিফের অভিযোগ একই অবস্থান পরবর্তীকালে দিগ্বিজয় সিং সহ বহু ‘সেকুলার’ নেতার। যদিও তিনি মানেন সম্প্রদায়টি নিজেদের দোষেই নিজেরা পিছিয়ে আছে, কিন্তু নির্বাচনে তাদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য দেশের নেতারাও যে তাদের শিক্ষা বিকাশ বা প্রকৃত উন্নয়ন চায়নি, এটাও তো ঘটনা। বস্তুত মানুষ শিক্ষিত হলেই নিজস্ব মতাদর্শ তৈরি হবে, আর তাহলে ধর্মের নামে তাদের ভোট এককাট্টা করা মুশকিল হবে। একই সঙ্গে আরিফ মহম্মদ এটাও স্বীকার করেন, হিন্দু নেতারা মুসলিম সমাজের গোঁড়ামি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসাবে চিহ্নিত হতে হবে, যেটা তথাকথিত ‘সেকুলার’ ভারতীয় রাজনীতিতে সেই সময় ছিল বিপজ্জনক। আরিফের কথাটা আজকের দিনেই সমান সত্য।
আরিফ মহম্মদ খানের কাছে আরও জানা যায়, আধুনিক ইসলামিক আইন বিশারদ অধ্যাপক তাহির মেহমুদ ও কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও জামিয়া মিলিয়ার ইসলামিক শিক্ষার প্রধান অধ্যাপক মুশিরুল হকের সঙ্গে তিনি দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। দুজনেই আরিফের প্রশ্নের জবাবে বলেন দীর্ঘ সহবাস করা সঙ্গিনীর ভরণপোষণের আংশিক দায়িত্ব (১২৫ নং ধারা অনুযায়ী প্রদেয় হাতখরচ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা) বাধ্যতামূলক করার মধ্যে মোটেই ইসলাম বিরোধিতা নেই, বরং তা কোরানের মহৎ বাণীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। প্রসঙ্গত প্রফেসর হক-কে মরতে হয়েছিল সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে। কোরান শরিয়ত ব্যাখ্যা করার ভার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হাত থেকে ক্রমশ সন্ত্রাসবাদী নিয়ন্ত্রিত মৌলবাদীদের হাতে চলে গেল। বোর্ডের কাছে গোঁয়ার্তুমি ছাড়া যুক্তি ছিল না। কিন্তু যুক্তির চেয়ে অন্ধবিশ্বাসের পাল্লা ভারি হয়, কারণ তাতে মাথা ঘামানোর দায় থাকে না। কোরানের সদর্থক ব্যাখ্যার চেয়ে তাকে বিকৃত করে মানুষকে খেপানো অনেক সহজ।
একদিকে দেওয়ানি আইন ও শরিয়তকে আলাদা রাখতে কংগ্রেসের মুসলিম নেতা-নেত্রীদের চাপ, অন্যদিকে দুই বরিষ্ঠ হিন্দু কংগ্রেস সাংসদ পি ভি নরসীমা রাও এন ডি তেওয়ারির পরামর্শ মুসলিম সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব নেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলত রাজীবের কাছে সম্মিলিত পরিস্থিতির সামনে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় ছিল না।
শেষ পর্যন্ত আইনমন্ত্রী অশোক সেন যে খসড়া বিল পেশ করেন তার ৩য় সেকশনে ছিল “reasonable and fair provision to be made and paid within the period of iddat অর্থাৎ বিলে MPLB-র সুরে সুর মিলিয়ে শুধু ইদ্দতের মাস তিনেকের জন্য দায়িত্ব বহন নয়, বরং কৌশলে ইদ্দতকালের মধ্যে সারা জীবনের হিসেব নিকেশটাও স্থির করে ফেলার নির্দেশ উপ্ত ছিল। আরিফের আশঙ্কা ছিল বোর্ড কি এটাও মানবে? অশোক সেন জানান ওরা মেনে নিয়েছে এবং আরিফ নীরবতা পালন করলে বিল পাসও হয়ে যাবে, কারণ দু একজন শিক্ষিত ইসলাম বিশারদ ছাড়া ঐ সূক্ষ্ম তফাৎ বোর্ডের মৌলবি উলেমারা ধরতে পারবে না। তবে ঐ ভাষার কৌশলটুকুই সার হল, ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল আইনটা কার্যত নখদন্তহীন ব্যাঘ্রের মতো বলহীন।
এই বিলের উপদেষ্টা ছিলেন সালমান খুরশিদ, প্রফেসর মেহমুদ এবং সর্বোপরি এম এ আহমদি যিনি পরে ভারতের ২৬তম প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তবে এখনও রহস্য নাজমা নিজে নারী হয়ে এবং একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ অংলকৃত করেও কেন এমন নারী বিদ্বেষী ধর্মান্ধতার হয়ে ওকালতি করেছিলেনবরং লক্ষ্যণীয় সে সময় রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের ভূমিকা ছিল অনেক সদর্থকসেটা বিরোধিতা করার জন্যই কিনা জানি না, তবে তার জেরে প্রাথমিক বিলটির কিছুটা সদর্থক সংশোধন ঘটে। পরে দানিয়াল লতিফি মামলায় সুপ্রীম কোর্টে পুনরায় শাহবানুর ক্ষেত্রটিও উত্থাপিত হয়। তারপর থেকে ইদ্দতের সময়সীমার পরেও খোরপোষ পাওয়ার আইনি অধিকার লাভ করে মুসলিম মহিলারাকিন্তু পরবর্তীতে তালাক-এ-বিদ্দত উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে সরলতর পদ্ধতি খুঁজে নিয়ে ফোন এসএমএস ইত্যাদিকেও মাধ্যম করে বিয়ে ও বিচ্ছেদ দুটোকেই পরিহাস করে তুলেছে, অবশ্যই খুব নিষ্ঠুর পরিহাস।
তলিয়ে দেখলে তখন পর্যন্ত পার্সোনাল ল বোর্ডের দাবি ততটা অমানবিক ছিল না, শরিয়ত বিরোধী তো নয়ইপ্রতিশ্রুত দেনমোহর ফেরত দেওয়া বা শরিয়ত নির্দেশিত ‘ইদ্দত’ কালের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে কিন্তু তখনও মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড অস্বীকার করেনি। আপত্তি ছিল বাড়তি মানবিকতা দেখানোর আইনি বাধ্যবাধকতায়। কেউ দেখালে তার ব্যক্তিগত উদারতা, কিন্তু তার জন্য কোনও আইনি দায় থাকতে পারে না। এক নিশ্বাসে তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণের হয়ে ওকালতিও শাহবানু মামলা সূত্রে উঠে আসেনি। কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীতে ২০১৮-র দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের সপক্ষে কিম্ভূত যুক্তিতে গগন বিদারণ শুনতে হচ্ছে, হালালার মতো অশ্লীল প্রথা অবসানের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

  



দেওবন্দ্ ফতোয়া: এক ঐতিহাসিক ব্যতিক্রম

উত্তরপ্রদেশের ইসলাম সেমিনারি ‘দারুল-উল্‌ম-দেওবন্দ্‌’ (Darul Uloom Deoband) হল মিশরের কায়রোর আল-আজহার (Al-Azhar University seminary) বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামিক সেমিনারি। ভারতে সুন্নি ধারার ইসলামিক শিক্ষার ১৫০ বছর পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ হল শিক্ষাদানের পাশপাশি মাঝে মধ্যে এক একটা ফতোয়া জারি করাঐ মানুষের নীতি-টিতি চরিত্র ঠিকঠাক রাখার জন্যযেমন ৪ জানুয়ারি ২০১৮-য় ঘোষণা করে ব্যাংকিং ক্ষেত্র থেকে উপার্জিত অর্থ ‘হারাম’ এবং ব্যাংকে কর্মরত এমন পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে তা মুসলিম মেয়েদের নাকচ করা উচি। তাও ভালো বিয়েতে মেয়েদের মতামতের মূল্য আছে জানা গেল, কারণ কনের মুখে “কবুল হ্যায়” শব্দবন্ধদুটি অধিকাংশ সময় পারিবারিক ও সামাজিক চাপে উচ্চারিত হয়। ব্যাংকের কাজ হারাম হলেও গাঁজা চরসের চাষ ও ব্যবসাজাত উপার্জন সম্ভবত ‘হালাল’ বা পবিত্র। যাইহোক,  ২০১৭-র একটি ফতোয়া হল মুসলিম মহিলাদের ফুটবল ম্যাচ দেখা উচি নয়, কারণ পুরুষদের উন্মুক্ত উরু, জঙ্ঘা দেখে তাদের মধ্যে কাম জাগতে পারে ও নীতিবোধের চ্যুতি ঘটতে পারে। একেবারে যথার্থ চিন্তা। তবে হালালার উদ্দেশ্যে পরপুরুষের বিছানা থেকে ফিরিয়ে আনার মধ্যে নৈতিক পতনের জায়গা নেই। এই রকম ফতোয়া নক্শাকাটা ডিজ়াইনার হিজাব বা গায়ে আঁটো বোরখা পরার বিরুদ্ধেও আছে কারণ সেগুলোও পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নারীর নৈতিক পতন ঘটাতে পারে। ফতোয়া জারি হয়েছে স্ত্রী-পুরুষ সকল মুসলমানদের ফেসবুক তথা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট বা আপলোড করার বিরুদ্ধেও। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক দৃশ্যপটের পরিপ্রেক্ষিতে এই ফতোয়াগুলি একটি মুসলিম নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশ মানাসই। তবে ২০১২-য় একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে।
এপ্রিল ২০১২-য় এক ফতোয়ায় দেওবন্দ্‌-এর তৎকালীন মুফতি ঘোষণা করেন এক স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহণ ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী, তাই পরিত্যজ্য। ইসলাম মুসলমান পুরুষকে চারটি বৌ রাখার অনুমতি দিলেও উৎসাহ দেয় না। প্রথম স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয় বিবাহ ভালো দেখায় না, আর ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় কোরানের নির্দেশ মেনে দুটি বা একাধিক বিবির প্রতি সমান মনোভাব দেখানোও সম্ভব নয়। তাছাড়া ভারতীয় সমাজে একাধিক বৌ পোষার হাজর ঝামেলা। এইরকম প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম তার আগে ২০০৮ সালে একবার দেখিয়েছিল সন্ত্রাসকে ইসলামের বিরুদ্ধে পাপ বলে ঘোষণা করে।
শরিয়তি কানুন থেকে অনেকটা বিচ্যুত এই বহুবিবাহ বিরোধী এই ফতোয়াকে কিন্তু “Islamic Council of India”-র সচিব বা সেক্রেটারি ডঃ নঈমুর রহমান সিদ্দিকি স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে চারটে বিয়ে করার অনুমতি থাকলেও ততগুলো করতেই হবে এর কোনও মানে নেই। বরং তীব্র বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই
আশিয়া আন্দ্রাবি
একটি মুসলিম নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী মহিলা সংগঠন “দুখতারা-এ-মিলাত” [dukh-e milat”(DeM)] যার অর্থ দেশের কন্যা, দেওবন্দ্‌-এর তীব্র বিরোধিতা করে মন্তব্য করে, এই ফতোয়া ইসলাম বিরুদ্ধ মুসলমানদের (পুরুষদের বলা বাহুল্য) কেবল দুটো নয়, কোরান মতে চারটে বিয়ে করা উচি “Islam permits a man to have four wives. There is no compromise on the tenets of Islam. The Fatwa issued by Deoband Mufti is against the spirit of Islam. Therefore, I will say a man should have four wives at a time.” বলেছিল ডিইএম (DeM) চেয়ার পার্সন আশিয়া আনদ্রাবি (Asiya Andrabi)এই মহিলা একসময় বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের জন্য স্বামী সন্তানসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল এবং তার উগ্রপন্থী স্বামীর ওপর জনৈক মানবাধিকার কর্মীকে হত্যারও অভিযোগ ছিল। আশিয়ার যুক্তি— কাশ্মীরে এমনিতেই
অস্থিরতা ও সংঘাতের জন্য বিধবা ও অনাথের (মা থাকলেও) সংখ্যা খুব বেশি। বিধবা প্রায় ৩০,০০০ (২০১২-), যাদের উদ্ধারের দায়িত্ব নিতেও পুরুষদের একাধিক বিয়ে করা উচি। ইসলামের বিধান অপরিবর্তণীয়; সেখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’ (national interest) বা ‘দেশের আইন’ (legislation) বলে কোনও কিছু অগ্রাধিকার পেতে পারে না। এখন ইসলামের বিধান বলে তাকে যা বোঝানো হয়েছে, তাই বলেছে। যাইহোক, ফতোয়ায় বলা ছিল, ‘ভারতীয় সংস্কৃতির’ সাথে বহুবিবাহ বেমানান। তা কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী কাশ্মীরি যে ফতোয়া সূত্রেও নিজেদের ভারতীয়দের সাথে সংযুক্ত ভেবেছিলেন এটাই বা কম কী?
যদিও ভারতীয় সংস্কৃতি এই উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত গরিব  ব্রাহ্মণ থেকে রাজা রাজড়া সুলতান বাদশাদের বহু বিবাহের হিড়িক উদযাপন করেই সমৃদ্ধ, এক রাজার সাত রানীর রূপকথা শুনেই বেড়ে ওঠে বাচ্চারাও এবং একটি গণতান্ত্রিক দেশে ফতোয়া ঘোষণা আদৌ সাংবিধানিক ব্যাপার কিনা সে প্রশ্নও উঠে আসে, তবু দেওবন্দ্‌ মুফতি যে ব্রিটিশ প্রভাবে নব জাগরিত ভারতীয় মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে চেয়েছিলেন সেটাই অনেক। ছবিটা গত পাঁচ বছরে আমূল বদলে গেছে।
এখন নারী সংগঠনগুলো ১৯৩৭-এর ভারতীয় শরিয়তি আইন সংশোধন বা বলা যায় উক্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ চাইলেও অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের প্রবল বাধা। একে তো পুরুষদের যথেচ্ছাচার বিরোধী পদক্ষেপ, তার ওপর ইসলামি ফতোয়ার বদলে রাষ্ট্রের আইনি হস্তক্ষেপ তাদের কাছে ধর্মে চরম আঘাত মনে হচ্ছে। আর ধর্মে আঘাত লাগা, সাম্প্রদায়িক স্বার্থ রক্ষা এই ব্যাপারগুলোতে মুসলিম মহিলারাও যথেষ্ট স্পর্শকাতর। তাদের মধ্যে প্রগতিশীলরাও কিন্তু সংখ্যালঘু মহিলা হিসাবে বিশেষ কিছুর প্রত্যাশী, ভারতীয় মূলস্রোতে মেশার অভিলাষী নয়। তারা যে আদৌ সংখ্যালঘু নয়, বরং দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু তা স্বীকার করলে পাছে বিশেষ সুবিধার দাবিদারি চলে যায়, তাই ভারতীয় নাগরিক হিসাবে সমানাধিকার দাবি করার পাশাপাশি ‘সংখ্যালঘু’ হিসাবে বিশেষ পরিচয়টা সুনিশ্চিত রাখতে চায়। সেই জন্য তাদের আন্দোলনে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের পরিবর্তে ইসলামিক আইন সংশোধনের দাবি, তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ ও যথাযথ খোরপোষ লাভের পাশপাশি সরকারের কাছে তালাক ভাতার দাবি
বদলে গেছে বিরোধীদের অবস্থানও। নির্বাচনী যুদ্ধ জয়ই একমাত্র লক্ষ্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিবিরের বিরোধিতাই একমাত্র নীতি এবং তার জন্য যে কোনও রকম দ্বিচারিতাই একমাত্র কৌশল হিসাবে ভারতীয় গণতন্ত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই মৌলবাদের রং দেখে কখনও প্রতিবাদ করা হয়, আবার ক্ষেত্রবিশেষে মৌলবাদকেই মানবতাবাদ ও তার সংরক্ষণকে সমানাধিকার বলে চালানোর হাস্যকর চেষ্টা করা হয়।





তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আন্দোলন ও চাপান উতোর

২০১৭-র গোড়ায় মীরাটের আরীন বেগম তার মিঞাকে বলেছিল, “তালাক তালাক তালাক”সে বুঝতে পারছিল ঐ চরম শব্দগুলো দুই সন্তান ও স্ত্রীকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া লোকটা শিগগিরই উচ্চারণ করবে। তাই মরিয়া হয়ে আগে ভাগেই নিজের শমন ডেকে নিয়েছিল। মুরুব্বিদের মতে এই হকারিতা না করে তার আইনি পথে যাওয়া উচি ছিল। আইন? কোনও দীর্ঘসূত্রী পথে না হেঁটে অখ্যাত এই নারী কিন্তু পুরুষতোষী সমাজ ধর্ম ও আইনের বিরুদ্ধে বলা যায় এককভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যদিও তার পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হয়নি
 মুসলিম মহিলা সংগঠনগুলির তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও বহুবিবাহের প্রতি বিরোধিতা ছিল গোড়া থেকেই। প্রত্যাশিতভাবে তারা শীর্ষ আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানায়। আর মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের কাছ থেকে রায়ের বিরোধিতাও অপ্রত্যাশিত নয়।
এই রায়ের ভিত্তিতে আইন সংস্কারের প্রশ্নে স্পষ্টত পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি দলের বিস্তর মতবিরোধ উঠে এসেছে।

সংস্কারের পক্ষে
ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA) নামের একটি মুসলিম মহিলা সংগঠন সুপ্রীম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা (public interest litigation ) করে বলে ১৯৩৭-এর শরিয়ত আইন নারীর পক্ষে অবমাননাকর। এর সেকশন ২ ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারা, যা মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলে তার পরিপন্থী।
ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA) নামের এই সংগঠনটি গত বেশ কিছু বছর ধরে মুসলমান মেয়েদের জন্য কাজ করছে। তারাই বিগত দুই বছর ধরে তিন তালাক ও হালালা বিরোধী আন্দোলনের হয়ে আইনি লড়াইয়ে নামে। BMMA ২০১৫-য় একটি জাতীয় সার্ভে করে দেখে প্রতি ১১ জন মুসলমান মহিলার মধ্যে ১ জন জীবিত তিন তালাক প্রাপ্ত। তাদের বিপুল সংখ্যক কোনও ক্ষতিপুরণ বা খোরপোষ পায়নি। ধর্ম বিশারদরা এসএমএস বা বৈদ্যুতিন ডাকে পাঠানো তালাককেও স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তির সঙ্গে যে প্রগতির সম্পর্ক থাকতেই হবে তার মানে নেই। ঐশ্বর্য ইসমাইল নামের একটি মেয়ে তো নিজের কানে ‘তালাক’ শব্দটাও শোনেনি, হঠাৎ একদিন শুনতে পেল তাকে চার দিন আগে তালাক দেওয়া হয়ে গেছে। ঐশ্বর্য গত ছয় বছর ধরে সুবিচারের প্রত্যাশায়, যাতে নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য স্বামী নামক প্রাণীটির কাছে এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি অন্তত পায়। BMMA-র সমীক্ষায় ৪৭১০ জন মহিলাকে প্রশ্ন করে দেখা গেছে ৯০ শতাংশই এইভাবে একতরফা হকারি তালাক ও বিশেষত হালালার বিপক্ষে।
দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছে ‘প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ’ও। পশ্চিমবঙ্গে এই সংস্থাটির সভানেত্রী কাজি মাসুম আখতার তিন-তালাক বন্ধের দাবিতে দিল্লিতে ধর্না দিয়েছিলেন। মুসলিম মহিলাদের বৈবাহিক অধিকার ও মেয়েদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য তাদের কাছে সরকারকে প্রদেয় একগুচ্ছ খসড়া প্রস্তাব আছে। এরাই দাবি করে
১. স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিলে সেই পুরুষের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করতে হবে।
২. মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিচার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে করতে হবে
৩. আইনে স্পষ্টভাবে তিন তালাককে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে
৪. ইসলাম অনুসারে স্ত্রীদের তালাক দেওয়ার অধিকার বা “খুল্লা” প্রচলনের জন্য উপযুক্ত আইন আনতে হবে। খুল্লা সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিম অবগতই নয়।
. স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী ও সকল সন্তানদের জন্য খোরপোষ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রয়োজনে স্বামীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেও দিতে হবে খোরপো
৬. সমাজের সর্বস্তরে এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
. স্বামী খোরপোষ দিতে অক্ষম হলে সরকারি তহবিল থেকে ‘তালাক ভাতা’ চালু করতে হবে।
এখন প্রথম ছটি দাবি বোঝা গেলেও সপ্তমটি বেশ বিচিত্র। খোরপোষের বিকল্প হিসাবে তালাক ভাতার দাবি প্রসঙ্গে  কাজি মাসুম আখতারের বক্তব্য, “অনেক ক্ষেত্রে স্বামী খোরপোষ দিতে অসমর্থ। একই সঙ্গে তার আহামরি সম্পত্তি নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা যাতে সরকারি তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে”একে ‘তালাক ভাতা’ নাম দিয়েছে প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ। মাসুম আখতারের মতে বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতার মতো ’তালাক ভাতা’ও খুব জরুরি। আবদারটি মন্দ নয়। তবে এই দাবিটি যে শুধু মুসলিম পুরুষদের হঠকারিতার দায় সরকার বা প্রকান্তরে অন্যান্য দেশবাসীর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে তাই নয়, বিল বিরোধীদের হাতে তুরুপের তাস তুলে দিয়েছে। সে প্রসঙ্গে পারে আসছি। 
অনেক টানাপোড়েনের পর ৬টি মামলার জেরে ২২ আগস্ট ২০১৭ সুপ্রীমকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চের ৫ জন বিচারকের প্যানেলে তিন তালাক বিরোধী রায় জয় লাভ করে ৩-২ ভোটে। ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য “triple talaq was not integral to religious practice and violates constitutional morality” বলা বাহুল্য BMMA-র প্রতিষ্ঠাতা জাকিয়া সোমান সহ অন্যান্য সদস্য এবং হাজার হাজার ঐশ্বর্য ইসমাইল, ইসরত জাহানরা উৎফুল্ল রায় শুনেমিষ্টি ও নরম পানীয় দিয়ে আনন্দ উদযাপন করে তারা।
তবে প্রগতিশীল মুসলিম মহিলারা ইসলামের বিধানকে পুরোপুরি পুরুষপন্থী একপেশে হিসাবে চিহ্নিত করলেও তাকে অমান্য করার কথা ভাবছে না। বরং তাদের দাবি তালাক দেওয়া স্বামী খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে সেই দায়িত্ব সরকার তুলে নিক ‘তালাক ভাতা’র নামে। অর্থাৎ সমানাধিকারের পাশাপাশি বিশেষ সুবিধার দাবি। মহিলা সংগঠনগুলি ছাড়াও মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ (MRM)-এর মতো পুরুষ পরিচালিত ইসলামি সংগঠনও বিদ্দতের বদলে ইদ্দতের পক্ষপাতী। তবে যেটাই হোক তা কোরান ও শরিয়ত সম্মত হওয়া আবশ্যক।
এখানে খুব প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা মনে পড়ছে, পরাশর সংহিতায় বিধবা বিবাহের সমর্থন খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই বিদ্যাসাগরের পক্ষে শেষ পর্যন্ত ডালহৌসিকে দিয়ে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন করানো সম্ভব হয়েছিল। এখানেও কোরান ও শরিয়তের সমর্থন খুঁজতে হচ্ছে মেয়েদের লাঞ্ছনা কমানোর জন্য। পুরুষ প্রণীত ও পরিচালিত এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর কোনও না কোনও গ্রন্থ যদি কোথাও না কোথাও মেয়েদের এইটুকু দয়া না দেখাত, তাহলে কি তাদের বেঁচে থাকার অধিকার আইনি স্বীকৃতি পেত না?

সংস্কারের বিপক্ষে:
অনেক কট্টর ইসলামিক সংগঠনও তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরোধী হওয়ায় মুসলিম দেশগুলোতেও সেটা বন্ধ করা গেছে। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে সব ধর্মের মানুষকে ব্যক্তিগত বিষয়ে নিজস্ব ধর্মাচারণের স্বাধীনতা দেওয়ায় মুসলিম পুরুষের স্ত্রীকে অবহেলা নির্যাতন করার অধিকারও মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত এই সংবিধানেই! সুতরাং ধর্মের নামে তার অপব্যবহারটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুপ্রীম কোর্টের চূড়ান্ত রায়দানের পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড বা AIMPLB-এর প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত হলেও তার প্রকাশ বেশ চমকপ্রদ। প্রথমত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রস্তাব তো উড়িয়েই দিয়েছে এই যুক্তিতে যে তা ভারতের বৈচিত্রের বিরোধী হবে। বস্তুত এই অভিন্নতার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে নাগাল্যান্ডেও যেখানে বিধানসভায় মেয়েদের জন্য অন্যান্য রাজ্যের মতোই আসন সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করায় রীতিমতো আগুন জ্বলে যায়। উত্তরপূর্বের মতো তথাকথিত মাতৃপ্রধান সমাজ বা তেমন সমাজের প্রতিবেশেই যদি এই অবস্থা হয়, মূলধারা পিতৃতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া দুর্ভাগ্যজনক হলেও অপ্রত্যাশিত নয়।
আর সামগ্রিকভাবে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের (AIMPLB) সদস্যরা তিন তালাক ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার ঘোর বিরোধী। প্রসঙ্গত বহুবিবাহ ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও পার্সোনাল ল’য়ের দৌলতেই তা একটি সম্প্রদায়ের পুরুষদের বৈধ অধিকারযদিও বা গুটিকয় সদস্য তিন তালাক নিয়ে বিবেচনা করতে রাজি হয়, কিন্তু তারা সুপ্রীমকোর্টের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করতে একদম রাজি নয়, বিশেষ করে সংস্কার যখন হিন্দুত্ববাদী সরকারের উৎসাহে আসছে। দেশের ১৪% বা ১.৩ বিলিয়ন মুসলিমের ব্যক্তিস্বাধীনতায় নাকি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এই ১.৩ বিলিয়ানের মধ্যে তিন তালাক বিরোধী মুসলিম মেয়েরাও যে আছে এবং তারা যে এই হসজ্তক্ষেপটাই দাবি করছে, সেটা হিসাবে রাখার দরকার নেই!
অধিকাংশ তো তিন তালাকের বৈধতা নিয়ে বা খোরপোষের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলারই বিপক্ষে। ‘আল জাজ়িরা’ চ্যানেলকে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে বোর্ডের অন্যতম সদস্য জাকিয়ার বক্তব্য, "None of the Quranic guidelines of discussion, arbitration, witnesses, specified time period or even a genuine attempt to resolve differences are being followed. In such circumstances, the question of alimony or the rights of children doesn't arise," কোরানের কোনও সূত্র বা ব্যাখ্যায় নাকি সমঝোতার জন্য সময়সীমার উল্লেখ নেই! সুতরাং সেক্ষেত্রে খোরপোষ দেওয়া বা সন্তানের অধিকার রক্ষার প্রশ্নই ওঠে না। এর বড় মিথ্যের সত্যিই আর কোনও কথা চলে না।
BMMA দ্বারা করা সমীক্ষার পদ্ধতি ও নমুনার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠল। বোর্ডের মতে ৪৭১০ নমুনার মধ্যে মাত্র ৫২৫টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। National University of Law-এর উপাচার্য ফৈজ়ান মুস্তাফা আল জাজ়িরাকে বলেন, এসএমএস-এর মাধ্যমে তালাক দেওয়াটাও সংবাদ মাধ্যমগুলো অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছে। ৪১% মহিলাই নাকি নিজেরাই তালাক চেয়েছে। সুতরাং তাদের তালাক হয়েছে আসলে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে (mutual agreement), যাকে ইসলামে বলে ‘তালাক-এ-মুবারা’এতে কোনও সমস্যা থাকতে পারে না। তারপর দয়া করে মন্তব্য করেছেন, এমনটা না হলে তিন তালাক দৃষ্টকটু যেখানে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকা উচিত। "It is only when these two situations are not there, triple divorce will look bad. And, therefore, I would also say in that situation the better solution would be that the three pronouncements should be considered as one, so that there is a scope for reconciliation."
বিচারপতিদের কাছে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল ইসলামি বিবাহবিচ্ছেদ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ("is fundamental to religion") কিনা এবং এটাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত দেওয়া যায় কিনা খতিয়ে দেখা। এখানে বাধ সাধছিল সংবিধানের ২৫ নং ধারা যা ধর্মাচারণকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে। ওদিকে ২০১৫-র ফেব্রুয়ারিতেই কিন্তু একটি রায়ে তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক বিবেচিত হয়েছিল
২০১১-র জনগণনার সময় নাকি কোনও এক সূত্রে ধরা পড়েছিল মুসলিমদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার .৫৬% যা হিন্দুদের .৭৬%-এর চেয়ে কম। পার্সোনাল ল বোর্ডের কাছে এই তথ্য খুব বড় হাতিয়ার। এ পর্যন্ত সরকার তিন তালাকের হার নিয়ে কোনও সমীক্ষা করেনি। তাই বোর্ডের বক্তব্য হুট করে তিন তালাক নিষিদ্ধ করার আগে উপযুক্ত মুসলিম কমিটি দ্বারা এই সমীক্ষা করানো হোক।
All India Muslim Personal Law Board (AIMPLB) তথাকথিত শরিয়তি প্রথারটি সপক্ষে রিপোর্ট তৈরি করতে শরিয়ত কমিটি নিয়ন্ত্রিত মুসলিম মহিলা রিসার্চ কেন্দ্র (MMRK) দ্বারা একটি রিপোর্ট তৈরি করিয়ে দেখায় তিন তালাক থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের বিবাহবিচ্ছেদের হার অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে কম। তাদের আরও দাবি ভারতের ৩৫ মিলিয়ন মুসলিম মহিলা শরিয়ত ও তিন তালাকের পক্ষে রায় দিয়ে স্মারক দিয়েছে। AIMPLB ২০১৭-র এপ্রিলে একটা তিন তালাক নিয়ে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একটি আচরণবিধি (code of conduct) তৈরি করে সাবধান করে যে যারা শরিয়ত না মেনে যথেষ্ট কারণ ছাড়া হুটপাট তালাক দেবে তাদের সামাজিক বয়কট দ্বারা একঘরে করা হবে। প্রতিবার তালাক উচ্চারণের জন্য এক মাস ব্যবধানও নির্দিষ্ট করে। এসব বলা বাহুল্য, একপেশে তালাক প্রথাকে কিছুটা সংস্কার করে বজায় রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা যাতে সংবিধান বা সুপ্রীমকোর্ট তাদের ধর্মের নামে চালানো প্রথায় যেন হস্তক্ষেপ না করে।
জনৈক হানাফি পণ্ডিত মুস্তাফার মতে তিন তালাক নিষিদ্ধ করার বদলে বহুবিবাহ সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল দরকার। হিন্দুদের বহুবিবাহ এমনকি দুটি বিয়েও নিষিদ্ধ করায় হিন্দু পুরুষরা হয়তো একাধিক বিয়ে করছে না, কিন্তু মেয়েদের সামাজিক অবস্থার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? সুতরাং বহুবিবাহ আসল সমস্যা নয়, আর তার পথ খোলা রাখার উপায় হিসাবে এক ঝটকায় তিন তালাকটাও নিন্দনীয় হতে পারে নাবস্তুত এই লোকগুলোর এই অনুপম ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র পরিবর্তনের জন্যই তো আইন সংস্কার দরকার
ফ্লাভিয়া অ্যাগনেস নামের জনৈক নারী অধিকার রক্ষার আইনজীবী আবার মন্তব্য করেছেন, ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে সবাই যেন লেখার একটা বিষয় পেয়ে গেছে। কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেন অশিক্ষা ও দারিদ্রই আসল সমস্যা। যেখানে “Talaq does not extinguish her economic rights, [the ban] is not a magic wand that will solve all her problems. We have created an image that Muslim women have no rights because husbands can pronounce triple talaq," অর্থাৎ দারিদ্র অশিক্ষাই মূল সমস্যা, তিন তালাক রদ করে সেটা সমাধান হবার নয়। আর মিঞা তিন তালাক উচ্চারণের অধিকারী বলে বিবির কোনও অধিকার নেই, এটাও সত্যি নয়, একটা তৈরি করা ছবি। একজন মহিলা তাও আবার বুদ্ধিজীবী মহিলার মুখে এমন চমকপ্রদ মন্তব্যের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে আসে অনুমান করা যায়, কারণ তিনি তালাক বিরোধী সরকারি সক্রিয়তার মধ্যে শুধুই মুসলিম বিরোধী গেরুয়া রাজনীতির গন্ধ পেয়েছেন। রাজনৈতিক ইঙ্গিতটার মধ্যে যে কয়েক শতাংশও সত্যতা নেই তা জোর দিয়ে বলা যায় না, তবে এদের পরামর্শের ওপর ভাগ্যিস আদালতের রায় নির্ভরশীল নয়
সংশোধন বিরোধীরা এর মধ্যে কোনও মহিলা কল্যাণ বা নারীর ক্ষমতায়ন দেখছেন না, দেখছেন শুধু বিজেপি ও তার নেপথ্যে আরএসএস-এর মুসলিম বিরোধী অসহিষ্ণুতা রাজনীতি। অবশ্য নারী স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন কখনই AIMPLB-র অ্যাজেন্ডা নয়। তাই তারা সুপ্রীমকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তালাক-এ-বিদ্দতের সমর্থনে বেশ চমকপ্রদ যুক্তি পেশ করেছে :-
 . তিন তালাক স্ত্রীর জীবনে নিরাপত্তা দেয়: ব্যাখ্যা নারী পুরুষের চেয়ে দুর্বল বলে নিজের নিরাপত্তার জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতাই গুরুতর মতানৈক্যের ক্ষেত্রে পুরুষকে যদি আইনিভাবে তার স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হয় বা দীর্ঘসূত্রী মামলায় জড়িয়ে বিচ্ছেদ বিলম্বিত করা হয়, তাহলে সে বেআইনি অপরাধমূলক পথে হাঁটতেই পারে, যেমন বৌকে খুন করা বা জীবন্ত দগ্ধ করা। চমৎকার! [“Marriage is a contract in which both the parties are not physically equal. Man is stronger and female is weaker sex. Man is not dependent upon woman for his protection. On the contrary, she needs him for her defence. If there develops serious discord between the couple and husband does not at all want to live with her, legal compulsions of time consuming separation proceedings and expenses may deter him from taking the legal course. In such instances, he may resort to illegal, criminal ways of murdering or burning her alive.”]
২. পুরুষরা বিচ্ছেদ সহজে না পেলে স্ত্রী খুন হতে পারে: প্রথম যুক্তির পুনরাবৃত্তি। ব্যাখ্যায় জোড়া হয়েছে রাতের অন্ধকারে বৌকে একা পেয়ে খুন করা বা জ্যান্ত পোড়ানোর ও তার প্রমাণ লোপাটের সুযোগ বরের থাকে। আর অপরাধীরা প্রমাণের অভাবে ছাড়াও পেয়ে যায় সচরাচর। অকাট্য! [“Needless to add, a husband who does not fear God may do anything against his wife whom he hates. For only he is with her in the darkness of night. He has more chances of covering up his crime. Often do culprits get the benefit of doubt. This accounts for the rise in the cases of women being murdered and burnt alive.”]
৩. আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ নারীর চরিত্র হনন করে পুরুষের নয়: আদালতে যাওয়া মানে বিপক্ষের দুর্বলতা খামতি জনসমক্ষে নিয়ে আসা। পুরুষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জন্য তার পুনর্বিবাহের সম্ভাবনা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, কিন্তু মেয়েটির ভবিষ্যতের বারোটা বেজে যায়। যথার্থ। [“Securing separation through court entails that the weaknesses of the opposite party be brought into public domain. Some moral failings are considered more scandalous for women in our society. For example the charge against a male that he has loose conduct and temper may damage only a little his prospects of remarriage. However, husband’s same charge publicly against his wife about her loose character may deprive her the chance of remarriage. She may be more harmed than benefitted by court proceedings.”]
৪. আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে স্ত্রী পুরুষ দুজনেরই পুনর্বিবাহে দেরি হয়: সে আর বলতে? শুধু নতুন বিয়েতে দেরি নয়, পারস্পরিক তিক্ততা আরও বেড়ে যায়। মাঝখান থেকে আইনি জটিলতায় অনর্থক অর্থব্যয়। সে সব থেকে অব্যহতি পেতে কেউ বৌকে মেরে ফেলতেই পারে। [“Further, it is not unknown that securing separation through courts takes a long time; this further deters the re-marriage prospects of the parties. In addition to the above, in cases where serious discords develop between the parties and the husband wants to get rid of the wife, legal compulsions of time consuming separation proceedings and the high expenses of such a procedure may deter him from adopting such a course and in extreme cases he may resort to illegal criminal ways of getting rid of her by murdering her.”]
৫. তিন তালাক পাপ, কিন্তু বিচ্ছেদের ‘আইনি ও কার্যকরী’ উপায়: তালাক পাপ হলেও বেআইনি নয়। ইসলাম ধর্ম-আইন-তত্ত্বে (jurisprudence) কিছু কিছু পাপের আইনি বৈধতা আছে। যেমন পাপীর বিচারক হওয়ায় আইনত বাধা নেই। সে যা রায় দেবে তা শরিয়ত সম্মত হলেই হল। [“It is submitted that though pronouncement of Triple talaq is considered to be a sin it is still a valid and effective form of divorce. In Islamic Jurisprudence many times an irregular or improper nature of an act does not affect the legal consequences of the Act. For instance, it is not lawful to appoint a sinner as a judge However, if the state appoints a sinner as a judge and he passes a judgment, that judgment will be effective, provided it is within the limits of Sharia.”]
সোজা কথায় পুরুষমানুষ যা খুশি করার স্বাধীনতা না পেলে নিষ্ঠুর খুনের মতো পরাধ করতেই পারে। তাকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে হলে যথেচ্ছাচার করতে দিতে হবে এবং সেটা পাপ হলেও বেআইনি নয়। সত্যিই অকাট্য! এর পরে তো কোনও কথা থাকতেই পারে না।
বোর্ডের এই উদ্ভট যুক্তি তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলে বরপণ (যা শরিয়ত বিরোধী), কন্যা সন্তান প্রসব, রান্নায় চুল পড়া, বিড়ি বাঁধতে না পারা, কুকর্ম দ্বারা উপার্জনে রাজি না হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে বা অজুহাতে বৌয়ের গায়ে আগুন বা অ্যাসিড দেয়া হয় কেন, ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে নিষ্কৃতি লাভের সহজ উপায় থাকতে?
প্রসঙ্গত তালাকপ্রাপ্ত মহিলারা যদি ফের ঐ পুরুষটিকেই বিয়ে করতে চায়, তাহলে পরপুরুষ বা মৌলবিদের সঙ্গে রাত্রিযাপনে কোনও দোষদেখে না মুসলিম লবোর্ড। সে ক্ষেত্রে মৌলবিরাও এক রাত্রি কাটানো ও তালাকদেওয়ার জন্য ইচ্ছামতো দর হাঁকে। যেমন ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নগদ। সোজা কথায় পরনারীর শরীর ভোগ করার জন্য মালকড়ি খসানোর বদলে রোজগার। মুসলিম মহিলারাও স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য ওই টাকা দিতে কার্যত বাধ্য হয়। স্টিং অপারেশনে এক মৌলবি স্বীকার করেছে, স্ত্রীকে না জানিয়েই দিব্যি নিকাহ হালালাব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তার স্ত্রীও জানতে পারে না যে তার স্বামী অর্থের বিনিময়ে কোনও ডিভোর্সি মুসলিম মহিলার শয্যাসঙ্গী হয়েছে বা হয়ে চলেছে। বইটি যখন প্রথম প্রকাশ করি, তখন এরকম কিছু অনুমান করেছিলাম, কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে লিখিনি। ক্রমশ প্রমাণও পেয়ে গেলাম।
সন্দেহ জাগে তালাক দেওয়া সঙ্গীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা সত্যিই তালাক পাওয়া মহিলাদের থাকে, নাকি তাদের সেই ‘ইচ্ছা’ও প্রাক্তন স্বামী ও মৌলবিদের যোগসাযোশে নির্ধারিত হয়? সাধারণ বুদ্ধিতে দ্বিতীয়টির সম্ভাবনাই তো বেশি মনে হয়। মুসলিম মহিলারা কিন্তু মরিয়া হয়ে এই হালালার হাত থেকেও নিষ্কৃতি চাইছে। ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে ঘাড় ধাক্কা দেওয়া মিঞার কাছে ফিরে যাওয়াটা যদি তাদের নিজের ইচ্ছাধীন হতো, তাহলে ‘হালালা’ নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা থাকত বলে মনে হয় না।






নেপথ্যের মামলা ও নিষিদ্ধ তাৎক্ষণিক তিন তালাক

প্রতি বছর তিন তালাকের শিকার কতজন মহিলা সেই নিয়ে মহিলা সংগঠন ও পার্সোনাল ল বোর্ডের মতান্তর থাকতে পারে, তবে কোন ছ’টি মামলার সৌজন্যে ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত তা নিয়ে বিতর্কের জায়গা নেই।
১. লড়াইয়ের সূচনা হয় প্রথম যে মামলাটি দিয়ে তা উত্তরাখণ্ডের শায়রা বানুর তরফ থেকে রুজু করা। ৩২ বছর বয়সী এই মহিলা বৈবাহিকসূত্রে বারংবার গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের ফলে শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত ছিল। উত্তরাখণ্ডে বাপের বাড়ি থাকার সময় একটি চিঠি পায়। খুলে দেখে তালাকনামা, তাকে নাকি তিনবার তালাক উচ্চারণ করে ত্যাগ করা হয়েছে। নিজের অভিযোগে বলে এইভাবে একসাথে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে একতরফা ত্যাগের অধিকার পুরুষমানুষকে ইসলাম দেয়নি।
Description: Ishrat JahanText Box: ইশরত জাহান২. পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী ইশরত জাহানকে তার বর দুবাই থেকে ফোনে তিনবার তালাক শব্দটা শুনিয়ে দেয়। চারটি সন্তান শ্বশুরবাড়ির কবলে। বরের দ্বিতীয় বিবাহে বাধা দিলে তার ওপর চলে নির্যাতন যার জেরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বিপন্নকে সাহায্য করা দূরে থাক এই মহিলার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লেগে যান পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বিধায়ক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী সহ অনেকেই।
৩. তৃতীয় পিটিশনটি কোনও ব্যক্তি বিশেষের নয়, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA)-এর করাMuslim Women’s Quest for Equality নামে। এদের দাবি আল্লাহ্ বলেছেন নারী ও পুরুষ সমান। কোরানের আয়াত ও তালাক সংক্রান্ত বিধান আদালতে পেশ করে সংস্থাটি যার মধ্যে সমঝোতার জন্য ৯০ দিনের সময় নেওয়ার নির্দেশ আছে। দ্বিতীয় যুক্তিটি ছিল লিঙ্গ সাম্যের। ভারতের সংবিধান সব নাগরিকের সমানাধিকার স্বীকার করে, কিন্তু তালাক-এ-বিদ্দত তার সম্পূর্ণ বিরোধী।
৪. চতুর্থ মামলা রাজস্থানের গুলশন পরভীনের তরফ থেকে যাকে তিন তালাক শুনিয়েছে জয়পুরের রহমান। মামলা করলেও মূলত অন্তরালবর্তিনী থেকে গেছে পরভীন।
৫. পঞ্চম অভিযোগ এসেছে আফ্রীন রহমানের পক্ষ থেকে। আফ্রীনও চূড়ান্ত শুনানির দিন হাজির হবে বলে মিডিয়া থেকে আড়ালেই থেকেছে।
৬. উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর নিবাসী আতিয়া সাবরি হল শেষ পিটিশনার।
     এদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রচারের আলো পেয়েছে ইশরত জাহান। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঐতিহ্য এর একটা কারণ। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের সক্রিয় প্রভাবে বর্তমান সরকার তার লড়াইকে যতটা দুরূহ করে দিয়েছিল, চূড়ান্ত শুনানির পর তাকে প্রচারের আলোতে আসতে এবং একই সঙ্গে প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে ততটাই সাহায্য করে ফেলেছে। শুধু ইশরত নয়, তার আইনজীবী না়িয়া ইলাহি খানও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়ে তাদের দলীয় পতাকা তলে।
মহিলা সংগঠনগুলোর লাগাতার আন্দোলন, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA)-র সক্রিয় মামলা এবং একের পর এক একতরফা হকারি তালাক ও খোরপোষ থেকে বঞ্চনার কেস আদালতে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন আদালত বিচারপ্রার্থীকে সুবিচার দিতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথার নানা ভাষায় সমালোচনা করেছে। এইগুলোই সম্প্রতিক অতীতে ২২ আগস্ট ২০১৭- ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের ঐতিহাসিক রায়ের উপযুক্ত চালচিত্র তৈরি করেছিল২০১৬-র ৮ ডিসেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট তিন তালাককে অসাংবিধানিক ও মুসলিম মহিলাদের অধিকার ক্ষুণ্ণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০১৭-র মার্চে দশ লক্ষের বেশি মুসলিম যাদের আধিকাংশ মহিলা, তিন তালাক রদ করার পক্ষে একটি পিটিশন সই করে। পিটিশনটি ছিল ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’ দ্বারা উত্থাপিত এবং ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ দ্বারা সমর্থিত২০১৭-র ১৩ মে সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত বিচারের সময় তালাক-এ-বিদ্দত উল্লিখিত হয় "worst form of marriage dissolution" বলে। ২০১৭-র ১০ মে মৌলানা সৈয়দ শাহাবুদ্দিন সালাফি ফিরদৌসি তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও নিকাহ হালালাকে সোজাসুজি ইসলাম বিরোধী নারী নিগ্রহের অস্ত্র বলে নিন্দাও করেন।
এমনিতেই মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের বেলাগাম বাড় বাড়ন্তে ও সুবিধাবাদী রাজনীতির সৌজন্যে দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ফুটছে। তার মধ্যে একদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম উদারপন্থীদের তালাক আইন বদলের জন্য জোর আন্দোলন, আর তার বিপরীতে কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল ইত্যাদি প্রায় সব বিরোধী দলগুলির প্রচলিত ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য চাপ সৃষ্টির সাঁড়াশি আক্রমণে পরিস্থিতি যখন বেশ ঘোরালো, সেই সময় ২০১৭-২২ আগস্ট সুপ্রীম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ভারত সরকারকে নির্দেশ দেয় ৬ মাসের মধ্যে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করার। ততদিন তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ২৮ ডিসেম্বর লোকসভায় সরকার ‘প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ’ ও অন্যান্য সংগঠনের দাবি মেনে তালাক-এ-বিদ্দত শুধু বেআইনি নয় শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করে বিল পেশ ও পাস করায়। তবে এই ইতিহাসটি পাঠ্যসূচির অন্তর্গত হবে কিনা সেটা রাজ্যসভায় বিরোধী শিবিরের মর্জির ওপর নির্ভরশীল থেকে যায়, যার ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে।








তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকারী বিল নিয়ে অচলাবস্থা



তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করানোর প্রক্রিয়াটি কেন্দ্র সরকারের সদর্থক পদক্ষেপ সত্ত্বেও বেশ ঘোরালো ও অনাবশ্যক দীর্ঘসূত্রী ব্যাপারে দাঁড়িয়েছিল। ভারতীয় জনতা পার্টি সরকারের ইচ্ছা ও লক্ষ্য ছিল সংসদের ২০১৭-১৮-র শীতকালীন অধিবেশনে যে কোনওভাবে তিন-তালাক বিলটি পাস করিয়ে নেওয়ার। কিন্তু ২৮-শে ডিসেম্বর ২০১৭ বিলটি প্রথম লোকসভায় পেশ হওয়ার পর সেখানে নিজস্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভোটাভুটিতে না গিয়ে শুধু ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে বিল পাস করাতে সমর্থ হয়। কিন্তু তারপর রাজ্যসভায় গিয়ে তার গতিরোধ হয়ে গেল

তখন বিল নিয়ে দু ধরণের অসন্তোষ বা আপত্তি ঠে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর সরকার মুসলিম মহিলাদের সমর্থন ও সাধুবাদ পেলেও তাদের দাবি পরিপূণর্ভাবে মেটাতে অপারগ, কারণ ‘তালাক ভাতা’র দাবি আদৌ যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নিকংগ্রেস ও বাম শিবির থেকে তালাক ভাতার সমর্থনে প্রস্তাবিত আইনে কিছু পরিবর্তন আনার দাবি ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল, শুধু মুসলিম মহিলাদের স্বামীর খোরপাষ দানের অপারগতা বা অনিচ্ছায় যদি তালাক ভাতা দিতে হয়, তাহলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিবাহ বিচ্ছিন্ন মহিলারা ‘বিচ্ছেদ ভাতা’ পাবে না কেন? সমানাধিকারের দাবির সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ অধিকারের দাবি তোলা কেন? সম্প্রদায়টির বিশেষ সুবিধা ভোগের আবদার করার অভ্যাসটি তাদের মহিলাদের মধ্যেও যথোচিত বিদ্যমানসংবিধান বিরুদ্ধ এই আইনের আবার শরিয়তি সমর্থনও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার ফলে অভিসন্ধি পরায়ন রাজনৈতিক শিবিরও খোলতাই যুক্তি শানাতে পারছিল না।

সেক্ষেত্রে আপত্তি তোলার দ্বিতীয় একটি জায়গা পাওয়া গে যেখানে সব প্রতিপক্ষ একজোটসেটা হল, তাৎক্ষণিক তিন তালাক বেআইনি ঘোষণা করা গেলেও তাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে তিন বছরের কারাবাসের বিধান আনা চলবে না। মিঞা তিন বছর জেলে কাটালে বিবি বাচ্চাদের খোরপোষ দেবে কে এবং কীভাবে? তাই সর্বাগ্রে দরকার তাদের পরিত্যক্ত স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করা। এটা করতে গেলে তালাক ভাতার বিষয়টি আবার আলোচিত হবে এবং মুসলিম মহিলাদের সমর্থন গৈরিক শিবির থেকে কেড়ে নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া সহজ হবে। সুতরাং ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রস্তাবিত হ বিলটিকে সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হোক।

অথচ ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনরিটি (NCM)-র চেয়ারম্যান সৈয়দ গায়োরুল হাসান রিজভি স্পষ্ট বলেছেন, হুটপাট করে তাৎক্ষণিক তিন তালাক যারা দেবে সেইসব পুরুষদের মনে একটা ভীতি সঞ্চার প্রয়োজন, শাস্তির ভীতি; আর সেই জন্যই সরকার মহিলা সংগঠনগুলোর দাবি মেনে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা নয় জামিন অযোগ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে আইন করতে চায়। [...a law is important to create fear among those following instant triple talaq, though, perhaps, ‘fear’ is not quite the word I would have used. The Cabinet has now passed the triple talaq bill. Under this draft law, a man attempting to divorce his wife through instant triple talaq might find himself in prison for three years and having to pay a fine. The draft Muslim Women Protection on Rights on Marriage Bill has gone to the state governments for their views.] বস্তুত ঠিক এটাই ছিল প্রগতিশীল মুসলিম সমাজেরও দাবি। পাকিস্তানেও অনুরূপ ক্ষেত্রে এক বছরের কারাবাসের আইন আছে তবু ভারতে বিরোধীদের এই প্রস্তাব পুনর্বিবেচিত হতেই পারে এবং হতেই থাকবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিতমানে আন্দোলনকারী মহিলাদের দাবিটা নতুন আইনেও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ ছিল বিস্তর।

স্পষ্টত বিজেপি সরকার এই সংশোধনের দাবিকে বিলটি আটকে দেওয়ার কংগ্রেসি চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি না। একই সঙ্গে অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছার চেয়েও ক্ষমতাসীন দলের কাছে যেন ক্রমশ বড়ো হয়ে দাঁড়াচ্ছে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগেভাগে বিরোধীদের জোটবদ্ধ হয়ে পড়ার দুশ্চিন্তা।

বিল নিয়ে চাপান উতোর চলা কালে ২০১৮-য় রাজ্যসভায় শাসক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কোনও বিরোধী দলেরও ছিল না। কিন্তু তারা যে সরকার বিরোধিতায় নিজেদের মধ্যে জোট বেঁধে ফেলতে চাইবে সেটা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এক প্রকার অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই জোটে যে এআইডিএমকে (AIDMK), বিজু জনতা দলের মতো এনডিএ-র সহযোগী, এমনকি শরিক দল তেলেগু দেশমও যোগ দেবে তা অপ্রত্যাশিত ছিল। অভিজ্ঞজনের অনুমান ও শাসকদলের আশঙ্কা ছিল এই বিল বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বিরোধী মহাজোটের চূড়ান্ত মহড়া শুরু হয়ে গেছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে কুশলী কাজটি করে তৃণমূল শিবির। লোকসভায় তার সাংসদরা বিতর্কে অংশগ্রহণই করেনি, অন্যত্র বসে গল্পগাছা করেছেন। কিন্তু রাজ্যসভায় একে একে প্রথমে ভোটাভুটির দাবি তুলে, সেটি নাকচ হলে সংসদীয় সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানোর দাবি জানিয়ে এবং শেষে ভোটাভুটি হবে না সিলেক্ট কমিটির কাছে যাবে, সেই প্রশ্নে ভোটাভুটির প্রস্তাব তুলে শাসক দলকে মোক্ষম বেকায়দায় ফেলেন। রাজ্যসভায় শাসকদল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, আর সিলেক্ট কমিটিও মূলত বিরোধী পক্ষের সদস্য নিয়ে গড়া রীতি। তাই যেটাই হোক তার পরিণতি যে বিলের বিপক্ষে যাবে তা স্পষ্ট। অতএব ২০১৮-র শীতকালীন অধিবেশন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও অচলায়তন কাটেনি, বরং ঐতিহাসিক বিলটিকে শীত ঘুমে পাঠানোর আয়োজন হ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে আবার দেখা গেল এক ক্ষমতাসীন মহিলার নারীবিরোধী মাস্টারস্ট্রোক

অতএব এতশত তর্কবিতর্ক, অমুসলিমদের কোরান শরিয়ত হাদিশ পাঠ, আন্তর্জালকে গুগুল-পুজো, সংবিধান ঘাঁটা সব কিছুতে তখনকার মতো জল পড়ে গেল। ইশরত জাহান ও তার আইনজীবী নাজ়িয়া ইলাহির গেরুয়া শিবিরে সম্মানজনক সদস্যপদ লাভ ছাড়া ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারীর কোনও কল্যাণ ২০১৮-র শুরুতে সাধিত হল না বা হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হল না।

তারপর নির্বাচন কমিশন ২৩ মার্চ ৫৮টি আসনের জন্য রাজ্যসভার নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে। আসনগুলো এপ্রিল-মে নাগাদ বিদায়ী সদস্য দ্বারা শূন্য হবে। তারপর শাসকদল রাজ্যসভাতেও সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে এবং আগামী অধিবেশনে বিলটির সদগতি করে নতুন আইন আনতে পারবে – এতসব ভাবনার পুরোটই তখন তলিয়ে রইল দিবাস্বপ্নে। বরং সুপ্রীম কোর্ট উপযুক্ত আইন রচনার জন্য যে ৬ মাস সময়সীমা ধার্য করেছে তা যে তালেগোলে নিষ্ফলা অতিক্রান্ত হতে চলেছে সেটা অনুমান করেছিল অধিকাংশ মানুষ। বলা বাহুল্য তারপর তালাক-এ-বিদ্দত বিরোধী আইনের ভবিষ্যৎটা আরও অনিশ্চিৎ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা – এটুকু অনুধাবনের জন্য রাজনীতি বিশেষজ্ঞ বা জ্যোতির্বিদ কোনওটাই হওয়ার দরকার নেই



বইটির প্রথম সংস্করণে এইটুকুই লিখেছিলাম। দুঃখের বিষয় যে অনুমান বা আশঙ্কা ব্যক্ত করি ২০১৯-এর ১১ এপ্রিল থেকে শুরু লোকসভা ভোটের সূচনাতে সেই ছবিটা পাল্টাল না। তা পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে মিলে গেল, কিন্তু খুশি হতে পারলাম না। অবশ্য এর মধ্যে সরকার আর একবার চেষ্টা করেছে এ ব্যাপারে এগোতে। ২০১৮-এর ১৯ সেপ্টেম্বর ইউনিয়ান ক্যাবিনেট তালাক-এ-বিদ্দত-নিষেধী বিলটির ওপর নির্বাহী আজ্ঞা বা The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Ordinance, 2018 জারি করে, এবং কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী তা ঘোষণাও করেন। তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মুসলিম মহিলা সংস্থা এই অর্ডিন্যান্সকে স্বাগত জানিয়ে বলে, “Prime Minister rings the knell of social justice for our Muslim sisters, the real minority within the minority who have suffered silently for years! A small step for womankind, giant leap for humanity! Cannot thank our Government enough.

অর্ডিন্যান্স জারির আগে অবশ্য দোষী পুরুষদের শাস্তিদানে কিছু উদারতা বা শিথিলতা রাখা হয়। যেমন তিন তালাক কাণ্ডে ধৃত পুরুষটি বিচারের আগে জামিন পেতে পারে, যদি সে খোরপোষ দিতে রাজি হয়। কিন্তু তার পরেও পার্সোনাল ল বোর্ডেরের সদস্য তারি তাহুফ্‌ফুজে শরিয়ত, মৌলানা খালিদ রশিদ ফিরঙ্গি মাহালি প্রমুখের বক্তব্য এই অর্ডিন্যান্স তাদের শরিয়তি আইনে হস্তক্ষেপ। All-India Muslim Personal Law Board-এর মহিলা শাখার মুখে সেই একই গতানুগতিক শেখানো বুলির ফাটা রেকর্ড। “The ordinance is an insult for the community and interference with the Shariat,” যা নাকি সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। মৌলানা মাহালির পরামর্শ মুসলিমদের পারিবারিক সমস্যা শরিয়ত আদালত ‘দারুল কা়া’-য় (Darul Kaza) মেটানো উচিত। AIMPLB-র মহিলা সদস্যা নিঘাত পরভীন খান, আমিনা রিজ়ওয়ান মোমিনাতি ও ডঃ সাবা তাকামিন এঁরাও মৌলানার বক্তব্য সমর্থন করে বলেছে এই অর্ডিন্যান্স নাকি ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটাবে।

অবশ্য ভুল কিছু বলেননি। যাদের যুক্তি, খেয়ালখুশি মতো বৌ তাড়ানোর সুবিধা না থাকলে তাকে জ্যান্ত পোড়ানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, তাদের কাছে এমন মন্তব্যই প্রত্যাশিত। বিবিকে খুন করলে দোষ দেশের আইনের।

দিল্লী হাইকোর্টে অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে বিশেষত তিন তালাক প্রদানকারীর তিন বছরের কারাবাসের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাতে অভিযোগকারী আইনজীবী শাহিদ আজ়াদ বলেন,  "The ordinance is arbitrary and unnecessary bringing a draconian, illogical, unreasonable and vague legislation. Through the route of ordinance shows a lack of respect for parliament and the people whose faith lies in India's secular constitution,"

          কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে আবার এটা নাকি মেয়েদের মুক্ত করার বদলে বৈবাহিক পিতৃতন্ত্রে বেঁধে রাখা – “The whole approach behind the ordinance is one that keeps women entrenched in the marital patriarchy rather than liberating them. It works on the fundamental assumption that marriage is integral and inseparable from the identity of a woman. Such a mindset is backward and needs to change. The ordinance needs to be reconsidered as it fails to achieve its objects and only creates more legal confusion.” অর্থাৎ মেয়েদের জন্য যে বৈবাহিক সম্পর্ক জরুরি নয়, তা এই বুদ্ধিজীবীরা ঠিক করে দেবে। খেয়ালখুশিমতো বৌকে তাড়িয়ে দেওয়াটা একটি সম্প্রদায়ের পুরুষদের মৌলিক অধিকার, কিন্তু মেয়েদের পারিবারিক বা সামাজিক সুরক্ষা চাওয়া হল পশ্চদবর্তিতা। দিল্লী উচ্চ ন্যায়ালয় অবশ্য কেসটি খারিজ করেছে।

১৯৩৭-এর শরিয়ত আইন বা তার পরবর্তী ১৯৩৯-এর Dissolution of Muslim Marriages Act-এর থেকে আজকের সুপ্রীম কোর্টের রায় বা নতুন বিল যে অতিরিক্ত কিছু চাইছে না, এমনকি অসাম্প্রদায়িক আইনি অভিন্নতাও নয়, তা হয় এরা জানে না, কিংবা জেনেও বিশেষ উদ্দেশ্যে অযৌক্তিক অবস্থান থেকে সরে আসতে রাজি নয়। আর নিকাহা হালালার নামে মৌলবিদের নারীর শরীর ও টাকা দুটোই ভোগ করার যে ঘৃণ্য ব্যবসায়িক চক্রান্ত তার সম্পর্কে তো এদের নীরবতা অটুট।

যাই হোক, এত বিরোধিতা সত্ত্বেও ৯ আগস্ট ইউনিয়ান ক্যাবিনেট Muslim Women Protection of Rights on Marriage Bill-টিতে তিনটি সংশোধনসহ অনুমোদন করে লোকসভায় পেশ করে, যাতে অভিযুক্ত খোরপোষ দিতে রাজি হলে জামিন পেতে পারে। কিন্তু লোকসভাতে তিন তালাক বিলটি উত্থাপিত হওয়ার পরে আলোচনার বদলে বারবার হট্টগোল শোনা গেল। বিজেপি বিলটি নিয়ে আলোচনার দাবি জানালে কংগ্রেসসহ এআইএমআইএম, তৃণমূল কংগ্রেস, এনসিপি, সিপিআই এর মতো বিরোধীরা বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবিতে সোচ্চার হয়। কংগ্রেসের দাবি, “মহিলাদের সুবিচার নয়, মুসলিম পুরুষদের সাজা দিতে আনা হয়েছে তিন তালাক বিল।” সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করলেও যেখানে কখনও শাস্তির কথা বলেনি, সেখানে কেন্দ্র তিন বছর কারাদণ্ডের সংস্থান করে আসলে মুসলমান মহিলাদের সুবিচারের বদলে মুসলমান পুরুষদের জব্দ করার চেষ্টা করছে – এমনই দাবি করেছেন কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেব। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, ২০টি ইসলামিক দেশে এই নিয়ম থাকলে কেন ভারতে তা চালু হবে না। ফলে রাজনীতি সরিয়ে সকলের কাছে বিল পাসে সহযোগিতার আবেদন জানান রবিশঙ্কর প্রসাদ।

সহযোগিতার পরিণামে দেখা গেল সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ অর্ডিনান্স জারি করা বিলটিও লোকসভা পেরিয়ে গেলেও রাজ্যসভার মহামান্য রথী-মহারথীদের হাতে মার খেয়ে কোমায় চলে গেল। মানে সংসদের ২০১৮-র মৌসুমি ও ২০১৯-এর বাজেট অধিবেশন পর্যন্ত অচলাবস্থা কাটল না।

তারপর তো উত্তরপূর্বে নাগরিক পঞ্জি (National Population Registrar or NRC) নিয়ে লাগাতার ঝামেলার মধ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ (Citizenship Amendment Bill 2016)-ও একই কায়দায় নানা বিতর্কে আটকে গেল। উপরন্তু অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিতে একদিকে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার অবকাশ তৈরি হল, অন্যদিকে উত্তরপূর্বে দলের জোটসঙ্গী এমনকি নিজেদেরই প্রাদেশিক শাখা তথা জনগণের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে তাদের রাজনৈতিক জমিও নড়বড়ে হয়ে গেল। এই অবস্থায় পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলার পর দেশভক্তির পালে হাওয়া লেগে শাসকদল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সুবিধা পাবে না বিদায় হবে সেই অনিশ্চয়তাও দানা বাঁধল। কারণ বিবিধ আর্থিক ও বাণিজ্য নীতির কারণে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচারে গড়পড়তা বেতনভোগী ও সাধারণ মানুষের একাংশ বেশ ক্ষুব্ধ, যে ক্ষোভ মেরুকরণ বা দেশভক্তির আবেগ দ্বারা কতটা প্রশমিত হবে বলা যাচ্ছিল না। শুধু এটা নিশ্চিত বিজেপি লোকসভা ও রাজ্যসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীত্ব না পেলে অচলায়তন কাটার সম্ভাবনা নেই। আবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করলেও যে সদিচ্ছা বজায় থাকবে, বা বিরোধী পক্ষ থেকে নতুন কোনও ষড়যন্ত্র রচিত হবে না, তাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছিল না।

সেই অনিশ্চয়তার অবসান হল ভারতীয় জনতা পার্টি পুনরায় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসায় ও তাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, একটি মানবিক পদক্ষেপের জন্য কেন শুধু একটি বিশেষ দলের ক্ষমতায় আসীন থাকা জরুরি হবে। সংবিধানের ৪৪ নং ধারায় বিবেকের ভূমিকায় ‘নির্দেশক নীতি’ বা Directive Principals হিসাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগুর প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে উল্লিখিত থাকলেও তা পালনের চেষ্টা হলে দেশজুড়ে কেন এত আপত্তি উঠবে?

































১০
অভিন্ন আইন ও ভারতীয় সংবিধান



তিন তালাক নিয়ে বিতর্কে অন্যতম প্রাসঙ্গিক বিষয় ‘অভিন্ন দেওয়ানি আইন’ (Uniform Civil Code)  যা ভারতীয় সংবিধানে ‘নির্দেশক নীতি’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত। আইনি অভিন্নতা যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হওয়ার কথা, ভারতবর্ষে সেখানে বিষয়টি বরাবর সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার বিপ্রতীপে দেখা হয়েছে।

পৃথিবীর বৃহত্তম ও জটিলতম এই ভারতীয় সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়রি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। সংবিধান পরিষদ বা Constituent Assembly-র সদস্যরা ডঃ ভীমরাও আম্বেদকারের নেতৃত্বে অনেক কালঘাম ছুটিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সংবিধান রচনা করলেও এর ভিত ব্রিটিশদের তৈরি।

ব্রিটিশরা মোটামুটি সব ক্ষেত্রে অভিন্ন আইন লাগু করতে পারলেও কিছু দেওয়ানি বিধি যেমন সম্পত্তি (property), বিবাহ (marriage), বিবাহ-বিচ্ছেদ (divorce), ভরণপোষণ (maintenance), দত্তক (adoption) এবং উত্তরাধিকার (inheritance) – যেগুলো ব্যক্তিগত আইন (personal laws) হিসাবে গণ্য সেইসব ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেনি।

১৮৩৫ সালের প্রথম এবং ১৮৫৩-র দ্বিতীয় আইন কমিশন (law commissions) তৈরির উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষভাবে সমস্ত সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রণয়ন করা। দ্বিতীয় ল কমিশন তো ব্যক্তিগত আইনকে ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলিম’ বলে চিহ্নিতকরণেরও বিপক্ষে ছিল। “The Hindu law and Mohammadan law derive their authority respectively from the Hindu and Mohammadan religion. It follows that, as British legislature cannot make Mohammadan or Hindu religion, so neither it can make Mohammadan or Hindu law. A code of Mohammadan or a digest of any part of that law, if it were enacted as such by the legislative council of India, would not be entitled to be regarded by Mohammadans as very law itself but merely as an exposition of law, which possibly might be incorrect. We think it clear that it is not advisable to make any enactment which would stand on such a footing”। কিন্তু কমিশনের সদস্যরা অভিন্নতার পক্ষপাতী হয়েও প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় বিষয়টায় হাত দেননি। দেওয়ানি বিধিগুলো মূলত সামাজিক রীতি নির্ভর যা নির্ধারিত হয়ে থাকে ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা। হিন্দুদের ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষিত মানুষের অনুপ্রেরণায় আইন সংস্কারের তাগিদে শাস্ত্রীয় সংহিতাগুলোকে উপেক্ষা করা গেলেও মুসলিমদের ধর্মীয় অনুশাসনে হস্তক্ষেপ করার সাহস ব্রিটিশ সরকারও দেখায়নি।

তাছাড়া হিন্দুদের সব শ্রেণীর জন্য কোনও সার্বজনীন নিয়ম-বিধি ছিল না কোনওদিনই। ব্রাহ্মণ তথা বর্ণহিন্দু বিধবাদের জন্য কঠোর কৃচ্ছসাধনের শাস্ত্রীয় বিধান থাকলেও কিছু কিছু শূদ্র সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল। এই কারণেই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও সতীদাহ রদ (Bengal Sati Regulation, 1829), বিধবাবিবাহ আইন (Hindu Widow Remarriage Act of 1856), মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিতে হিন্দু উত্তরাধিকার বিধিতে বৈষম্য দূর (Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act, 1928)ইত্যাদি সংস্কার সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম সমাজের নিজস্ব সদিচ্ছার অভাবে শরিয়তি কানুনকে যুগপোযোগী সংস্কার করা যায়নি, বদলে পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থের ভিত্তিতে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে একতরফা বিবাহবিচ্ছেদ (unilateral divorce), বহুবিবাহ (polygamy) এগুলোকে আইনি মান্যতা দেওয়া হয়। খুল্লার ব্যাপারটা ১৯৩৭-এর শরিয়ত আইনে থাকলেও কার্যক্ষেত্রে উপেক্ষিত। আর সেই অসম্পূর্ণতা, সেই বৈষম্যের ঐতিহ্যই স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও আমরা বহন করে চলেছি ও চলতে চাইছি।

ভারতীয় সংবিধান মূলত একটি সামাজিক দলিল (social document) যার কিছু প্রস্তাব (provisions) সরাসরি সমাজ সংস্কারের স্পষ্ট নির্দেশ হলেও কিছু রয়ে গেছে সংস্কারের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির বাধ্যবাধকতাহীন নীতি-নির্দেশিকা রূপে। এইগুলি ‘নির্দেশক নীতিসমূহ’ বা Directive Principles of State Policy হিসাবে সংবিধানের ৪৪ নং ধারায় (Article 44) রাখা হয়েছে। এই নীতিগুলোর ভূমিকা অনেকটা সংবিধানের বিবেকের মতো প্রচ্ছন্ন, কার্যকরী ক্ষমতা নেই তাদের। একই সঙ্গে সংবিধান নাগরিকদের কিছু মৌলিক অধিকারের প্রতিশ্রতিও দিয়েছে যার মধ্যে ধর্মাচরণের অধিকারও শামিল। আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে সমানাধিকারের কথাও উল্লেখ করতে হয়।

প্রাক-সংবিধান কালে নাগরিক অধিকারের অন্যতম দলিল হল সাপ্রু রিপোর্ট (Sapru Report) যা ১৯৪৫ সালে প্রকাশ পায়। এতে একই সঙ্গে সমানাধিকার ও ব্যক্তিগত ধর্মাচারণের স্বাধীনতা দেওয়া ছিল যেটা কার্যক্ষেত্রে প্রায়ই পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। That what the Constitution demands and expects is perfect equality between one section of community and another in the matter of political and civil rights, equality of liberty and security in the enjoyment of the freedom of religion, worship, and the pursuit of ordinary applications of life”। সংখ্যালঘুদের ভীতি দূর করতে গিয়ে ধর্মাচারণের অধিকারে জোর দেওয়া হয়। গ্র্যানভিল অস্টিন (Granville Austin)-এর মতে সাপ্রু রিপোর্টের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিচারযোগ্য (justiciable) অধিকার ও  বিচারোর্ধ্ব (non-justiciable) অধিকারের মধ্যে তফাৎ করে দেওয়ায়। এটাই পরবর্তী সংবিধানের অন্তর্নিহিত নীতি থেকে যায়, যার ফলে ‘নির্দেশক নীতিসমূহ’ রাষ্ট্রের পক্ষে একটা  বিচারোর্ধ্ব বা বিচার বহির্ভূত ঐচ্ছিক বিষয় রয়ে গেছে।

এখন ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্মাচারণ বিরোধী নয়। সংবিধানের ২৭ ও ২৮ নং ধারা ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ (secular) দেশ ঘোষণা করেছে যেখানে সব নাগরিককে ধর্মাচারণ, ধর্ম শিক্ষা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে চাঁদা বা আর্থিক অনুদান দেওয়া তথা সংগঠন করার সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। আর এখানেই কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদ এবং ধর্মের মোড়কে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য কায়েমের অধিকার স্বীকৃত, যা বলা বাহুল্য আর যাই হোক সমানাধিকারের অনুকূল নয়। অবশ্য ‘সমানাধিকার’ বলতে নারীর ওপর সব সম্প্রদায়ের পুরুষের সমান অধিকার বোঝালে আলাদা কথা।

সম্প্রদায় নির্বিশেষে অভিন্ন দেওয়ানি আইন তাই শুধু একটি নির্দেশক নীতি হিসাবে স্থান পেয়েছে সংবিধানের ৪৪ নং ধারায়। "The State shall endeavour to secure for citizens a uniform civil code  throughout the territory of India." মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (Muslim Personal Law) যার ভিত্তি হল ১৯৩৭-এর শরিয়া আইন তাকে স্পর্শ করার সাহস এই নীতিকথাটির কোনওদিন হয়নি; কেবল শাহবানু মামলা, তিন তালাক বিরোধী মামলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ হিসাবে উত্থাপিত হয়েছে মাত্র। গোয়ায় সাধারণ পারিবারিক আইন (common family law) থাকায় ভারতে একমাত্র এই ছোট্ট প্রদেশটিতেই অভিন্ন দেওয়ানি আইনের অস্তিত্ব রয়েছে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয়। একমাত্র বিশেষ বিবাহ আইন ১৯৫৪ (Special Marriage Act, 1954 ) ব্যক্তিগত ধর্মীয় খবরদারি ব্যতিরেকে আইনি বিবাহের অনুমতি দেয়।



 

ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর

বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সমানাধিকার, নারীর অধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের জন্য প্রথম দাবি করেন কিছু মহিলা সমাজকর্মী। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা পর্যন্ত গুটিকয় আইন সংস্কার হয়েছিল মেয়েদের বিশেষত হিন্দু বিধবাদের অবস্থার উন্নতির জন্য। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু স্বয়ং অভিন্ন দেওয়ানি নীতির উদ্যোক্তা ছিলেন। আইনমন্ত্রী ডাঃ বি. আর. আম্বেদকারও বলিষ্ঠভাবে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তিনি ধর্মকে আইনের মাথায় চেপে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়ার মোটেই পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর ভাষায় “I personally do not understand why religion should be given this vast, expansive jurisdiction so as to cover the whole of life and to prevent the legislature from encroaching upon that field.” কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের ভেদাভেদের তিনি ছিলেন কঠোর সমালোচক। তাছাড়া নিজেও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই কারণে হিন্দু নেতারা তাঁর প্রস্তাবে সহমত হতে পারেননি।


জওহরলাল নেহেরু
 

জওহরলাল নেহেরু


তা সত্ত্বেও পণ্ডিত নেহেরুর উদ্যোগে ১৯৫৬ সালে ভারতীয় সংসদ Hindu Code Bill  নিয়ে আসে। হিন্দু কোড বিলের বহু বিবাহ রদ, বিবাহ বিচ্ছেদে অনুমোদন, পুত্রসন্তানদের একচেটিয়া উত্তরাধিকার বাতিল (abolition of  co-parcenaries) তথা কন্যাসন্তানকেও উত্তারিকার প্রদানএই প্রস্তাবগুলো তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। এমনকি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতো মানুষও এই সংস্কারগুলোর বিরোধী ছিলেন। হিন্দু বিরোধী তথা ভারত বিরোধী অপবাদ পেলেও ‘হিন্দু কোড বিল’ কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ১৯৫৬ সালে সংসদে পাস হয়ে যায়। এর চারটি ধারা ছিল হিন্দু বিবাহ আইন (Hindu Marriage Act), উত্তরাধিকার আইন (Succession Act), নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইন (Minority and Guardianship Act) এবং দত্তক ও ভরণপোষণ আইন (Adoptions and Maintenance Act)।

এরই ফলস্বরূপ মূলত নেহেরু, তাঁর সমর্থক এবং মহিলা সমাজসেবীদের আগ্রহে ‘অভিন্ন আইন’ বিষয়টিকে কোনওক্রমে একটি ‘নির্দেশক নীতি’ বা ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপাল হিসাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করানো যায়। সংবিধানের ৪৪ নং ধারায় এই আশ্বাসবাণী বলে যে, ভারতীয় ভূখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি আইন লাগু করার চেষ্টা হবে ("The State shall endeavour to secure for citizens a uniform civil code throughout the territory of India.")। রাজকুমারী অমৃত কৌর, হাসনা মেহেতার মতো নেত্রী এরও বিরোধিতা করেছিলেন। অপর্ণা মহান্ত যথার্থই লিখেছেন, "...failure of the Indian state to provide a uniform civil code, consistent with its democratic secular and socialist declarations, further illustrates the modern state's accommodation of the traditional interests of a patriarchal society"। সংবিধানের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ভারতে একই সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য বজায় রাখার জগাখিচুড়ি প্রচেষ্টার ফলেই অভিন্ন দেওয়ানি আইন আজও সার্বজনীন করা যায়নি।

     ২০১৭-য় অভিন্ন দেওয়ানি আইনের প্রসঙ্গ পুনরায় উত্থাপিত হয়েছে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করায়। আইন মন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদ লিখিত প্রত্যুত্তরে জানান যে সংবিধানের ৪৪ নং ধারায় বিষয়টি ইতিমধ্যেই রয়েছে, দরকার শুধু নতুন করে আলোচনার। এখন অভিন্ন দেওয়ানি আইন শুধু বিবাহ ও বিচ্ছেদে আবদ্ধ নয়; সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ, দত্তক সবকিছুই এর আওতায় চলে আসে। অর্থাৎ হিন্দু, খ্রিস্টান এদের মতো মুসলিম কন্যাসন্তানদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে পুত্রের সমান অধিকার, বিবাহ বিচ্ছিন্ন স্ত্রীর আজীবন বা তার পুনরায় বিবাহ না হওয়া অব্দি ক্ষতিপূরণ বা ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থে ভারতীয় মুসলিমরা তাই অভিন্ন আইনকে চিরকাল তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ বলে মনে করে এসেছে ও করে যাবে।

দুঃখের বিষয় এই ভাবনার শরীক অধিকাংশ মুসলিম মহিলারাও, যাদের অনেকেই তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরোধিতা করলেও শরিয়তি আইন নাকচ করে অভিন্ন দেওয়ানি আইন লাগুর দাবি জানাচ্ছে না –  হয়তো ধর্মীয় অনুশাসনকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে চাইলে ব্যক্তিগত স্তরে তাদের ওপর জোর জুলুম আরও বাড়তে পারে সেই আশঙ্কা আছে বলেই। কিন্তু পুরুষদের হটকারিতা করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দায় যখন রাষ্ট্রের ওপর ‘তালাক ভাতা’র নামে চাপানোর দাবি ওঠে, তখন তাকে ‘ইমাম ভাতা’ বা ‘হজ ভর্তুকি’র মতো সুবিধাবাদ থেকে পৃথক করা মুশকিল হয়ে পড়ে। প্রগতিশীলতার মোড়কে যদি এই মানসিকতা অনড় থাকে, তাহলে আর যাই হোক অভিন্নতার পথ প্রশস্ত হয় না।

তাছাড়া তালাক-এ-বিদ্দত-এর বিপক্ষে মুসলিম মহিলাদের একটা অংশ সুরক্ষা চাইলেও অভিন্ন দেওয়ানি আইনের পক্ষে কখনই কোনও সওয়াল করেনি। বরং একটা বড় অংশই নিজেদের সুরক্ষা ও সম্মানের বদলে শরিয়তে হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। অভিন্নতার দিকে সামান্যতম পদক্ষেপ যে মুসলিম সমাজ থেকে সম্মিলিত বিরোধিতা ডেকে আনবে, তা মোটামুটি আঁচ করাই যায়। এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও অভিন্ন দেওয়ানি আইনের বদলে কেন শরিয়তি খবরদারি বহাল থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা দেখিয়ে খুবই উদ্বেগে ছিলাম। 





 
  

১১

প্রসঙ্গত



এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে রুশদি কে বাপ? নিরক্ষর করিমচাচার প্রশ্নশীর্ষক একটি আলোচনার কথাসালমান রুশদি কলকাতা বইমেলায় আমন্ত্রিত হয়েও কিছু মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশের জেরে বিমানবন্দরে পদার্পণ করেই ফিরে যাওয়ার পর সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০১৩-র ফেব্রুয়ারির আনন্দবাজারে প্রকাশিতলেখক প্রতীচী ইন্সটিটিউটের কর্মী মুখলেসুর সুলেমান গাইন লিখেছিলেন, “পরিবর্তনের সরকার অধিক মুসলমানপ্রীতি দেখাতে গিয়ে এমন কিছু ধর্মীয় ভাবাবেগকেই তুলে ধরছে, লোকেদের জীবনমানের সঙ্গে যার কোনও যোগ নেই। সরকারি ভাবেই একটা ‘মুসলমান করণ’ ঘটে যাচ্ছে।” এই প্রবণতা বিপজ্জনক। তাঁর মতো কিছু আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত মুসলমান মনে করেন প্রকৃত উন্নয়নসাধনের চেয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামির সরকারি স্তরে প্রতিপালন সম্প্রদায়টিকে ‘ধর্মান্ধ’ হিসাবে চিহ্নিতকরণ ছাড়া আর কোনও উপকার করছে না। প্রতীচী ইন্সটিটিউটের সমীক্ষায় প্রকাশ মুর্শিদাবাদ মালদহের মতো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রী উপচে পড়ছে, কিন্তু পরিকাঠামোর অভাব। যার ফলে মুসলমানরা স্কুল কলেজ উচ্চশিক্ষা বিমুখ আর মাদ্রাসামুখী, এমন ধারণা জনমানসে পরিপুষ্ট হচ্ছে। ঘটনাটা পশ্চিমবঙ্গের হলেও, এই মানসিকতা কম বেশি সারা ভারতবর্ষের রাজনীতিতেই

     এখনও এদেশের বহু শিক্ষিত মুসলমান পুরুষ এমনকি নারীও মানতে নারাজ, দেশের আইনদেওয়ানি কি ফৌজদারি নাগরিকের ধর্ম নির্বিশেষে অভিন্ন হওয়া উচি। তাঁরা যথার্থই মনে করেন শিক্ষার অভাব অধিকতর বড় সমস্যা। কিন্তু এর জন্য সম্প্রদায়টির মাত্রাতিরিক্ত ধর্ম নির্ভরতাকে দায়ী করেন না, বরং অভিযোগ তারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তপশিলি জাতি উপজাতির মতো তাদেরও সংরক্ষণ থাকা উচি। রহমান গাইনদের মতো কমই আছেন, যাঁরা মনে করেন মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে মাদ্রাসার বদলে উন্নত পরিকাঠামোর স্কুল, কলেজ গড়ে ওঠা বেশি জরুরি। এঁদের আক্ষেপ২০১৩-র সমীক্ষা অনুযায়ী রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে মুসলমানদের শতাংশ ২৫, উচ্চমাধ্যমিকে যা নেমে যায় ৮-এ, আর স্নাতক স্তরে ৪-এ।

একটা সুবিধা প্রগতিশীল মুসলিম রাষ্ট্ররা পায়, তা হল আত্মসংশোধন করতে গিয়ে তারা পরধর্মে হস্তক্ষেপ করছে বলে চিহ্নিত হয়না, যেটা ভারতের মতো বহু জাতিক ভাষিক ও ধর্মাবলম্বী দেশের কাছে একটা জটিল সমস্যা

     ধর্মীয় রাজনীতির মতোই জাতপাতের রাজনীতিও কিন্তু আইনি না হোক প্রশাসনিক ও সামাজিক অভিন্নতার বিরোধী। শিক্ষার সমান সুযোগ করে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, তপশিলি জাতি ও জনজাতি তালিকাভুক্ত কিছু পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি হওয়া থেকে, চাকরি লাভ, এমনকি পদোন্নতিসব ক্ষেত্রে তাদের থেকে মেধায় যোগ্যতর সাধারণ প্রার্থীদের মাড়িয়ে এগিয়ে যাবার সুযোগ ভোগ করবে। যুগ যুগ ধরে বর্ণহিন্দুরা যে বিভেদ বৈষম্য করে এসেছে তথাকথিত নীচু জাতের প্রতি, সংরক্ষণ তা দূর করার বদলে বিভেদটাই প্রকট করে তুলছে। এতে করে তথাকথিত উচ্চবর্ণের বা সাধারণ জাতের হিন্দুদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের মনেও র্ষার সঞ্চার হওয়া কিছু মাত্র বিচিত্র নয়; এবং সেটাই হচ্ছে সংখ্যালঘু বলে চিহ্নিত সম্প্রদায়ের মধ্যে, যারা সংখ্যায় সত্যিই লঘু হলে ভোট-শিকারীদের এতটা মাথাব্যথা থাকত না

বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের আমলে ‘মণ্ডল কমিশন’ নিয়ে দেশময় অগ্নি সংযোগে আত্মাহুতির বন্যা বয়ে গেলেও মন্ত্রীত্ব দখলকারীদের তাতে বিকার হয়নি। রাজস্থানে গুজ্জর ও মিনা দুটি গোষ্ঠির মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা লেগে থাকেএকটি জাতি তপশিলি তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলে অপরটি কেন করবে না। তাতেও হেলদোল নেই। উপরন্তু একই জাতি বা জনজাতি এক রাজ্যে তপশিলি তালিকাভূক্ত, কিন্তু অন্য প্রদেশে নয়। এরকম অসঙ্গতি আরও আছে।

সরকারি উদ্যোগে এ অসুখ সারাবার বদলে ‘তপশিলি সংরক্ষণ’, ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ রক্ষা ইত্যাদি জাতীয় ‘তোষক’ চাটনি পরিবেশন করা হয়ে থাকে; যাতে তুষ্ট কোন পক্ষ হচ্ছে, আর অসন্তোষ কতটা পরিব্যপ্ত হচ্ছে, তার দিশা পাওয়া দুষ্কর। ইমামদের জনগণের টাকায় সরকারি মাইনে দিলে বা হজ যাত্রায় কিছু বিত্তবানকে সরকারি ভর্তুকি দিলে যে করিমচাচাদের জীবনযন্ত্রণা কমে না, এটা তো কারও অজানা নয়। তবু এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে চালু করে বা পুষে রেখে কিছু মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী মানুষের স্বার্থ সিদ্ধি দ্বারা গোটা সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা।

ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা হজ ভর্তুকি বন্ধে মাইনরিটি কমিশন ও মুসলিম সংগঠনগুলোর গড়পড়তা সমর্থন পাওয়ায় বিরোধীরা খুব একটা খেলার সুযোগ পায়নি। যদিও আপাতত হজ ভর্তুকি বন্ধ হওয়ার বদলে নতুন প্যাকেজে চালু হয়েছে, তবে অচিরে প্রত্যাহৃত হলে আশ্চর্য হব না। অন্যদিকে নব উদ্ভাবিত অসাংবিধানিক ইমামভাতা নিয়ে বিরোধিতার পরোয়া না করেও চলে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের যেহেতু সংখ্যাগুরুর ভোট কোনও কারণেই একমুখী হয় না। কিন্তু তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আইনে পুরুষ পরিচালিত মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ও নেতাদের তীব্র আপত্তি ও রাজনৈতিক দাওপ্যাঁচে জল এত ঘোলা হয়েছে যে বিরোধীদের মাছ ধরার কাজটা বেশ সহজ ও উপভোগ্য ছিল

অশিক্ষা, অপরাধ ও দারিদ্রক্লিষ্ট সম্প্রদায়টির মধ্যে থেকে কিছু জাগ্রত চেতনায় যদিও বা কখনও কখনও সংস্কার, সংশোধন ও উন্নয়নের তাগিদ অনুভূত হয়, তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর চেয়ে অনেক সহজ সম্প্রদায়টির চিরাচরিত ধর্মান্ধ ভাবমূর্তি বজায় রাখা। উন্নতির পথে বিঘ্ন কাটিয়ে এক পা এগোতে সাহায্য করার চেয়ে অনেক সহজ জগদ্দল পাথরটাকে স্বস্থানে রেখে মহিমান্বিত করা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দেশবাসীকে বার বার মৌলবাদের কাছে পদানত করে ক্ষমতা দখল ও ধরে রাখার ঘৃণ্য খেলাটাই কি তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্রের একমাত্র নিয়তি? প্রতিক্রিয়ায় শক্তিসঞ্চয় করা প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মীয় উন্মাদনাও তো কোনও সদর্থক বিকল্প হতে পারে না।

প্রসঙ্গত সংসদের উচ্চতর কক্ষে তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী বিলটির বারবার গতিরোধ হওয়ার মধ্যে দেশের আভ্যন্তরীণ অস্থিরতা অব্যাহত। বেলাগাম অপরাধ দমনে ব্যর্থ কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি সকলেই। কিন্তু কতগুলি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় যে হারে বাছাই করা সাম্প্রদায়িক তথা রাজনৈতিক রং লেগেছে বা লাগানো হয়েছে, তার জেরে সম্ভবত বিজেপি-র মুসলিম মহিলা দরদ তো বটেই সামগ্রিকভাবে নারী কল্যাণের সদিচ্ছার প্রতিও প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে বারবার। আশঙ্কা ছিল যদিও অভিযুক্তরা বিচারাধীন, তবু সরকার ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বিরোধী আইন প্রণয়নে কোনও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে গেলে তার নৈতিক অধিকার নিয়ে কথা উঠতে পারে। এখনও পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলির জন্য সামগ্রিভাবে হিন্দু সমাজ ও একটি বিশেষ রাজনৈতিক শিবিরকে দোষারোপ করা ছাড়া বিরোধীরা ও মিডিয়া তালাক প্রসঙ্গটিকে জড়ায়নি। কিন্তু সময়মতো তুরুপের তাস বার করবে না, কে বলতে পারে? তাই ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে আইন সংস্কারের ঝুঁকি নেওয়া যথেষ্ট মুশকিল ছিল।

কিন্তু তারই মধ্যে দুঃসাহসিকভাবে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮-য় লোকসভায় বিরোধিতা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরোধী বিলটির ওপর জারি হল নির্বাহী আজ্ঞা (The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Ordinance, 2018। অভিযুক্ত পুরুষটির শাস্তি কমিয়ে খোরপোষের শর্তসাপেক্ষে জামিনযোগ্য করা হলেও মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড তথা বিরোধীদের তাতে ভেজানো গেল না। সুতরাং একই নাটকের পুনরাবৃত্তি করে বিলটি লোকসভায় ফাঁড়া কাটালেও রাজ্যসভায় ধরাশায়ী হয়ে পড়ে রইল। বিলটির জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হল লোকসভা নির্বাচনে এই বর্তমান ফ্যাসিস্ট শাসকদলটি ও তার স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রীর পুনরায় ক্ষমতায় আসার।

ওদিকে এনআরসি নিয়ে আসামে চরম অনিয়ম ও জাতিবিদ্বেষের প্রতিবাদ এবং সেই সূত্রে প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের নাগরিকত্ব দিতে চাওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ও বিরোধিতা তো আছেই। শুধু বিরোধী শিবির নয়, উদ্বাস্তু অমুসলিমদের দরাজভাবে নাগরিকত্ব দানের প্রশ্নে উত্তরপূর্ব ভারতে শাসকদলেরই প্রাদেশিক শাখাগুলো ও জোটসঙ্গীরা বিরূপ। এই বিরূপতা লোকসভা ভোটেও ছাপ ফেলতেই পারত।

এই তুলকালামের মধ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ-এর ওপর জঙ্গি হামলার জেরে দেশে যুদ্ধের ‌আবহ ও দেশপ্রেমের বাতাস তৈরি হল। অমনি সেনা হত্যা থেকে পাকিস্তানে গোলা বর্ষণ– নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে সমস্তটাই শাসকদলের সাজানো ঘটনা বলে বিরোধীরা একজোটে অভিযোগ তুলল। শাসকদলও যে সামরিক অভিযানের সাফল্য নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে নিজেদের পিঠ চাপড়ায়নি, তা নয়।

এখন নির্বাচনের ফল যাই হোক, তার জন্য একটা বহু প্রতীক্ষিত সংস্কারের ভবিষ্যৎ, একটি সম্প্রদায়ের মেয়েদের মানবাধিকার ঝুলে থাকতে পারে না। কিন্তু পরিতাপ তাই থেকেছে। এক অমানবিক ও ঘৃণ্য প্রথা নিবারণ শুধুমাত্র একটি তথাকথিত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলের দলীয় অ্যাজেন্ডা থেকে গেছে, রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হতে পারেনি। তাৎক্ষণিক তিন তালাকের চেয়ে আরও ন্যাক্কারজনক ‘হালালা’ প্রথাটিকে তো এখনও স্পর্শই করা গেল না।

নৃশংস গণধর্ষণে খুন হয়ে যাওয়া মেয়েদের যেমন বিদেহী হয়ে সুবিচার পাওয়ার উপায় থাকে না, আমাদের ব্যালট গণতন্ত্রেও তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতার শাপমুক্তি ঘটে না। বৈষম্য সংরক্ষণের প্রয়াস যেখানে এতটা সংঘবদ্ধ এবং তা অবসানের পক্ষে জনমত যেখানে এতটা অসংগঠিত, যেখানে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, মিডিয়া ও শিক্ষিত সমাজও ময়দানে নামে, যেখানে অত্যাচারিত মানুষকে দেশে আশ্রয় দেওয়াটা নৈতিক সমর্থন পায় না, অত্যাচারীকেও দিতে হবে দাবি ওঠে, সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি আইন সম্পর্কে আশাবাদ কল্পনাবিলাসমনে হয়েছিল। তবে ইতিহাসে ব্যতিক্রম ও তার পুনরাবৃত্তি দুটোই তো হয়ে থাকে



  










১২

যবনিকা



মধুরেণ সমাপয়েত বলা যায় কিনা জানি না, তবে সত্তর বছর ধরে লালিত অনাচার সংরক্ষণ নিয়ে ধানাইপানাইয়ের ওপর যবনিকা পড়ল। ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিন-তিন বার লোকসভা পার করেও রাজ্যসভায় মুখ থুবড়ে পড়ার পর অবশেষে ২০১৯ The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Bill রাজ্যসভার বেড়াও টপকে গেল

দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ হাত দেওয়ার সময় মনে মনে ভাবছিলাম, নতুন কিছু ঘটনা বা পদক্ষেপকে অন্তর্ভুক্ত করছি বটে, কিন্তু বৃত্তটা সম্পূর্ণ হচ্ছে কৈ? নানা কারণে বিলম্বের জন্য যেমন অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম, তেমনি মনে হচ্ছিল এই কালক্ষেপ থেকে যদি যথাযথ উপসংহার উঠে আসে তো বেশ হয়। লোকসভা ভোটের ফলাফল আশা জাগালেও রাজ্যসভায় শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তেমন কিছু আশা করিনি। তাই বিলটি ২৪ জুলাই ২০১৯-এ তুমুল হৈহল্লা ও বিরোধী ওয়াক আউটের মধ্যে দিয়ে লোকসভার বেড়া ডিঙোলেও রাজ্যসভার গেরোয় পুনরায় আটকে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিইনি। যদিও জানতাম রাজ্যসভায় বিজেপির আধিপত্য শুধু সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু সময়ের আগেই বিলটি লোকসভায় উত্তীর্ণ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এমন চমক আসবে, সত্যিই আশা করিনি।

৩০ জুলাই ২০১৯ শেষ পর্যন্ত বিলটি ৯৯-৮৪ ভোটে রাজ্যসভাতেও পাস হয়ে যায়। ৩১ জুলাই রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সাক্ষর করলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি জারি হয়েছিল যে অর্ডিন্যান্স, এবার তা নতুন মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ) আইন, ২০১৯ (The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Act, 2019) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। শুধু পাস হওয়া নয়, বিরোধীদের লাগাতার বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রায় অপরিবর্তিরূপে পাস হল। এই আইন মোতাবেক এবার থেকে মুসলিমদের মধ্যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে, যার শাস্তি জরিমানা ও তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে

একে রাজ্যসভায় শাসকদল বিজেপি-র সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তার ওপর তাদের জোটসঙ্গী বিজু জনতা দল বিলটিকে সমর্থন দিলেও অপর জোটসঙ্গী জেডি(ইউ) ও এআইডিএমকে ওয়াক আউট করে। তবু যে বিলটি রাজ্যসভায় জিতল, তার অন্যতম কারণ কংগ্রেস, বহুজন সমাজবাদী পার্টি, টিআরএস ওয়াইএসআর-এর একাধিক বিরোধীদলের সাংসদের ভোটদানে অনুপস্থিতি। লোকসভাতেও কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস সভাকক্ষ ত্যাগ করেছিল যদিও না করলেও তাতে ভোটাভুটির ফল প্রভাবিত হতো না। কিন্তু রাজ্যসভায় বিলটির অকালবোধনের পেছনে বিরোধীদের পরোক্ষ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

বিরোধীদের অভিযোগ, এই বিল আইনে পরিণত হলে এর দ্বারা বহুক্ষেত্রে মুসলিম পুরুষরা অযথা হয়রানির শিকার হবে যেহেতু বিল অনুযায়ী কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে পরোয়ানা ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা যাবে। বিরোধীরা এবারেও তাই সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছিল। সরকারের পাল্টা দাবি, অপব্যবহার রুখতে একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যেমন কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক তিন তালাকের শিকার হওয়া মহিলা তাঁর নিকটাত্মীয়ই অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন অভিযোগকারিণীর বক্তব্য শোনার পর ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন

মুসলিম মহিলারা এই বিল পাশ হওয়ার পর উৎসব যখন পালন করছে, তখনও বলা বাহুল্য চাপান উতোর অব্যহত। শাসকদল এটিকে লিঙ্গ সাম্য ও সুবিচার হিসাবে দেখছে আর বিরোধীরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সোজাসুজি বলেছেন এক মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথা (archaic and medieval practice) ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হল। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতা রাজ বব্বরের মতে মুসলিম মহিলাদের সুরক্ষার প্রতি তাঁদের নীতিগত সমর্থন থাকলেও বিলটির আইনে পরিণত হওয়া এক ‘ঐতিহাসিক ভুল’, কারণ দেওয়ানি বিধিকে ফৌজদারি মামলার আওতায় আনা হচ্ছে। A civil law has been changed into criminal law. This is a historic mistake.” সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মুখ্‌তার আব্বাস নাকভি যেখানে কংগ্রেসকে বিলের বিরোধিতা করার জন্য মানুষ ভবিষ্যতে শাস্তি দেবে বলে বিঁধেছেন, (“The people will punish the Congress in the time to come,”), সেখানে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসে মন্ত্রী ও  জমিয়ত-উলেমা--হিন্দ-এর রাজ্য সভাপতি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর বক্তব্য, তিন তালাক আইন ইসলামের উপরে হামলা, আমরা এটা মানছি না যখন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে, তখন আমরা আগামী পদক্ষেপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব একদিকে বিজেপি মন্ত্রী স্মৃতি ইরাণীর মতে মোদিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি মুসলিম মহিলাদের কষ্ট বুঝেছেন ও নিজের কথা রেখেছেনঅন্যদিকে All India Majlis-e-Ittehadul Muslimeen (AIMIM) দলের সভাপতি ও সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বিলটিকে মুসলিম সত্তায় আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই ভাবছেন না এবং টুউটারে হুমকি দিয়েছেন, মুসলিমদের এভাবে দমানো যাবে না, এই আইন কার্যকর হলে মুসলিম নারীদের অবস্থা আরও খারাপ হবে [“This law is against Muslim women & marginalizes them even more.”] মানে এখনও যে খারাপ সেটা অসাবধানে স্বীকার করে ফেলেছেন। তিনি টুইট করে ভারতের বৈচিত্র্য ও বহুত্বের প্রশ্নে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডকেও আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার আবেদন জানিয়েছেন (“I hope @AIMPLB_Official will challenge its constitutionality in our fight to save India's constitutional values of pluralism & diversity.)প্রাক্তন বিজেপি মন্ত্রী অরুণ জেটলি অরুণ জেটলি যেখানে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, তথাকথিত উদারপন্থীরাই একটি প্রগতিশীল আইনের বিরোধিতা করছে, (“Disheartened that the 'so called liberals' have opposed a progressive law. Congratulations to all, particularly Muslim women”) সেখানে আবার তৃণমূলের ডেরেক ও-ব্রায়ানের মন্তব্য এই বিল বিজেপি, ইডি ও সিবিআই-এর মধ্যে আঁতাত ছাড়া আর কিছুই নয়।

সম্পূর্ণ অযৌক্তিভাবে উত্থাপিত হচ্ছে সেইসব প্রসঙ্গ যার সঙ্গে কেন্দ্র সরকারি নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যেমন, সবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের ঢোকায় প্রতিবন্ধকতা যা বিজেপি সরকার আদৌ সমর্থন করেনি বরং তাদের আমলেই সুপ্রীম কোর্ট চিরাচরিত নিষেধাজ্ঞা তুলে মন্দিরকে সবার জন্য উন্মুক্ত করার রায় দিয়েছে। যেমন, বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে উন্নাও ধর্ষণ ও সাক্ষী লোপাটে একাধিক খুন করানোর অভিযোগ, যেখানে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার অভিযুক্তকে মোটেই আড়াল করার চেষ্টা করেনি, বরং তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে তুলে দিয়েছে।

যাইহোক, চাপান উতোর চলতেই থাকবে তবে সম্মিলিত এই অযৌক্তিক অনৈতিক চাপে সরকার আইন প্রত্যাহারের অবস্থানে যায় কিনা সেটাই দেখার যেভাবে আর একটি মোক্ষম চমক দিয়ে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ ও ৩৫এ ধারাদুটি তুলে নিয়ে রাজ্য ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা হল, তাতে সরকার সহজে পশ্চাদপসরণ করবে, এমনটা চরম উচ্চাকাঙ্খী বিরোধী শিবিরও মনে করছে না। কিন্তু মৌলবাদী নেতাদের হুমকি বা পার্সোনাল বোর্ডের যুক্তি অনুযায়ী সহজ বিচ্ছেদের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে মুসলিম মেয়েদের জীবন আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে কিনা, সেই উদ্বেগ কিন্তু এখনই কাটছে না কারণ তিন তালাকে হঠকারিতা দূর হলেও পুনর্মিলনের ঘৃণ্য পদ্ধতি ‘হালালা’ সম্পর্কে এখনই কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আইন শুধু থাকলেই হয় না, তাকে নিশ্ছিদ্র হতে হয়, যেখানে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক দেশে সমাজ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ফলে আইনকে চালুনির সঙ্গে তুলনা করলেও অতিশয়োক্তি হয় না 

কাগজে কলমে যে ইতিহাস রচিত হল, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনকেই নিতে হবে।











থ্যসূত্র ও নির্দেশিকা



1.     ফিউ ইন্ডিয়া প্রস্তুতি সংখ্যা: ডিসেম্বর ২০১১

2.     The Spirit of Islam: Sayed Amir Ali

3.     মুসলমান সমাজে সংস্কার আন্দোলন: মইনুল হাসান

4.     রোকেয়া রচনা সমগ্র

5.     দেশ বিদেশে সংগ্রামী নারী: অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন

6.     বাংলা কথা সাহিত্যে মুসলিম অন্তঃপুর: আফ্রোজা খাতুন

7.     মুসলিম সমাজকয়েকটা প্রাসঙ্গিক আলোচনা: মইনুল হাসান

8.     সৃজনী সাহিত্য পত্রিকা: নভেম্বর ২০০৫

9.     হায় ধর্ম ! বাবা বিয়ে করবেন পালিত কন্যাকে !! | ইস্টিশন

[https://istishon.com/?q=node/8932]  

10.   Female Muslim ‘Professor’ preaches Rape of non Muslim as Salves, Egypt [https://www.youtube.com/watch?v=QhkiUhNS7FQ]

11.   ইসলামে জায়েজ”: মাজেন আল সারসওই। ডেস্ক রিপোর্ট। টেনস্পোর্টস। http://tensports24.com/archibes/2404

12.   Triple Talaq in India [https://en.wikipedia.org/wiki/Triple_talaq_in_India]

13.   Mohammed Siddique Patel. "The different methods of Islamic separation – Part 2: The different types of Talaq". Retrieved 2017-05-29. [http://www.familylaw.co.uk/news_and_comment/the-different-methods-of-islamic-separation-part-2-the-different-types-of-talaq]

14.   Joseph, Suad; Naǧmābādī, Afsāna (2003), Encyclopedia of Women and Islamic Cultures: Family, Law and Politics, BRILL, p. 341, ISBN 90-04-12818-2

15.   Esposito, John L.; DeLong-Bas, Natana J. (2001). Women in Muslim Family Law (2nd ed.). Syracuse University Press.

16.   Choudhury, Cyra Akila (2008), "(Mis)Appropriated Liberty: Identity, Gender Justice and Muslim Personal Law Reform in India", Columbia Journal of Gender & Law, 17 (1): 45–110, pp. 72–73, p95

17.   Murshid, Tazeen Mahnaz (2003), "Inheritance: Contemporary Practice – South Asia", Ibid, p. 304

18.   Rao, Aparna (2003), "Kinship, Descent Systems and State – South Asia", Ibid, p. 341

19.   Mukhopadhyay, Maitrayee (August 1994), Construction of Gender Identity: Women, the State and Personal Laws in India, University of Sussex

20.   বর্তমান: ২২ ডিসেম্বর ২০১৭- ৪ জানুয়ারি ২০১৮

21.   Sati Practice [https://en.wikipedia.org/wiki/Sati_(practice)]

22.   Meenakshi Jain (2016). Sati: Evangelicals, Baptist Missionaries, and the Changing Colonial Discourse, Aryan Books International. ISBN 978-8173055522

23.   "Widow Burning in India" (PDF). The Wesleyan Juvenile Offering: A Miscellany of Missionary Information for Young Persons. Wesleyan Missionary Society. IX: 84. August 1852. Retrieved 24 February 2016.


25.    “Economic and Social Development under Mughal”, Muslim Civilization in India by S.M. Ikram, edited by Ainslie J.Embru New York. Colombia University Press, 1964

26.   The Portuguess Goan History from Inside Goa by Monohar Malgaonkar Meera Nanda, ‘Prophets Facing Backward’ p. 198

27.   Saroj Gulati, ‘Women and Society’, Northern India in 11th and 12th centuries.

28.   Genealogy. The Royal House of Shah, Nepal

29.   N.C. Nand, Women in Delhi Sultanate, Vohra pub and distributors, Allabad 1989

30.   “Women in Sikhism”, Sandip Sing Brar

31.   Women in Power, (1770-1800 and 1802-02), Sri Sri Maharani Raj Rajehwary Devi of Nepal_she was imprisoned and forcede commit  Sati.

32.   ‘Muslim Law in India and Abroad’ by Tahir Mahmood and Saif Mahmood

33.   Ajaz Ashraf - Ban triple talaq and abolish Muslim Personal Law Board, says former minorities commission chairman Prof Tahir Mahmood [https://dilipsimeon.blogspot.com/2015/05/ajaz-ashraf-ban-triple-talaq-and.html]

34.   Muslim Personal Law in India [https://en.wikipedia.org/wiki/Muslim_personal_law_in_India]

35.   A short history of Muslim personal law in India [https://scroll.in/article/849068/a-short-history-of-muslim-personal-law-in-india

36.   Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937. Pdf [https://indiankanoon.org/doc/1325952/]

37.   vakilno1.com. "The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937". vakilno1.com. Retrieved 13 February 2012. [http://www.vakilno1.com/bareacts/muslimperact/muslimpersonalact.htm]

38.   Richard M Eaton  The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760

39.   How the British invented Hinduism

[https://www.newstatesman.com/node/156145]

40.   Central Government Act: Hindu Marriage Act, 1955. pdf [https://indiankanoon.org/doc/590166/]

41.   George Rankin, Custom and the Muslim Law in British India Transactions of the Grotius Society, Vol. 25, Problems of Peace and War, Papers Read before the Society in the Year 1939 (1939), pp. 89-118, Published by: Cambridge University Press on behalf of the British Institute of International and Comparative Law

42.   Women in Muslim Family Law, by John L. Esposito and Natana J. DeLong-Bas, page 80

43.   Government of India Act 1935

https://en.wikipedia.org/wiki/Government_of_India_Act_1935

44.   Shah, K. T., Federal Structure (under the Government of India act, 1935), Bombay, Vora, 1937.

 [http://www.houseofdavid.ca/infedst.htm]

45.   Keith, A. Berriedale, A Constitutional history of India, 1600-1935, 2nd rev. ed. Metheun, 1937

46.   Rahiman, Abdul, K.K. "History of the Evolution of Muslim Personal Law in India" (PDF). Journal of Dharma: Dharmaram Journal  of Religions and Philosophies. Retrieved 1 December 2017.

47.   Archbold,  W. A. J., Constitutional History of India, 1926.

48.   Government of India Act 1935, Story of Pakistan

https://storyofpakistan.com/government-of-india-act-1935

49.   Cell, John W., Hailey : A Study in British Imperialism, 1872-1969, Cambridge University Press, 1992

50.   Gwyer, Sir Maurice and Appadorai, A. (editors), Speeches and Documents on the Indian Constitution, 1921-1947 (2 volumes), OUP 1957

51.   The Muslim Personal Law (Shariat) in India, 1937 https://en.wikipedia.org/wiki/Muslim_personal_law_in_India

52.   Rooychowdhary, Arija (4 May 2016). "Shariat and Muslim Personal Law: All your questions answered". The Indian Express. Indian Express. Retrieved 1, December 2017.

[http://indianexpress.com/article/research/shariat-muslim-personal-law-sharia-history-shayara-bano-shah-bano-triple-talaq-personal-laws-religious-laws-uniform-civil-code-2784081/] 

53.    "The Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939". indiankanoon.org. Retrieved 1 December 2017. [https://indiankanoon.org/doc/1458498/

54.   "The Hindu : Maintenance for Muslim women". 

www.thehindu.com. Retrieved 1 December 2017. [http://www.thehindu.com/2000/08/07/stories/05072524.htm]

55.   Daniyal, Shoaib. "A short history of Muslim personal law in India". Scroll.in. Scroll.in. Retrieved 2 December 2017. [https://scroll.in/article/849068/a-short-history-of-muslim-personal-law-in-india]

56.   http://en.wikipedia.org/wiki/Triple_talaq_in_India#cite_ref-19 Section 2 in The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 states about Application of Personal law to Muslims, "Notwithstanding any custom or usage to the contrary, in all questions (save questions relating to agricultural land) regarding intestate succession, special property of females, including personal property inherited or obtained under contract or gift or any other provision of Personal Law, marriage, dissolution of marriage, including talaq, ila, zihar, lian, khula and mubaraat, maintenance, dower, guardianship, gifts, trusts and trust properties, and wakfs (other than charities and charitable institutions and charitable and religious endowments) the rule of decision in cases where the parties are Muslims shall be the Muslim Personal Law (Shariat)."

57.   "Hanafi jurisprudence sanctions triple talaq - Times of India". The Times of India. Retrieved 2 December 2017. [https://timesofindia.indiatimes.com/city/hyderabad/hanafi-jurisprudence-sanctions-triple-talaq/articleshow/60182584.cms]

58.   "A Muslim Woman's Right To Property In Islamic Law". Makaan. Retrieved 2 December 2017.

[https://www.makaan.com/iq/legal-taxes-laws/examining-a-muslim-womans-right-to-property]

59.    mulla mohammaden law vol. 3

60.   Constitution of India, the legal instrument replacing the Government of India Act, 1935 in respect to modern-day India

61.   Muldoon, Andrew. Empire, politics and the creation of the 1935 India Act: last act of the raj (Routledge, 2016.


63.   All India Muslim Personal Law Board https://en.wikipedia.org/wiki/All_India_Muslim_Personal_Law_Board

64.    "Secular? That's a laugh".

 http://m.rediff.com/news/2005/may/09kanch.htm

65.   "The Muslim Personal Law Board Shouldn't Presume to Speak For All Indian Muslims".

 [https://thewire.in/law/indian-muslim-personal-law-board]

66.   Lawrence, Bruce B (15 November 2007). On violence: a reader. Duke University Press. p. 265. Retrieved 13 February 2012.

67.   "Uniform civil code: will it work in India?".

[https://www.thehindu.com/opinion/open-page/uniform-civil-code-will-it-work-in-india/article6625409.ece]

68.   Narain, Vrinda B (24 May 2008). Reclaiming the nation: Muslim women and the law in India. University of Toronto Press. p. 93. Retrieved 13 February 2012.

69.   "Youth raise voice, seek say in Muslim law board". [https://indianexpress.com/article/india/india-others/youth-raise-voice-seek-say-in-muslim-law-board/]

70.   Gani, H. A. (1988). Reform of Muslim personal law: the Shah Bano controversy and the Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act, 1986. Deep & Deep Publications. p. 65.

71.     "Muslim personal law is barbaric: Justice Markandey Katju".https://timesofindia.indiatimes.com/india/Muslim-personal-law-is-barbaric-Justice-Markandey-Katju/articleshow/43945087.cms

72.   "Ban triple talaq and abolish Muslim Personal Law Board, says former minorities commission chairman".https://scroll.in/article/724902/ban-triple-talaq-and-abolish-muslim-personal-law-board-says-former-minorities-commission-chairman

73.   Naqvi, Jawed (1 September 2008). "Religious violence hastens India's leap into deeper obscurantism". Dawn. Retrieved 2014-12-29.

74.   "IS THE AHMADI COMMUNITY JUST AS PERSECUTED IN OTHER MUSLIM-MAJORITY COUNTRIES?". 

Herald.Dawn. 13 October 2013. Archived from the originalon 29 December 2014. Retrieved 2014-12-29. http://herald.dawn.com/2013/10/13/is-the-ahmadi-community-just-as-persecuted-in-other-muslim-majority-countries.html

75.   Interview with Maulana Kalbe Sadiq, Shia scholar

http://twocircles.net/2007aug08/interview_maulana_kalbe_sadiq_shia_scholar.html#.V9U9gPB97IU

76.   PARVEEN ABDI (12 June 2006). "All India Muslim Women's Personal Law Board on Muslim Women's Reservation". milligazette.com. Retrieved 13 Feb 2012. http://www.milligazette.com/IndMusStat/2006a/966-aimwplb-12jun06-reservation.htm

77.   "Sharia courts should be first option: AIMPLB". The Times of India. 18 July 2007. Retrieved 13 February 2012. [http://articles.timesofindia.indiatimes.com/2007-07-18/india/27970400_1_sharia-muslim-women-aimplb]

78.    "All Muslims are equal: AIMPLB". The Times of India. 25 October 2006. Retrieved 13 February 2012. [http://articles.timesofindia.indiatimes.com/2006-10-25/india/27798198_1_aimplb-member-muslim-women-muslim-personal-law-board]

79.   TNN (5 February 2012). "Bill to address minorities' RTE concerns in next session: Sibal". The Times of India. Retrieved 13 February 2012.  

[http://articles.timesofindia.indiatimes.com/2012-02-05/delhi/31026414_1_minority-institutions-school-management-committees-kapil-sibal]

80.   Shia board moots model ‘nikahnama’, denounces ‘triple talaq’ in one sitting

[http://www.hindustantimes.com/lucknow/shia-board-moots-model-nikahnama-denounces-triple-talaq-in-one-sitting/story-E6a0ft9mnod91s7sKLe7MI.html]

81.   No Triple Talaq Without Both Husband And Wife's Consent: Shia Law Board [http://www.ndtv.com/india-news/no-triple-talaq-without-both-husband-and-wifes-consent-shia-law-board-1457034]

82.   India’s Muslim neighbours among 23 countries that have banned triple talaq

[https://www.hindustantimes.com/india-news/india-s-muslim-neighbours-among-23-countries-that-have-banned-triple-talaq/story-J8b9HkOCwdMAIWyscwxZMK.html

83.   India's neighbours among countries to ban triple talaq, April 2019

[https://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/indias-neighbours-among-countries-to-ban-triple-talaq/articleshow/65874255.cms]

84.   Turkish Civil Code

[https://en.wikipedia.org/wiki/Turkish_civil_code_(1926)]

85.   Constitution of Pakistan of 1956, the legal instrument replacing the Government of India Act, 1935 inrespect to post-partition Pakistan (comprising modern-day Pakistan and Bangladesh)

86.   Divorce Laws in Pakistan [https://www.ma-law.org.pk/Divorce_Laws_Divorce_Lawyer_in_Karachi_divorce_Lawyer_in_Lahore_divorce_law_firms_in_Pakistan.html]

87.   (PDF) Talaq and the Muslim Family Law Ordinance, 1961 in Pakistan.

https://www.researchgate.net/publication/228263366_

http://punjablaws.gov.pk/laws/777a.html

88.   স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক প্রদানের অধিকার: রায়হান ওয়াজেদ চৌধুরী[http://lawyersclubbangladesh.com/2018/07/21/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%A4/]

89.   মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রীকরণ) আইন, ১ঌ৭৪

http://www.khedaparaup.jessore.gov.bd/site/page/424622bf-1c4b-11e7-8f57-286ed488c766/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%AE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9-%E0%A6%93-%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%95-(%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3)-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8,-%E0%A7%A7%E0%A6%8C%E0%A7%AD%E0%A7%AA

90.   Ram Guha on when progressives turn reactionary and the demand for a Uniform Civil Code [https://www.hindustantimes.com/columns/when-progressives-turn-reactionary/story-h9Zwi5ZnbQ5Jjn0ak0A9VK.html]

91.   'Rajiv was pressured by Narasimha Rao, Najma Heptulla during Shah Bano  [https://www.hindustantimes.com/india-news/rajiv-gandhi-govt-caved-under-pressure-from-narasimha-rao-najma-heptulla-during-shah-bano/story-N3or1pJErtJkSUmqGX96FP.html]

92.    Arif Mohammad Khan on Shah Bano case: 'Najma Heptullah was key influence on Rajiv Gandhi https://scroll.in/article/730642/arif-mohammad-khan-on-shah-bano-case-najma-heptullah-was-key-influence-on-rajiv-gandhi

93.    Lalita Panicker Muslim men weighing in against triple talaq is encouraging ... https://www.hindustantimes.com/.../muslim-men...against-triple-talaq.../story-wa2bdk..

94.   All in the family | Goa Civil Code a model for the rest of the country? [https://www.hindustantimes.com/india-news/all-in-the-family-is-the-goa-civil-code-a-model-for-the-rest-of-the-country/story-4ImvwP0OrAST2hUnsZxtiL.html]

95.   deoband-fatwa-says-avoid-families-that-earn-haram-money [https://timesofindia.indiatimes.com/india/deoband-fatwa-says-avoid-families-that-earn-haram-money/articleshow/62364310.cms]  

96.   Watching soccer is un-Islamic: Darul Uloom cleric says women shouldn't watch ‘men playing with bare knees' http://timesofindia.indiatimes.com/india/watching-soccer-is-haram-muslim-cleric-says-women-shouldnt-watch-men-playing-with-bare-knees/atricleshow/62707660

97.   Darul Uloom Deoband issues fatwa against posting of photos on Facebook. [http://www.thehindu.com/news/national/fatwa-against-posting-of-photos-on-fb/article19884907.ece]

98.   Darul Uloom Deoband issues fatwa against designer burqas, says fit veils are anti-Islam. [http://www.firstpost.com/india/darul-uloom-deoband-issues-fatwa-against-designer-burqas-says-slim-fit-veils-are-anti-islam-4287177.html ]

99.    Darul Uloom at Deoband issues fatwa against polygamy : North, News. [http://indiatoday.intoday.in/story/darul-uloom-at-deoband-issues-fatwa-against-polygamy/1/184287.html]

100. Revolutionary Fatwa Against Polygamy By India's Darul Uloom ... [https://www.memri.org/reports/revolutionary-fatwa-against-polygamy-indias-darul-uloom-deoband-seminary

101. Deoband fatwa: Second wife not Indian custom | Free Press Journal www.freepressjournal.in/ujjain/deoband-fatwa-second-wife-not-indian.../72729]

102. Justice between two wives is very difficult- Deoband Fatwa | Polygamy... [https://polygynyinislam.wordpress.com/2014/11/04/justice-between-two-wives-is-very-difficult-deoband-fatwa/]

103. India Muslim Fatwa: ONLY 1 WIFE

[www.islamnewsroom.com/news-we-need/1860-india]


105."Triple Talaq: Law panel studies practices of Muslim nations", The Times of India, 24 January 2017 [http://timesofindia.indiatimes.com/india/triple-talaq-law-panel-studies-practices-of-muslim-nations/articleshow/56745076.cms]

106. "Triple talaq undesirable, worst form of dissolution of marriage among Muslims: Supreme Court". Retrieved 2017-05-13. [http://indiatoday.intoday.in/story/triple-talaq-uniform-civil-code-muslims-supreme-court-salman-khurshid-js-khehar/1/952078.html]

107."Allahabad High Court calls triple talaq unconstitutional, says no personal law board is above Constitution". India Today. Retrieved 2017-04-21. [http://indiatoday.intoday.in/story/triple-talaq-muslims-personal-law-constitution-allahabad-high-court/1/829752.html]  

108."Cleric: Triple talaq is a mockery of Islam". The Times of India. 10 May 2017. Retrieved 2017-06-0 [http://timesofindia.indiatimes.com/india/cleric-triple-talaq-is-a-mockery-of-islam/articleshow/58602245.cms]

109. "Supreme Court suspends 'triple talaq' divorce law". www.aljazeera.com. Al-Jazeera. Retrieved 2 December 2017.

110. Rashid, Omar. "'Triple talaq' a cruel and most demeaning form of divorce practised by Muslim community: HC". The Hindu. Retrieved 2017-04-21. [http://www.thehindu.com/news/national/Triple-talaq-a-cruel-and-most-demeaning-form-of-divorce-practised-by-Muslim-community-HC/article16776863.ece1]

111.  "Triple Talaq verdict: What exactly is instant divorce practice banned by court?". hindustantimes.com. Hindustan Times. 22 August 2017. Retrieved 2 December 2017. [http://www.hindustantimes.com/india-news/triple-talaq-verdict-what-exactly-is-instant-divorce-practice-banned-by-court/story-mhQ1SbxnCUUgySQq82sdbJ.html]

112."Muslim scholars support ban on triple talaq, polygamy". dna. 10 May 2017. Retrieved 2017-06-06.

113.  "All India Muslim Personal Law Board announces code of conduct for triple talaq". The New Indian Express. http://www.newindianexpress.com/nation/2017/apr/16/all-india-muslim-personal-law-board-announces-code-of-conduct-for-triple-talaq-1594233.html

114. Stacey, Kiran (22 August 2017). "India supreme court bans Islamic 'instant divorce'". Financial Times. [https://www.ft.com/content/615ca4d6-8701-11e7-bf50-e1c239b45787]

115. Supreme Court strikes down triple talaq, calls it unconstitutional.

[https://scroll.in/latest/848043/supreme-court-strikes-down-triple-talaq-calls-it-unconstitutional]

116. "5 Judges of 5 Faiths Give Verdict on Triple Talaq". [http://www.ndtv.com/india-news/5-supreme-court-judges-of-5-faiths-to-give-verdict-on-triple-talaq-1740329]

117. Supreme Court suspends 'triple talaq' divorce law

https://www.aljazeera.com/news/2017/08/india-supreme-court-suspends-muslim-divorce-law-170822052829982.html

118. The All India Muslim Personal Law Board Continues to Be Regressive https://thewire.in/religion/all-india-muslim-personal-law-board-regressive

119. Flavia Agnes, Politicizing Personal Laws: A Study of Colonial India; Women of India: Colonial and Post Colonial Periods, Vol-IX, Edited by Bharati Roy.

120. Triple talaq ‘wrong’, but valid: Muslim law Board https://indianexpress.com/article/india/triple-talaq-wrong-but-valid-muslim-law-board-aimplb-sharia-based-muslim-personal-law-4615742/

121. Better to divorce a woman than kill her: Muslim law board to SC https://www.hindustantimes.com/india-news/better-to-divorce-a-woman-than-kill-her-muslim-law-board-to-sc/story-4fphLN9YvgP9kMSbenISGN.html

122. 5 shocking reasons for which AIMPLB favours triple talaq: Finalcial Express FE Online| New Delhi | Updated: October 13, 2016 4:37:39 PM https://www.financialexpress.com/india-news/5-shocking-reasons-for-which-aimplb-favours-triple-talaq/416434/?gclid=CjwKCAjwtYXmBRAOEiwAYsyl3Os9C-yDimVvGR82T2eTycpM5FeQi2eYZQ05d_Ocwb3Hcb5F3ca NMxoCB3oQAvD_BwE

123. Controversial ‘Triple Talaq’ bill angers Muslims in India 79,000 Muslim Women Protest against Triple Talaq Bill in Malegaon [http://www.arabnews.com/node/1427301/world

https://timesofindia.indiatimes.com/city/mumbai/70000-muslim-women-protest-against-triple-talaq-bill-in-malegaon/articleshow/62950639.cms]

124.CNN, Manveena Suri. "Triple talaq: 1 million Indian Muslims sign petition against divorce practice". CNN. Retrieved 2017-05-22. [http://www.cnn.com/2017/03/17/asia/triple-talaq-petition-1-million/index.html]

125. Muslim Women Protest Against Triple Talaq Bill In Mumbai https://www.ndtv.com/india-news/muslim-women-protest-against-triple-talaq-bill-in-mumbais-azad-maidan-1831198

126.         "Muslims have lower divorce rate than other groups". The Times of India. Retrieved 2017-04-21. https://timesofindia.indiatimes.com/india/muslims-have-lower-divorce-rate-than-other-groups/articleshow/58100719.cms

127. PTI "Muslim community has a low rate of divorce". The Hindu. Retrieved 2017-04-21. [https://www.thehindu.com/news/national/muslim-community-has-a-low-rate-of-divorce/article17901208.ece]

128.         "Divorce rate among Muslims low compared to other communities". India Today. Retrieved 2017-04-21. http://indiatoday.intoday.in/story/divorce-rate-among-muslims-low-compared-to-other-communities/1/923989.html


https://www.hindustantimes.com/india-news/ahead-of-supreme-court-verdict-on-triple-talaq-here-s-a-primer-on-the-case/story-OJ6jjgGTRR988PfbNDpJ5I.html

130.            "Small step, no giant leap" [http://indianexpress.com/article/opinion/columns/supreme-court-verdict-on-triple-talaq-small-step-no-giant-leap-4808945/ 

131.           "Triple talaq verdict LIVE updates: Jaitley says SC judgment a great victory and welcome step". The Indian Express. [http://indianexpress.com/article/india/triple-talaq-verdict-judgment-live-updates-supreme-court-all-india-muslim-board-instant-divorce-centre-polygamy-4807803/]

132.           "Women can say triple talaq, Muslim law board tells Supreme Court". The Times of India. 17 May 2017. https://timesofindia.indiatimes.com/india/women-too-can-say-triple-talaq-muslim-law-board-tells-supreme-court/articleshow/58707428.cms

133.           বিয়ে বাঁচাতে অর্থের বিনিময়ে মৌলবিদের সঙ্গে রাত কাটাতে বাধ্য হন মুসলিম মহিলারা [https://www.sangbadpratidin.in/india/nikaha-halala-how-maulavis-take-money-for-one-night-stand-with-divorced-woman/#.W7MG4JOZMS6.facebook]

134.           HC dismisses plea challenging ordinance on Triple Talaq: PUNJAB NEWSLINE NETWORK [www.punjabnewsline.com/news/hc-dismisses-plea-challenging-ordinance-on-triple-talaq-5068]

135.           Triple Talaq To Be An Offence, President Clears Ordinance: 10 Fact https://www.dailypioneer.com/2018/state-editions/aimplb-flays-ordinance-on-triple-talaq.html

136.           Triple talaq ordinance entrenches women in marital patriarchy rather than freeing them; must be reconsidered.  https://www.firstpost.com/india/triple-talaq-ordinance-entrenches-women-in-marital-patriarchy-rather-than-liberating-them-must-be-reconsidered-5227701.html

137.           Congress to scrap law punishing Muslim men for 'triple talaq' if voted back to powerhttps://in.reuters.com/article/india-election-muslims/congress-to-scrap-law-punishing-muslim-men-for-triple-talaq-if-voted-back-to-power-idINKCN1PW1H7

138.           Uniform civil code - Wikipedia https://en.wikipedia.org/wiki/Uniform_civil_code

139.         "Are we really prepared for a Uniform Civil Code?" http://timesofindia.indiatimes.com/india/are-we-really-prepared-for-a-uniform-civil-code/articleshow/60471358.cms

140.         Anil Chandra Banerjee (1984). English Law in India. Abhinav Publications. p. 134. ISBN 978-81-7017-183-6.

141.         Shiv Sahai Singh (1 January 1993). Unification of Divorce Laws in India. Deep & Deep Publications. pp. 7, 287–288. ISBN 978-81-7100-592-5.

142.         Boyle, Kevin; Sheen, Juliet (2013-03-07). Freedom of Religion and Belief: A World Report. Routledge. pp. 191–192. ISBN 9781134722297.

143.         Chavan, Nandini; Kidwai, Qutub Jehan (2006). Personal Law Reforms and Gender Empowerment: A Debate on Uniform Civil Code. Hope India Publications. ISBN 978-81-7871-079-2. p. 66–67, 83–88, 90, 94–100, 480–491.

144.         Sarkar, Sumit; Sarkar, Tanika (2008). Women and Social Reform in Modern India: A Reader. Indiana University Press. ISBN 978-0-253-22049-3.p. 2–3, 93, 263.

145.         Samaddar, Ranabir (2005). The Politics of Autonomy: Indian Experiences. SAGE Publications. ISBN 978-0-7619-3453-0. p. 50–51, p. 56–59, p. 60–63.

146.         "Call to implement Goan model of civil code". New Indian Express. 15 May 2012. Retrieved 22 October 2013. http://newindianexpress.com/cities/chennai/article138136.ece

147.          (1983) Harvinder Kaur v. Harminder Singh, AIR 1984 Del 66 (Ref. Hindu Marriage Act 1955) [https://indiankanoon.org/doc/191703/]

148.         "Muslim intellectual proposes a revolutionary Uniform Civil Code". The Statesman. Retrieved 30 November 2016. http://www.thestatesman.com/india/muslim-intellectual-proposes-a-revolutionary-uniform-civil-code-1480508995.html

149.            Ahmad, Tufail. "My blueprint for the Uniform Civil Code". Retrieved 30 November 2016. http://www.dailyo.in/politics/uniform-civil-code-muslims-triple-talaq-indian-constitution-supreme-court/story/1/14293.html

150.         Uniform Civil Code: Whether a Directive to Promote Unity? Rhetoric... Rhetoric and Reality, Shahnaz N* Faculty of Law, [https://www.omicsonline.org/open-access/uniform-civil-code-whether-a-directive-to-promote-unity-rhetoric-and-reality-2169-0170-1000156.php?aid=60343]

151.         Granville Austin (2003)The Indian Constitution-Corner Stone of a Nation Published January 20th 2000 by Oxford University Press, USA. (ISBN13: 9780195649598)

152.         Jain MP (2014) Outlines of Indian Legal History.

153.         Anand, Utkarsh (13 October 2015), Uniform Civil Code: There’s total confusion, why can’t it be done, SC asks govt, New Delhi: The Indian Express. [https://indianexpress.com/article/india/india-news-india/uniform-civil-code-supreme-court-asks-govt-why-cant-it-be-done-tell-us-your-plan/]

154.         Sri Sapru TB and others, Constitutional Proposals of the Sapru Committee.  [http://biography.yourdictionary.com/sir-tej-bahadur-sapru]  

155.         Conststitutional Proposal of the Sapru Committee  [https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.276348]

156.         Meaning of Article 25 of the Indian Constitution http://www.elections.in/political-corner/article-25-of-the-indian-constitution/

157.         Constituent Assembly Debate 7: 540.

158.         Mohmmad Ahmad Khan v. Shah Bano Begum, AIR 1985 945.

159.         Mehmood T (2008) Law of India on Religion and Religious Affairs.

160.         Gandhi BM (2005), V.D. Kulshreshtha, Land Marks in India: Legal and Constitutional History. [http://www.infibeam.com/Books/info/b-m-gandhi/v-d-kulshreshtha-s-landmarks-indian-legal-constitutional/9788170121565.html]

161.         Section 21 & 38, Special Marriage Act, 1954 [https://indiankanoon.org/doc/44877/]

162.         Unnao rape case: Accused BJP MLA Kuldeep Sengar sent to 7-day CBI custody [https://timesofindia.indiatimes.com/india/unnao-rape-case-accused-bjp-mla-sent-to-7-day-cbi-custody/articleshow/63762986.cms]

163.         Unnao gangrape case: CM Yogi assures "Strict action would be taken" [http://wobko.net/2018/04/15/unnao-gangrape-case-cm-yogi-assures-strict-action-would-be.html]

164.         Unnao rape case: MLA's wife seeks narco test, CBI probe | India News [https://timesofindia.indiatimes.com/india/unnao-rape-case-mlas-wife-seeks-narco-test-cbi-probe/articleshow/63715904.cms]

165.         Kathua rape: Solid case built by Jammu police against accused offers hope that Justice will be served. [https://www.firstpost.com/india/kathua-rape-solid-case-built-by-jammu-police-against-accused-offers-hope-that-justice-will-be-served-4432353.html]

166.         Kathua rape and murder case: alleged conspirator's family wants CBI probe. http://www.thehindu.com/news/national/other-states/kathua-rape-and-murder-case-alleged-conspirators-family-wants-cbi-probe/article23548973.ece

167.         On Kathua Rape Case And Unnao Rape Case, Protests Called Across. https://www.ndtv.com/india-news/on-kathua-rape-case-unnao-case-protests-called-across-india-today-live-updates-1837827

168.         Surat: 11-year-old girl's body found with 86 injuries, rape suspected. http://indianexpress.com/article/india/11-year-old-girls-mutilated-body-with-86-injuries-found-in-surat-rape-suspected-5137578/

169.         Illegal Migrants (Determination by Tribunal) Act, 1983 - Wikipedia https://en.wikipedia.org/.../Illegal_Migrants_(Determination_by_Tribunal)_Act,_1983

170.         তপোধীর ভট্টাচার্য, “কিছু জরুরি তথ্যের পেক্ষিতে আসামে বেপরোয়া বাঙালি বিতাড়ন”, দ্বিরালাপ, ২০১৮

171.         What is the Citizenship (Amendment) Bill, 2016? - The Hindu [http://www.thehindu.com/news/national/other-states/what-is-the-citizenship-amendment-bill-2016/article23999348.ece]

172.         Citizenship Bill: If it's about sheltering the persecuted, why not include Rohingas? [https://www.dailyo.in/voices/citizenship-amendment-bill-assam-meghalaya-strong-opposition-illegal-immigration-bangladeshi-infiltration-nrc/story/1/24453.html]

173.         ‘Foreigners are foreigners’: Brahmaputra Valley says no to granting Bangladeshi Hindus citizenship [https://scroll.in/article/878227/foreigners-are-foreigners-brahmaputra-valley-says-no-to-granting-bangladeshi-hindus-citizenship]

174.         citizenship amendment bill 2016 passed [https://www.google.co.in/search?rlz=1C1DFOC_enIN697IN697&q=citizenship+amendment+bill+2016+passed&sa=X&ved=0ahUKEwiDhrKUvvPbAhXRT30KHZYiCJEQ1QIIfSgB]

175.         EXPLAINER| Citizenship (Amendment) Bill’s key question: Why are some illegal immigrants more equal than others? By Gaurav Choudhury [https://www.moneycontrol.com/news/politics/explainer-citizenship-amendment-bills-key-question-why-are-some-illegal-immigrants-more-equal-than-others-3385711.html]

176.         Worried about BJP using NRC for communal Agenda in 2019 polls: Congress does a course of correction. https://scroll.in/article/889264/worried-about-bjp-using-nrc-for-its-communal-agenda-in-2019-polls-congress-does-a-course-correction

177. 19 minutes, 12 jets, a big target: This is what the IAF did in Pakistan while you were asleep 
//economictimes.indiatimes.com/articleshow/68164179.cms?utm_source=contentofinterest&utm_medium=text&utm_campaign=cppst

178. Surgical strikes politicised, overhyped: Congress thanks General Hooda for exposing Modi

https://www.indiatoday.in/india/story/surgical-strikes-ds-hooda-congress-modi-1405130-2018-12-08

আনন্দবাজার ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

179. Telegraph 2nd Feb, 2013

180.প্রতীচী শিক্ষা প্রতিবেদন

181. তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিলে সম্মতি রাষ্ট্রপতির, আইন কার্যকর By: Web Desk, ABP Ananda | Last Updated: 01 Aug 2019 07:05 PM [https://abpananda.abplive.in/india-news/president-ram-nath-kovind-gives-assent-to-triple-talaq-bill-604194]

182.    Triple talaq bill passed by Parliament: BJP calls it victory of gender justice, Congress says historic mistake

183. https://www.indiatoday.in/india/story/triple-talaq-bill-passed-by-parliament-bjp-calls-it-victory-of-gender-justice-congress-says-historic-mistake-1575395-2019-07-31

184. ‘Attack on Muslim identity’: Asaduddin Owaisi slams triple talaq Bill, says it will further marginalise women

185. Assaduddin Owaisi slams Triple Talaq Bill: says it will further merginalise women. [https://www.timesnownews.com/india/article/asaduddin-owaisi-slams-triple-talaq-bill-says-it-will-further-marginalise-women/461453]

186. Rajya Sabha passes Triple Talaq bill, awaits Presidential assent to become a law. ET Online and Agencies| Jul 30, 2019,
https://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/rajya-sabha-passes-triple-talaq-bill-awaits-presidential-assent-to-become-a-law/articleshow/70452678.cms

187. তিন তালাক দিলে তিন বছরের কারাদণ্ড, ভারতে আইন পাস [https://www.bbc.com/bengali/news-49174195]







Post a Comment

Previous Post Next Post