ছাব্বিশ এগারো: সন্ত্রাস বার্ষিকী


ছাব্বিশ এগারো: সন্ত্রাস বার্ষিকী
          
স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস, পরিবেশ দিবস, মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি ইত্যাদি সযত্ন লালিত বিষয়গুলির সবকটির বরাদ্দ বছরে মোটে এক দিন। অথচ সন্ত্রাস দিবস স্মরণ করতে গেলে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বিস্ফোরণ, বম্বে ট্রেন বিস্ফোরণ, অক্ষরধাম ধ্বংস, ১১/৯-এর ওয়ার্লড্‌ ট্রেড সেন্টার ধূলিস্ম্যাৎ, ২৬/১১র মুম্বাইয়ে লস্করে তৈবার হামলা  – অগুণতি। আর কাশ্মীর, মধ্য প্রাচ্য বা আফ্রিকার কিছু দেশের ঘটনা ধরলে তো তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই স্মরণীয়।
আক্রান্ত দেশ ও সমাজগুলো এই ক্ষতচিহ্নগুলো নিষ্ঠা সহকারে পালন করে। না করলে চলে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি অবহেলা ব্যক্ত হয়, আর করলে শুকিয়ে আসা ক্ষত রক্ত ও বারুদের গন্ধে আবার আবিল হয়ে ওঠে। অবশ্য গন্ধটা মিলোয় কখন? ফিকে হয়ে আসার আগেই তো আবার তাজা দুষণে চরাচর ভরে ওঠে, তাজা রক্তে ভূমি পিচ্ছিল হয়েই চলেআর সবচেয়ে যন্ত্রণার কথা উপমার খাতিরে বারবার ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’র কথা বললেও তা এই একুশ শতকেও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে; বরং সন্ত্রাস, বীভৎসতা ও কদর্যতার প্রকারভেদে ‘আধুনিক বর্বরতা’ মধ্যযুগকেও টেক্কা দেয়। ‘আগে হোত, এখন আর হয় না’ কথাটা আমরা কবে বলতে পারব জানি না; যেমন বলি এক সময় গ্লাডিয়েটর যুদ্ধ রোমের প্রসিদ্ধ বিনোদন ছিল, এখন আর নয়।
২০০৮ থেকে ২০১৫ সাত বছর কেটে গেছে, আমরা প্রতি বছর জন্মদিন পালনের মতো করে মৃত্যুদিন পালন করি অনেকটা একই কেতায় – মোমবাতি জ্বালিয়ে; ফারাক হ্যাপি বার্থডে গান গেয়ে কেক কাটার বদলে মৌন মিছিল। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে শুরু করে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত লাগাতার চার দিন ধরে গুলি বর্ষণ দ্বারা ১৬৪ জনকে হত্যা ও অন্তত ৩০৮ জনকে আহত করার মামলার রায় বেরোনোর পর পাকিস্তানী নাগরিক আজমল কাসভের ফাঁসি হয়েছিল ২১ নভেম্বর ২০১২-য়। বিধ্বংসী জেহাদের গৌরব অবশ্য কাসভের একার নয়, তার সহযোদ্ধা ছিল আরও নয়জনতবে তারা কাসভের মতো ভারত সরকারের আতিথেয়তায় চার বছর ধরে লালিত হয়ে, ভারতীয় অন্ন ধ্বংস করে, অনেক টালবাহানার পর ফাঁসির মঞ্চ শোভিত করার সুযোগ পায়নি
পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী লস্করে তৈবার ১০ জনের সুপ্রশিক্ষিত দল ভারতের উপকূল বাহিনীর প্রহরাকে চুক্কি দিয়ে মুম্বাইয়ে ঢুকে পড়ে টানা চার দিন ধরে মোট ১২ খানা সুসংবদ্ধ বন্দুক হানা চালায়। দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, ওবেরয় ট্রাইডেন্ট হোটেল, তাজমহল প্যালেস ও টাওয়ার, লিওপোল্ড ক্যাফে, কামা হাসপাতাল, ইহুদি কমিউনিটি সেন্টার নরিম্যান হাউস, মেট্রো সিনেমা, টাইমস্‌ অব ইন্ডিয়ার অফিসের পিছনর গলি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে গুলি বর্ষণ ছাড়াও মাজাগাঁও বন্দর এলাকায় একটা ট্যাক্সিতে বোমা বিস্ফোরণও ঘটানো হয়।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডস্‌ (এনএসজি)-র ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’ যখন শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত অঞ্চলগুলোকে জঙ্গিমুক্ত করল, ততক্ষণে সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি এনএসজি-র দুজন ও মুম্বাই পুলিসের ১৫ জন অত্যন্ত দক্ষ ও নিবেদিত অফিসার প্রায় বিনা সুরক্ষায় মারা গেছেন। এনএসজি কম্যান্ডো মেজর সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণন ও গজেন্দ্র সিং অপারেশন চলাকালে কিছুক্ষণ লড়ার পর বীরগতি পেলেও বাকিদের মৃত্যু হয়েছে নিছক বেঘোরে। অ্যাসিটেন্ট সাব ইন্সপেক্টর তুকারাম ওম্বলে অবশ্য মৃত্যুর আগে খালি হাতে এক জঙ্গিকে পাকড়াও করার আংশিক তৃপ্তি নিয়ে গেছেন। কিন্তু জয়েন্ট কমিশনার হেমম্ত কারকারে, অ্যাডিশনাল কমিশনার অশোক কামতে, এন কাউন্টার স্পেশালিস্ট বিজয় সালাসকার, সিনিয়ার ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক শিণ্ডে – এঁরা তো বলতে গেলে বিভাগীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন; কারণ তাঁদের কারও তথাকথিত বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আদৌ ঢিল-প্রুফও ছিল না, তো কেউ কেউ লড়াই করার সুযোগটুকুও পাননি। দুর্নীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছলে সুরক্ষাকর্মীর রক্ষাকবচে ভেজাল দেওয়া হয়, তার তল পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য কার্গিল যুদ্ধের সময় মৃত সৈনিকের কফিন নিয়ে যে মৃতজীবী ব্যবসার সাক্ষী আমাদের ইতিহাসকে থাকতে হয়েছে, তাতে শকুনও লজ্জা পাবে।
মাত্র ২৫,০০০ ডলারের বিনিময়ে অস্ত্র নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে নামা ছেলেগুলো তাদের নেতাদের প্রতিশ্রুতি মতো বেহেস্তে গেল। একমাত্র জীবিত ধরা পড়া আজমল কাসভ মোটামুটি ভারতের জাতীয় হিরোর মতো প্রচার পেল চার বছর ধরে। তার পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ও জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ প্রমাণ করাটা ছিল নেহাতই তদন্তের কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতাযদি তা প্রমাণ নাও হোত, তাহলেও একাধিক প্রাণের ঘাতক হিসাবে যে হাতেনাতে ধরা পড়েছে, তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে এত বিতর্ক বিশ্লেষণের কেন প্রয়োজন হবে সেটাই দুর্বোধ্য। আসলে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির পাশাপাশি আমাদের দেশের মানবাধিকার কর্মীদের রাজনৈতিক অভিমুখও অপরাধ ও সন্ত্রাসকে সমাজের আনাচে কানাচে জেঁকে বসতে সাহায্য করছে। তথাকথিত সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতিকরা যতটা রাজনীতি করে, মানবাধিকারবাদী প্রগতিশীলরা করে তার চেয়েও বেশি। কেন করে তা ভিন্ন অনুসন্ধান।
২০১১-র এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লস্কর সদস্য সাজিদ মীর, আবু কোয়াহফা, মজ়হর ইকবাল ওরফে মজোর ইকবাল সহ চারজন পাকিস্তানি যারা আক্রমণের পরিকল্পনা ও জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও তা পরিণতি পায়নিসবচেয়ে বড় কথা এই হানার প্রধান মস্তিষ্ক যে মহাপুরুষ সেই জ়াকিউর রহমান লাখ্‌ভি পাকিস্তানে মাত্র ২ লক্ষ টাকা বা ৩০০০ ডলারের নিশ্চয়তা বন্ডে জামিন পেয়ে গেল ২০১৫-র ৯ এপ্রিল। ২৬/১১ হত্যাকণ্ডের অন্যতম হোতা জামাত-উদ-দাওয়ার হাফিজ় সইদ রয়েছে বহাল তবিয়তে। আর এক রাঘব বোয়াল জ়াবিউদ্দিন আনসারি ওরফে আবু হামজ়া দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হানা, আহমেদাবাদ ট্রেন বিস্ফোরণ ইত্যাদি ঘটনারও প্রধান অভিযুক্ত তাকে তিন বছর ধরে খুঁজে ২০১২-র ২৫ জুন দিল্লি পুলিস গ্রেপ্তার করল ঠিকই, কিন্তু আমাদের বিচার ব্যবস্থার সাহস হল না তাকে কঠোরতম সাজা দেওয়ার। ভারতে প্রথম পঞ্চাশজন ‘পাকিস্তানি আশ্রয়প্রাপ্ত মোস্ট ওয়ান্টেড’-এর তালিকায় থাকা লস্করে তৈবার কট্টরপন্থী উগ্রবাদী এই আনসারি যে ঐ দশজনের হিন্দী শিক্ষকের কাজ করেছে ভারতে নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে, তার কোনও খবরই ছিল নাএর পর ভারতের জাতীয় সুরক্ষাকর্মী, রাজ্য পুলিস, সীমা সুরক্ষা বাহিনী, এমনকি স্বয়ং সেনা বাহিনী – কার মনোবল অটুট থাকে? তাই সরষের মধ্যে ভূতের আস্তানা। একদিকে মহারাষ্ট্র সরকার উপকূল প্রহরার জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে ৩৬টি স্পীড বোট, একাধিক হেলিকপ্টার, পুলিস ফোর্সে আধুনিক অস্ত্র, সন্ত্রাস দমন শাখা ‘ফোর্স ওয়ান’ ইত্যাদির দাবি ও আংশিক আয়োজন করে পশ্চিম উপকূলের সীমিত এলাকায় বাঁধ দিচ্ছে; আর অন্যদিকে উত্তর-পশ্চিমের কাশ্মীর ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্ব ও উত্তরপূর্বের স্থল ও উপকূলবর্তী সীমান্তে সুরক্ষাকর্মীরা বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিশ্বস্ত প্রবেশদ্বার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমেরিকার ফেডারেল কোর্ট কিন্তু মুম্বই হানার সূত্র ধরে ডেভিড হেডলিকে ভারতে হত্যার ষড়যন্ত্র, ছয়জন মার্কিন নাগরিককে হত্যায় সাহায্যসহ বারো দফা অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৩-র ২৩ জানুয়ারি সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের কারাবাসে দণ্ডিত করেছে। সারা বিশ্বে সন্ত্রাস রোপন, সেচন, লালন, পালনের সাথে সাথে এই একটি দেশ সন্ত্রাস দমনেও ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ তৎপরতাই হেডলির বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের মামলা একটিও না থাকলেও দীর্ঘ কারাবাসের শাস্তি দিতে একটুও দ্বিধা করে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেললেও হাতে ছ্যাঁকা খায় না  বিশেষতাই ৬ আগস্ট ১৯৪৫ জাপানের হিরোশিমা শহরে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও বিধ্বংসী সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটানোর কোনও মূল্য দিতে হয়নি তাকেতাই সন্ত্রাস দমন ও শান্তি রক্ষার নাম করে পরপর হামলা হয়ে যায় চেচনিয়া, প্যালেস্টাইন কিংবা ইরাকের উপসাগরে। তাই মার্কিনি ২৬-১১-র টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বদলা নিতেও দেরি হয় না। কিন্তু আর ভারতের নরম মাটিতে আঁচড়ের পর আঁচড় কাটাই যায়। তাহলে কি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আক্রোশ মেটানোর পক্ষে একখানা ২৬/১১ যথেষ্ট হবে না, এই সতর্কতা মাথায় রাখা ছাড়া আমাদের বাঁচার জন্য সত্যিই কিছু করণীয় নেই?

[১৩.১১.১৫]
সান্ধ্য আজকাল: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ 


Post a Comment

Previous Post Next Post