অনুগুচ্ছ: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
বিবর্তন
মুখটা
চেনা চেনা ঠেকল। দেখতেও টিপিক্যাল ভিখারির মতো নয়। ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে সস্তা
মোটা ফ্রেমের চশমা। হাত,পা সবই ঠিক আছে। না থাকার মধ্যে কেবল বয়স। গানও শোনাচ্ছে
না। ভিক্ষা পাওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা নেই। তবু কী ভেবে অনীশ একটা টাকা দিল। বুক
পকেটের পেনে হাত পড়তে খেয়াল হল, ঠিক, লোকটাকে বছরখানেক আগে সোদপুর স্টেশনেই পেন
বিক্রি করতে দেখেছে। তখনও চটপটে ছিল না। মন্থর পায়ে শুধু প্ল্যাটফর্মেই ঘুরত। কোনও
ট্রেনে চড়ত না।
ধাক্কা খেয়ে ট্রেন থেকে নামতে না
নামতেই জনস্রোতের মধ্যে আবার ধাক্কা। মরণ! চোখের মাথা খেয়েছে নাকি? ও মা! তাই তো!
মোটা কাচের চশমা। ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গীতে হাত পাতা। নোংরা, এঃ! মেজাজ খিঁচিয়ে গেল
প্রভার। কিন্তু মুখটা চেনা লাগে কেন? প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে লিফলেট বিলি করছিল একটি
ছেলে। চট্
করে মনে পড়ে গেল এই লোকটাও এক সময় লিফলেট বিলি করে নিজের অনটনের গল্প শুনিয়ে, থুড়ি
পড়িয়ে সাহায্য চাইত। খুব সম্ভব শিক্ষিত, পড়াত-তড়াত। যদিও মনে নেই কী লেখা থাকত
কাগজে। প্রভা নিত্যযাত্রী নয়। সোদপুর স্টেশন দিয়ে মাঝে কয়েক বছর যাতায়াত ছিল তার।
তখনই দেখত লোকটাকে। ও, তাহলে দুঃখের কাহিনী ছাপানোর বদলে সরাসরি ভিক্ষা ধরেছে।
ভীড়ের তাড়নায় এগোতে গিয়ে এক বৃদ্ধ
ভিখারিকে ধাক্কাই মেরে ফেলল অনিরুদ্ধ। এই অফিস টাইমে কেন যে এরা আসে? কারও ফুরসত
আছে এসময় ভিক্ষা-টক্ষা দেওয়ার? যাঃ! ট্রেনটা ফসকাল। রোজ যাওয়া আসার অভ্যাস না
থাকলে যা হয়। পেছন ফিরেই ফের বৃদ্ধের মুখোমুখি। মুখটা বড্ড চেনা। কোথায় কোথায়? ও
হ্যাঁ, এই সোদপুর স্টেশনেই হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকত। কীসব পেনশন-টেনশন না
পাওয়ার গল্প। তখন পোষাক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। তখন, তা বছর আট-দশ হবে মানে অষ্টআশি
নব্বই নাগাদ, প্রতিকার চাইত, ভিক্ষা নয়।
দূর থেকে ভিখারিটাকে খানিক্ষণ নিরীক্ষণ
করে চমকে উঠে এগিয়ে এল সত্যেন। “অনিন্দ্য
স্যার না ?”
[২৬৪ শব্দ]
পাগলি
চটালেই গালাগালির
বন্যা, কাপড় তুলে লাথি দেখানো। বিনা পয়সার বিনোদন। ভদ্রলোকে বলে “মুখ ভেঙে দিতে হয়,
ছিছি”।
মায়ের নাগোর নাকি ছোট্ট রেশমিকে স্কুলে নিয়ে
যাওয়ার পথে রক্তাত্ত বেহুঁশ করে দিত প্রায়ই। মা টের পেয়ে মাথা কুটে বলেছিল,
রাষ্ট্র করবে, আস্তিনের কালসাপ তাড়িয়ে মেয়েকে ডাক্তার দেখাবে, নয়তো গলায় দড়ি দেবে।
নাগোর প্রেমিকার শেষ ইচ্ছাপূরণে গলায় দড়ি পরিয়ে পায়ের তলা থেকে টুল সরিয়ে সাহায্যই
করেছিল। তারপর কন্যা তথা শিকারকে ফেলে কেবল টাকা গয়না হাতিয়ে বাপ উধাও হয়ে যায়।
সেই থেকে “রেশমি লে-লে-লে”, এইটুকুতেই ফ্রক তুলে
নারী-পুরুষের সোহাগ-সংঘাতের শব্দভাণ্ডার উজাড় করে শোনাত।
ট্রেনের ঝম্ঝম্, মাতালের তর্জন,
কুকুর-বিড়ালের কাঁইকাঁইএর আবহে পাগলির কাতরানি শুনতে অভ্যস্থ আশপাশের জনতা। আজকাল
আবার যেখানে সেখানে বমি হয়ে যাচ্ছে। যেসব দোকান ছেঁড়া পাতায় খেতে দিত তারা হুড়ো
দিচ্ছে। তবু এঁটোকুড়ুনির প্যাঁকাটি শরীরেরও মধ্যদেশ স্ফীত হচ্ছে ক্রমশ। অনেকে
মিটিমিটি হাসে। ভদ্রলোকে বলে, “এমন বেলেল্লেপনা চলবে না। ভাগ্ হিঁয়াসে”। মহিলা সমিতি
বলে, “কোন পাষণ্ডের কাজ?” রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালারা
চোখ মটকে হাসে, একজন নাকি?
টিকা, ওষুধ, টোট্কা নয়। দাইও নেই। রাতে
খেপির আর্তচিৎকার শোনা গেল। সে তো প্রায় রাতেই শোনা যায়। ভোরের ট্রেনের যাত্রীরা
দেখল স্টেশনের চাতালে রক্তাত্ত মৃতদেহের পায়ের কাছে রক্ত-শ্যাওলা মাখা সদ্যজাত
খাবি খেতে খেতে স্থির হয়ে গেল। নাড়ি কাটা হয়নি তখনও। মৃতার ন্যাতানো বুকের দুধের
ফোঁটায় ধূলো ভিজে গেছে।
ভালো। মরা দেখলে যাত্রা শুভ হয়।
[২০৪শব্দ]
অভিনয়
- জাতীয় পুরস্কার
পেয়ে কেমন লাগছে?
- পুরস্কার মানেই
স্বীকৃতি। একজন শিল্পীর কাছে পুরস্কার সব সময় আনন্দের, তা সে যে পুরস্কারই হোক।
- এত বছর ধরে খল
চরিত্রে অভিনয় করে গেলেন। একঘেয়ে লাগেনি?
- এই নেগেটিভ
ক্যারেকটারের হাত ধরেই কিন্তু অ্যাওয়ার্ড এসেছে অনেক, এমনকি এই রাষ্ট্রপতি
পুরস্কারও।
- কখনও মনে হয়নি
একটা পজিটিভ ক্যারেকটার বা ভালো মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করি?
- সে তো সব সময়
করতে হচ্ছে। [৬৭শব্দ]
দুঃসাহসিক
অনেকে ফোনেই নানা রকম বিদঘুটে প্রস্তাব রাখে – বোল্ড দৃশ্য,
বোল্ড পোষাক এবং প্রযোজক ও পরিচালকের সঙ্গে বোল্ড সম্পর্ক। কত রকম টোপ। আনকরা
নতুন মুখকেও লাখ লাখ টাকা দেওয়া হবে যদি সংস্কার ত্যাগ করে তারা দুঃসাহসী হয়। কেউ
বা রাত পোষাক দিয়ে কথা শুরু করে ক্রমশ ডিজাইনার অন্তর্বাস, অর্ধনগ্নতা ও শেষে
প্রায় পুরোপুরি উন্মোচনের দাবি জানায়। অডিশন ফি ও ওয়ার্কশপের নামে টাকা ঢালতে না
চাইলে সাহসী হতেই হবে। এই বিজ্ঞাপণটা দেখে নিজের ছবি ইমেইলে পাঠিয়ে অনেকেই অডিশনের
ডাক পেয়েছে সাহসিকতার সীমা কদ্দুর সে প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়েই।
অডিশনের বদলে সাক্ষাৎকার নেওয়া হল। এখানেও
দুঃসাহসিকতার জয়। অভিনেত্রী ও মডেল হিসাবে মরিয়া কিছু তরুণী জানে তাদের প্রতিভা ও
সৌন্দর্যের কদর পেতে হলে বোল্ডনেস দেখাতেই হবে। চেহারায় তেমন চেকনাই নেই, তেমন
কয়েকজন সাহস দেখাতে রাজি হলেও পরে যোগাযোগ করা হবে শুনে হতাশ মুখে ফিরছে। তাদের
জন্য হয়তো আরও রগরগে প্রস্তাব আসবে।
পরীক্ষায় ডাঁহা ফেল প্রার্থীর সংখ্যাও কম নয়।
তাদের মধ্যে এক কুর্তি সালোয়ার পরা সুন্দরী গজ্গজ্ করছে, “আগে-ভাগে ফোনেই
বলে দিতে পারত কী দরকার। এখানে ধকল খরচ করে এসে যদি এইসব উল্টোপাল্টা কথা শুনতে
হয়। যাদের উদাহরণ দিচ্ছে তারা আগে অভিনেত্রী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘দাম’ করে দুঃসাহসী
হয়নি। রাজি নই জেনেও কেবল ইনসিস্ট করে যাচ্ছিল!”
হঠাৎ শোরগোল শোনা গেল; পাশের ফ্ল্যাটের চার
তলায় আগুন। একটা কোচিং সেন্টারে কতগুলো বাচ্চা আটকে পড়েছে। শিক্ষিকারা জানলা দিয়ে
মখ বাড়িয়ে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে। সিঁড়ির পথ বেকার, কারণ আগুটা দরজার কাছেই
মেইন সুইচে লেগেছে। কুর্তি-সালোয়ার খানিকক্ষণ ওপরের দিকে তাকিয়ে নিজের ওড়নাটা ফেলে
জলের পাইপ বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। মাঝে মাঝে জানলার ছারজা আর ব্যালকনির গ্রিল ধরে
বিপজ্জনক ভাবে পৌঁছে গেল ধুঁয়ো বেরোনো জানলায়। চীৎকার করে সাহায্য চাইল। কয়েজন
যুবক কোথা থেকে মই যোগাড় করে আনল। অডিশনে বাতিল মেয়েটি জানলা দিয়ে একের পর এক
শিশুদের বার করে মইবাহীদের হাতে দিতে লাগল। বাকি বাতিলদের কেউ কেউ তাদের ধরে নিল।
দিদিমণিরাও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলেন যদিও তাঁরা তাপে ঝলসে আর ধোঁয়ায় গুরুতর
অসুস্থ। পাড়ার ছেলেরা ও বাতিল মেয়েগুলির দল হাসপাতালে নিয়ে চলল কুচোকাচা ও
দিদিমণিদের। টঙে চড়ে বসা মেয়েটাও ধুঁয়োর জ্বালায় চোখ নাক মুছতে মুছতে কোনওক্রমে
নেমে বলল, “ভাগ্যিস সিন্থেটিক শাড়িটার বদলে সূতীর সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছি।”
পাশের ফ্ল্যাটে তখনও সাহসিকতার পরীক্ষা দেওয়া
নেওয়া চলেছে।
রং নাম্বার
-
কী রে! তখন থেকে ছট্ফট্ করছিস। নার্সিংহোম যাবি না? ছেলে হয়েছে, কী সুন্দর
সুস্থ স্বাভাবিক ফুটফুটে। দেখতে যাবি না?
-
না। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকে এখন কেবিন ভর্তি।
-
কেন তাতে কী? নাতি হয়েছে বৌদির বাপ-মা দেখতে আসবে না? শ্বশুরে অ্যালার্জি না
শালায়?
- না, ঠিক তা নয়।
-
তবে?
-
হাসপাতাল থেকে মেসেজ করেছিল, ‘কনগ্র্যাটস্! আপনি বাবা হয়েছেন’। আমি সেই মেসেজ
শ্বশুরকে ফরোয়ার্ড করে ফেলেছি।
[৬৫ শব্দ]
পরিসর
হৈচৈটা রেস্তোঁরার ভেতর
থেকেই শোনা যাচ্ছিল। কাছাকাছি কোনও উচ্ছকিত পুরুষ কণ্ঠ। সাথে একটা অস্ফুট গোঙানির
আওয়াজ।
_ ওফ্ ! একটু কি শান্তি নেই কোথাও? চল্ তো দেখে আসি কোন
মাস্তান পয়দা হল।
_ ধুর! ঝামেলায় জড়াস না। নিজেদের মধ্যে গণ্ডোগোল। তুই গিয়ে
কী করবি?
_ কী করব মানে? থামাব। সেদিন একটা ছেলেকে চোর সন্দেহ করে
পাবলিক এমন প্যাঁদাল যে হাসপাতাল পর্যন্ত জ্যান্ত নিয়ে যাওয়া গেল না। চোরও যদি হয়,
পুলিসে হ্যান্ডোভার কর। তা নয় নিজেরাই হাতের সুখ করবে। আর শালা, পুলিসও আসে সং-এর
মতো সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর।
_ কী আর করবি? যদি মব হয়, তুই একা আটকাতে পারবি?
_ পরিস্থিতি বুঝে পুলিসকে মিডিয়াকে তো খবর দিতে পারি। আর মব
কোথায় এখানে? একজনের গলাই তো পাচ্ছি। আর একজন কেউ মার খেয়ে কাতরাচ্ছে। ‘বাঁচাও’ বলার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই। শুধু গোঙাচ্ছে।
গ্রাম-গঞ্জ থেকে বাচ্চা চাকর বাকর নিয়ে এসে অনেক জানোয়ার এইভাবে অত্যাচার করে। কেউ
বাধা না দিলে –
?
_ ফালতু ঝামেলায় কেন জড়াবি খামোকা নাক গলাতে গিয়ে?
_ সেদিন আমাদের
পাশের বাড়ির দুই ভায়ের মধ্যে লেগেছিল। যদি আটকানো না হত, তাহলে একজনের হাতে আর
একজন ডেফিনিটলি খুন হয়ে যেত। কখনও কখনও নাক গলাতে হয় বৈকি।
_ আমরা তো ভেতরে আছি। বাইরে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছে
নিশ্চই। তারা যখন কিছু বলছে না, কারণ কিছু একটা আছে নিশ্চই।
_ কারণটা সঙ্গত না অসঙ্গত দেখব না? সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছে
বলে একজনও এগিয়ে যাবে না। একটা মানুষ মরতে বসেছে! কারণ যাই থাক, তার জন্য পুলিস
আছে, আদালত আছে; তুই আমি শাস্তি দেবার কে? আমি দেখি, তুই থাক বসে।
_ ঐ যে বললি সং-এর মতো; সেরকম আছে। তাই তো ভালো মানুষও
মরিয়া হয়ে অনেক সময় অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। ঐ তো। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস কর না, কী হয়েছে।
_ আচ্ছা ভাই, বাইরে কীসের গণ্ডগোল?
_ গণ্ডগোল তেমন কিছু নয় স্যার। পেছনের পাড়াতে রোজই হয়
প্রায়। হারাণ রিক্শাওয়ালা আবার বৌকে ক্যালাচ্ছে। বৌটাও ঠ্যাঁটা আছে। স্বামী ঘরে
ফেরার আগে কাজকাম সেরে ফিটফাট হয়ে থাকলেই পারে। তা নয়, পাশের বাড়ির বৌটার সাথে
আড্ডা দেবে। খেটেখুটে বাড়ি ফিরে - ভালো লাগে?
_ ও স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার? আমি ভাবলাম কী না কী? তা ভাই
অর্ডার তো অনেকক্ষণ দিয়েছি। কত দেরি? বিয়ার চিল্ড হয় যেন।
সৎপাত্র
এই নিয়ে পাঁচ বার গর্ভ চাঁছা হল। অপয়া বৌটা
শুধু মেয়ে পেটে ধরছে। চোরা আল্ট্রা সোনোগ্রাফ্রি করে ধরা পড়ে যাচ্ছে অপরাধ। এত
মারধোর, তাবিজ-কবোচ, গুণ-তুক, শেকড়-বাকড় থেকে অখাদ্য কুখাদ্য গেলানো – সব বৃথা যাচ্ছে।
পরের বার আর রেয়াত নয়।
যাক, বৌটা স্বামীর মর্দানির মান রেখে ষষ্ঠ
বার ছেলেই পয়দা করল। তবে শিশুকে দুধ না খাইয়েই চলে গেল। হাসপাতাল থেকে সোজা
শ্মশান।
সদ্যজাত পুত্র-সন্তানের গর্বিত পিতা কাগজে বিজ্ঞাপণ দিলেন, ‘ব্ল্যাংক চেক সহ
অভিজ্ঞ দাবিহীন বিপত্নিক পাত্রের জন্য উপাযুক্ত পাত্রী চাই। বাবার এক মাত্র সন্তান
অগ্রগণ্য।
হাত
ইচ্ছা করে ঠেকাচ্ছে,
না বাসের ঝাঁকুনিতে লেগে যাচ্ছে? প্রত্যক্ষ
প্রমাণ ছাড়া “একটু
সরে দাঁড়ান”
বা “ঘুরে
দাঁড়ান প্লীজ”
ছাড়া কিছু বলার থাকে না। কিন্তু হাতের আঙুলগুলো যখন পাঁজর বেয়ে তল্লাসি চালায়, তখন
আর সন্দেহ থাকে না। কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে পেছন থেকে আসা হাতখানা যথাসাধ্য আটকে,ভারি
ব্যাগ ঢালের মতো বুকে চেপে, আর নীচে লাগা ঘিনঘিনে স্পর্শটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে বেঁকেচুরে
দাঁড়িয়ে দেড় ঘন্টা কাটাতে হল। বাসে সাধারণত জায়গা পাওয়া যায় বসার। আজ এত ভিড়!
শাড়ি, ব্যাগ আর রাগ-বিরক্তি সামলে বাস থেকে নেমে ফোন করতে গিয়ে ব্যাগ আঁতিপাঁতি
খুঁজেও মোবাইলটা পেল না। কার হাত সাফাই? ঐ জানোয়ারটার, না দরজার কাছে অকারণ জটলা পাকানো
ছোকরাদের কারো?
প্রতিবাদ
প্রতিকারহীন লাঞ্ছনা আর লোকসানের রেশে মনটা খিটকেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল
দারুণ মেজাজে।
পিঠে হঠাৎ
বেমক্কা চাপড়! ব্রজেশ। হাত তো নয়, থাবা। “এইযে মাদাম কুরি, কাল ডিএম চিলেট কম্পাউন্ডের নোট দিয়েছে শুনলাম। তোর খাতাখানা
দে, ইনঅরগ্যানিক ক্লাসের আগে পেয়ে যাবি”। হাত থেকে খাতাটা প্রায় ছিনিয়েই নিল ব্রজেশ। সবুজকলির মোবাইল চুরি গেছে শুনে
গা জ্বালানো হাসি,“
কিপটে লোকেদের চুরি যাওয়া শুভ, নতুন হয়। থানায় একটা ডায়রি কর, ডুপ্লিকেট সিম পেয়ে
যাবি”।
ক্যান্টিনে
বসে খাবার বরাত দেওয়ার পর সুখবরটা দিয়ে ফেলল।“এবছর আইআইটি-টা হয়ে গেল”।
“আরিব্বাস! র্যাঙ্ক কত?” প্রযুক্তির প্রশ্ন।
“ চারশো ছয়”।
“তার মানে কানপুর?” সদ্য টয়লেট থেকে ফেরা সপ্তর্ষি বলল।
“জানি না। আমি খড়গপুরেই ভর্তি হব।
বাড়ি যাওয়া আসা করা যাবে”।
“কনগ্র্যাট্স্”।সবুজকলির হাত ধরে ঝাঁকাল
সপ্তর্ষি।
ইস্! ছোট বাইরে
থেকে ফিরে হাত ধোয়নি। হাত ভেজাও ছিল না, রুমালে মুছতেও দেখা যায়নি। সেই হাতে ওর
ডান হাতটাই ধরল! হাত ধুয়েই বসেছে সবুজকলি। আবার ওঠে কী বলে? খাবারও চলে এসেছে।
ওদিকে বেসিনে ভিড়। কিন্তু-কিন্তু করে দুআঙুলে একটা পকোড়া তুলতেই হল বন্ধুদের
তাড়ায়।
“মাইরি ভালো খবরটা এতক্ষণ চেপে শুধু
মোবাইল নিয়ে নাকে কাঁদছিলি। যার যা ইচ্ছা অর্ডার কর।আজ কলি ট্রিট দিচ্ছে”। ঘোষণা করে দিল সপ্তর্ষি।
কী বলবে? খাবার টেবিলেই
তো সুখবরটা ফাঁস করে ফেলেছে। বিঘ্নি করে খেয়ে আটজনের বিল মেটালো সে। বাসের বিশ্রী
অভিজ্ঞতাটা কিছুক্ষণ ভুলে ছিল। আবার তোলপাড় হচ্ছে। অদ্রিজও এল না। কাল কলির হাত দুহাতে
চেপে ধরেছিল কয়েক মুহূর্ত। তার জন্যই শাড়ি। শাড়ির কারণেই ভিড় ট্রেনের ঝুঁকি না
নিয়ে বাসে চেপে কলেজ আসা।ধুর্! ট্রেনেই ফিরবে। আগরপাড়া নামার সময় বেকায়দায় না পড়তে
হয়।
শিয়ালদা।
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখে পাঁচ নম্বরে গেদে। ছুট,ছুট। ঐ তো মহিলা কামরা। যাঃ!
ট্রেনটা ছেড়ে দিল? চলন্ত ট্রেনের শেষ বগিতে উঠতে গিয়ে ভারি ব্যাগ নিয়ে টাল খেয়ে
গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরিচিত পুরুষের হাত সবুজকলির পিঠে হাত রেখে ঠেলে দিল ভেতরে;
আর একটা পুরুষালি হাত তার বাঁহাতের কব্জি ধরে টেনে ঢুকিয়ে নিল নিরাপদ স্থানে।
ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যেতে যেতে কলি বলল,“থ্যাঙ্ক ইউ”।
সাময়িক
এখন আর ব্যথা নেই। শুধু মনে আছে আঘাতটা জোরেই লেগেছিল। আর
কান্না পায় না। শুধু মনে পড়ে বড্ড কষ্ট হয়েছিল। এখন আর আফশোসও হয় না। শুধু মনে হয়
মস্ত ভুল হয়েছিল।
কথাগুলো শুনে তো
ও অট্টহাস্য করে উঠেছিল। সত্যিই তো! বিয়ের মতো খেলো কথা পাড়া কি উচিৎ হয়েছিল? না
হয় গত রাতে দেহের প্রতিটা রোমকূপ চিনত। তাই বলে মুখটাও সকালে মনে রাখতে হবে?
বাঁকা পথ
- হেডিংটাকে আন্ডারলাইন কর। ও কী! ওটা কীরকম লাইন হল? আমি
সরলরেখা টানতে বলেছি।
- মা, খালি হাতে কি সরলরেখা টানা যায়?
- তাহলে স্কেল নিয়ে আয়। অমন আঁকাবাঁকা রেখা আঁকলি কেন?
- বক্ররেখা আঁকাই তো সোজা মা।
তাই তো। সোজা নয়, বাঁকা পথে চলাটাই সোজা। মায়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলা স্বগতোক্তি।
রান্নাঘরটাই
ছিল সান্ধ্য এবং রাতের আড্ডার আসর। চার বেলার আহার বিলাসিতা। সকালে ফ্যানাভাত
পোড়ানো শুকনো লঙ্কা দিয়ে দিয়ে পেটে ঠুসে শ্যামা যেত স্কুলে, বাবা চা-বাগানে কুলির
কাজে, ছোড়দি কামিন খাটতে। মা কখন খেত সে প্রশ্ন শ্যামাদের মনে কোনও দিন উদয় হয়নি।
শুধু রাতে মাকে আবার উনুনের ধারে পেলেই হল।
ছেলের বাড়ির বড় খাঁই। সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়ার পর বড়দিদি কার
সাথে যেন ভেগেছে। তাতে পরিবারের মাথায় কলঙ্কের বোঝা যা চেপেছে, ভার লাঘব হয়েছে তার
ঢের বেশি। ছোড়দির জন্য কথাবার্তা চলছে। বিয়ের খরচ যোগাতে নিজেই সর্দারের অধীনে কাজ
নিয়েছে। বাপ অনেক দিনের কুলি; তাই মেয়ের কুলিদের হাতে বেইজ্জত হওয়ার ভয় কম। তবে
ম্যানেজার বা সর্দারের হাত থেকে বাঁচতে সর্দারের মাতাল ভাইটার সঙ্গে বিয়ে দিতে
হবে। কী সব আজে বাজে অসুখও আছে তার। সব জেনেই স্বল্প পণে দিদি পার হল।
তিন-চার দিন লোক সমাগম, হৈ-হৈ-এর পর রাতে চিরাচরিত উনুনের
ধারে গোল হয়ে খেতে বসে বড্ড ফাঁকা লাগল। মা বেলত আর ছোড়দি সেঁকে সেঁকে বাপ ভাইয়ের
পাতে রুটি দিত যে। সে রাতেই মার বমি শুরু হল। সঙ্গে পেটে ব্যথা। জলও পেটে থাকে না।
বিয়ে বাড়ির অতি-ভোজনে বোধহয়। পেট বিশ্রাম পেলে সামলে উঠবে।
কিন্তু পরের দিন এমন বাড়াবাড়ি যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে
হল। ডাক্তার মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বলল, অ্যাকিউট গ্যাসট্রাইটিস। পেটে আলসারও হয়ে
থাকতে পারে। ফটো আর আলট্রা কী যেন করতে হবে। অনেক খরচ। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকে
অ্যাসিডে পেটে ঘা হয়ে গেছে। ইনজেকশন দিল, বকল। চার-পাঁচ ঘণ্টা অন্তর ওআরএস আর
সহজপাচ্য কিছু না কিছু পেটে দেওয়ার নির্দেশ দিল ডাক্তার।
স্কুল কামাই দিয়ে শ্যামা মাকে নুন চিনির জল গেলাবার জন্য
ঘরে রইল। আসলে পাশের বাড়ির কাকি মায়ের জন্য কম তেল মশলা দিয়ে সব্জির ঝোল করে
পাঠালে তা ভারি লোভনীয় মনে হোত। ওর মুখ দেখে মা নিজে খেতে খেতে বলত, খাবি? না করতে
পারত না শ্যামা।
মাকে রাখা গেল না। শ্যামা মায়ের পাত থেকে খেয়ে না নিলে কি
মা বাঁচত?
বাড়িটা যে ওদের নয় তা বকেয়া ভাড়ার চাপে বাসা বদলাতে গিয়ে
জানল শ্যামা। বাড়ি ছাড়ার আগে রান্নাঘরে গিয়ে ঠান্ডা উনুনটা দেখে এল। মা যেন ঐ উনুন
আগলে এখনও বসে। মা গো, উনোনটা রইল। এবার দুটো ফুটিয়ে নিজে মুখে দিও। আমি আর কোনও
দিন তোমার ভাগটা খেয়ে নেব না।
স্মৃতি
গতকাল ও আমাকে কাঁদিয়েছিল আমার বাধা ও প্রতিরোধ অগ্রাহ্য
করে। ক্ষমা চাওয়া তো ধাতে নেই। যাবার আগে ‘স্যরি’ও বলেনি।
বলেছিল, ‘ডোন্ট ওয়ারি, আই অ্যাম দেয়ার”। পুরুষালি
জবরদস্তিকে প্রেমিকের অবুঝ আবেগ ভেবে ক্ষমা করে দেওয়া ছাড়া আমার উপায় ছিল না।
আজও
কাঁদছি। ও আমাকে চিনতেই চাইছে না।
সদ্গতি
মুদির দোকানে দাম
মিটিয়ে চলে আসতে যাচ্ছিল সঙ্কল্প। বিভাসদা বলল, “এই টাকাটা পাল্টে
দিন”।
একশো
টাকাটার নোটটা হাতে নিয়ে দেখল। এক পাশে মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা কাগজ খুবলে গেছে।
যা এই নোট কে গছাল?
সঙ্কল্প টাকাটা বদলে পাশের বইয়ের দোকানে ঢুকল। খুব একটা
দরকার নেই। তবে ছেলের স্কুলের প্রোজেক্টের জন্য চার্ট পেপার লাগে অনেক সময়। বাড়িতে
আছে একটা। তবু কিনে রাখলে তো ক্ষতি নেই। টাকাটা যদি চালানো যায়।
গেল না। দোকানদার টাকাটা হাতে নিয়েই বলল, “পাল্টে দিন। আর
খুচরো দিন”। দুটোই খুব জরুরি। অচল একশো টাকা নিয়ে সচল নব্বই টাকা ফেরৎ
দেবে কেন?
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নন্দিতা বলেছিল টক দই
আনতে, দম্ভলের জন্য মিষ্টির বদলে টক দই ভালো। মনেই যখন পড়ল তখন
মিষ্টির দোকানটা ঘুরে ফেরা যাক। “দাদা এই নোটটা
বদলে দিন”।
জলে কাদায় ভারি থলে নিয়ে অতটা না হেঁটে যদি
রিক্শা নেওয়া যায়, তো ভালো হয়। পেয়েও গেল একটা। রাস্তা খারাপ বলে কুড়ির বদলে
ত্রিশ চাইছে। ভাড়া মেটাতে গিয়ে একশো টাকার নোটটা দিতে গিয়েও দিল না। বেচারা গরিব
মানুষ। ফাটা টাকাটার জন্য সঙ্কল্প গরিব হয়ে যাবে না, কিন্তু রিক্শাওয়ালা যদি
নোটটা কাজে লাগাতে না পারে তার পক্ষে অনেকটাই লোকসান; কারণ তাকে সত্তর টাকা ফেরৎও
দিতে হবে। তাছাড়া ত্রিশের জায়গায় একশোর নোট দেখালে হয়তো ভাববে, লোকটা ফাজলামি
করছে, ভাড়া দেওয়ার ইচ্ছা নেই। তাকে দশ টাকার গোটা নোটে ভাড়া মেটাল।
বাজারের থলে নামিয়ে সঙ্কল্প নন্দিতাকে প্রশ্ন করল, “কোথাও বেরোবে?”
“শনি মন্দিরে পূজো দিতে
যাব। আজ শনিবার না”।
“শনির প্রসাদ তো বাড়িতে
ঢোকানো যায় না। তুমি বরং ফল মিষ্টি কেনার পরিবর্তে এই একশো টাকাটা দক্ষিণা দিয়ে
দিও। দাঁড়াও নোটটা খামে মুড়ে দিই”।
চোখ
তখন শুধু এদিক ওদিক চাইতাম। কিন্তু কিছুই লক্ষ্য করা হয়নি।
লোকে বলত চোখ থাকতে কানা।
আর এখন আমার চোখ নেই। কেবল শুনি। কিন্তু লোকে আমার
দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশংসা করছে।
[২৮ শব্দ]
রোমন্থন
সোমবার সাত-সকালে বরাকর থেকে কোল্ডফিল্ড
এক্সপ্রেস। অণ্ডালে নেমে ধরতে হোত ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার, কারণ কোল্ডফিল্ড
বর্ধমানে থামে না। ময়ূরাক্ষীর একটা ফাঁকা দেখে কামরায় উঠে জানলার পাশ অধিকার করে
নিয়েছিলাম। বাইরে প্লাটফর্মে একজনের সাথে চোখাচোখি হতে সে বলল, “ঐ কামরায় চল, সবাই
ডাকছে”। আমার মতো একাকীত্বপ্রিয় নির্বান্ধব মেয়েকে সবাই ডাকে? জুত
করে বসা আসন ছাড়ার সামান্য বিরক্তি, আর ‘সকলে’র আবাহনের দরুণ
অনেকটা খুশি নিয়ে অনুসরণ করেছিলাম তাকে। ‘সবাই’ থাকা ঘিঞ্জি
কামরায় কোনওমতে বসতে পেয়ে হট্টগোলের ভেতর জেনেছিলাম নামটা তার। আর চোখে লেগে
গিয়েছিল হাসিখানা।
অপ্রত্যাশিত
ভাবে ‘হাসি’র আবার দেখা পেয়েছিলাম “আন্ত-বিভাগীয় একাঙ্ক নাটক
প্রতিযোগিতার সমালোচনা, ফলাফল ও পুরস্কার প্রদান”এর সন্ধ্যায়। আবার আমি ধরা পড়ে
গিয়েছিলাম আমি আদতে একা, যদিও হোস্টেলের সহ-আবাসিকা ছিল কজন সাথে। এক ঝলক
ভালোলাগার সাথে ভীরু প্রত্যাশা উস্কিয়ে চলে গিয়েছিল নিজের অপেক্ষমান বন্ধুমহলে।
তৃতীয়বার দেখা কবে হবে, আদৌ হবে কিনা – আমি তখন ব্যকুল হতে শুরু করে দিয়েছি।
হল সেই সর্বনাশা
দেখা শনিবার বাড়ি ফেরার দুপুরে বর্ধমান স্টেশনে। বরাকরে ওভারব্রীজ দূরে পড়বে জেনেও
ওর বন্ধুর ঝাঁককে অনুসরণ করে উঠলাম ঐ এক কামরায়। ভিড়ের ঘণত্বে আর শোরগোলে কান ছাড়া
যদি আর কোনও ইন্দ্রিয় সজাগ থেকে থাকে, তা ছিল আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। দুর্গাপুরে
বিনাটিকিটের দোসরযাত্রী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে গেল। আমরা পাশাপাশি।
ঘণ্টাখানেকের টুকরো বাক্যালাপের পর ও আসানসোলে নেমে গেল আমায় হৃদয়ে মনে সম্পূর্ণ
আচ্ছন্ন আর পর্যুদস্ত করে। “টাটা”র উত্তরে আমি তখন
আশা-দুরাশা-আশঙ্কায় টলটলে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। ও যে অনেক দূরের চাঁদ; আর
আমি আঁকশি হাতে বামন।
খুব কি দোষ ছিল ঐ বোকা মেয়েটার? কারণ
চতুর্থবার দেখা করতে আমার হোস্টেলে তো ও-ই এসেছিল। প্রকৃতির হিংসা হচ্ছিল? না হলে
বিদ্যুৎ চমকে, ঝড়ের দমকা তুলে কেন ওকে লক্ষ্মীছেলের মতো বিদায় করে দিল? বৃষ্টি তো
হল না, ঝড়ও না। নবীনবরণ অনুষ্ঠানের জন্য মাইকে শুধু বিষন্ন মাদক গুলাম আলি বেজে
চলল একের পর এক –
“ও কভি মিল যায়ে তো কয়া কিজিয়ে /
রাত-দিন সুরত কো দেখা কিজিয়ে...”
“দিলমে এক লহর সি উঠি হেয় অভি / কোঈ তাজা হাওয়া চলি হেয় অভি....”
গজলের কথাগুলো কি ভবিষ্যতের ইঠ্গিতবাণী ছিল? আমার
অন্তরাম্তাও বোধহয় তীব্র মেদুর আবেশের সাথে আশঙ্কায় বিহ্বল ছিল। অনুষ্ঠানের সাজগোজ
হয়নি তখনও। আর দরকার আছে? নিজের ঘরে গিয়ে প্রথমে দুপাক নেচে নিলাম। তারপর বালিস
ভিজিয়ে কান্না। আমার বালিকার মতো সদ্য যৌবনচিহ্ণ ফোটা শীর্ণ চেহারা, টুলটুলে মুখ
আর নিস্তরঙ্গ জীবন কি এতটা পেতে পারে? সত্যিই কি যা ভাবছি তাই? হে ঈশ্বর সত্যি করে
দাও।
না, দেন নি তিনি। সেদিনটাই শেষ।
কেন? এর উত্তর উপন্যাস।
আমার বিবাহের তেরো বছর, আর তার মুখ ফিরিয়ে
নেওয়ার পনেরো বছর পর তাকে ফেসবুকে খুঁজে পেয়েছি। ভারি ইচ্ছা হয় একটা বার্তা পাঠাই,
“remember?”। যত জল সে ঝরিয়েছে,
যত রক্ত সে ক্ষরিয়েছে –
তার হিসাব-নিকাশ নিয়ে তো বসতে পারব না। ক্ষতেও প্রলেপ পড়ে গেছে। শুধু মনে হয়
দেখিয়ে দিই আমি ভালো আছি।
অপ্রয়োজনীয়
ও তখন গবেষণা করছে।
স্টাইপেন্ড যা পায় তাই দিয়ে দুজন কেন একজনেরও ঠিকমতো চলে না। আমার চাকরিটাই
একমাত্র ভরসা। সেই ভরসাতেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।
ওর এখন
অধ্যাপনা, শতরঞ্চি, কফিহাউস, সাহিত্যসভা।
সংসারে যা কিছু প্রয়োজনীয় তা মোটামুটি আছে। শুধু আমার চাকরিটা অপ্রয়োজনীয় সাব্যস্ত
হয়েছে।
শিক্ষা
নোংরা জামা পরা
ছোট ছেলেটাকে কলার ধরে হেঁচড়ে আনল একজন রেলওয়ে পুলিস। এখান থেকে ভালো করে শোনা
গেলেও আওয়াজে মালুম হচ্ছে গালাগালি বকাঝকা চলছে। সঙ্গে চড় থাপ্পড়ও। হাতের ইশারায়
মনে হল উল্টো ঝুলিয়ে রাখার ভয় দেখানো হল ঐ আট-ন বছরের বাচ্চাটাকে।
দেখে অস্থির লাগছিল। হয়ত চুরি টরি করেছে। তাই বলে এত শাসন?
বড় বড় দুষ্ক্রীতিরা খুন, রাহাজানি, তছরুপ, কত কত ঘৃণ্য অপরাধ করেও ছাড়া পেয়ে যায়;
আর এইটুকু ছেলে যাকে হাল্কা বকে বুঝিয়ে বলা যায়, তাকে এমন হেনস্থা? ব্যাপারটা
সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বুকে সাহস যুগিয়ে একটু দ্বিধা নিয়েই এগিয়ে গেলাম। “ভাইসাব “– !!..” । কিছু বলার আগে কানে এল, “বড়া হো কর বহুত খরতনাক বনেগা সালা
মাদার-চো..”।
“এ
কী?! এসব কী বলছেন আপনারা? কোনও দোষ করে থাকলে বকুন, বুঝিয়ে বলুন। একে তো মারধোর
করছেন; তার ওপর এমন নোংরা গাল দিলেন, ঐটুকু বাচ্চা তার মানেও বোঝে না। ছিছিছিঃ!
শিক্ষা দিন, কুশিক্ষা দিচ্ছেন কেন?”
“আপ
আপনি মশিনমে তেল ডালিয়ে ম্যাডাম। হামারে কাম মে টাঙ মাত আড়াইয়ে। ইএলোগ কয়া কর সকতে
হেয়, আপলোগ সোচ নেহি সকতে। যাইয়ে!”
ধমক খেয়ে সমাজ
সংস্কারে ইতি টেনে ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। তবে ছেলেটা আর দু-একটা কথার পর ছাড়া পেয়ে
গেল। সোজা আমার কাছে এসে হাত পাতল, “বিসগো
রুপিয়া দিজে না”।
আহা, হয়ত ওর
চুরির বা ভিক্ষার সব টাকা পুলিস কেড়ে নিয়েছে। মায়া লাগল। দিলাম। মুখ নামিয়ে বললাম,
“এই কোথায় থাকিস রে তুই? মা বাবা কী
করে?”
উত্তর নেই।
“পুলিস
কেন মারছিল তোকে? কী করেছিস?”
বেশ কয়েক বার প্রশ্ন করেও ওর ঘাড় গোঁজ করে চুপ থাকা অবাধ্য
ভাবটা গেল না।
“কী
রে, তোকে পুলিস ঠ্যাঙাচ্ছিল, সেটা বুঝি ভালো ছিল? তাদের আটকালাম। টাকা চাইলি,
দিলাম। আর সামান্য প্রশ্ন করছি, জবাব দিচ্ছিস না?”
“তোর কী রে, খানকি মাগী?” উদ্ধত
ভঙ্গীতে চলে গেল ও।
মূল্যায়ন
অরিন্দম হাসি
হাসি মুখে বেরিয়ে এল। তাকে চূড়ান্ত কথাবার্তার জন্য বসতে বলা হয়েছে। যোগদানের
দিনক্ষণ ঠিক হবে। এই নিয়ে পনেরো জনের মধ্যে তিনজন। যাদের পরে যোগাযোগ করে নেবে
বলেছে, ভদ্র ভাষায় তার অর্থ, কোনওদিনই যোগাযোগ করবে না। এখনও বাকি গোটা কুড়ি
প্রার্থী। শ্রেয়সীর ডাক এল।
উন্মেষ বলল,
বেস্ট অফ লাক। অবশ্য তোর চিন্তা নেই। সুন্দরী মেয়ে দেখে এমনিই চাকরি দিয়ে দেবে।
জবাব দেবার সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই
হল না। যে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে সাক্ষাৎকারের ডাক পেয়েছে ওদের ইনস্টিটিউটের ছজন,
তার মধ্যে শ্রেয়সীর নম্বরই সর্বোচ্চ। দরজা ঠেলল।
-মে আই কাম ইন স্যর?
-কাম ইন। ..হ্যাভ ইওর সীট।
- থ্যাংক ইউ।
- ইওর নেম?
-শ্রেয়সী কর্মকার।
- ইওর ব্যাকগ্রাউন্ড বিফোর এমবিএ মার্কেটিং?
- ফিজিক্স অনার্স।
- হোয়াই ডু ইউ থিংক ইউ আর স্যুটেব্ল ফর দিস জব? আর ইউ ওপেন
টু সেল্স্ জব?
- আই অ্যাম ফন্ড অব স্ট্যাটিসটিকস্ অ্যান্ড ডিলিং উইদ্
ডেটা। আই প্রেফার রিসার্চ ওরিয়েন্টেড ওয়ার্ক টু হার্ডকোর সেলিং। অ্যান্ড আই হ্যাভ
ট্রাস্ট অন মাইসেল্ফ।
- ইউ আর প্রিটি গুড-লুকিং। ইউ ক্যান বি আ সাকসেস্ফুল সেল্স
এক্সিকিউটিভ।
- মে বি। বাট আই হ্যাভ মাই প্রেফারেন্স। আই টুক অ্যান
অ্যানালিটিকাল অ্যানাইনমেন্ট অ্যাজ মাই প্রজেক্ট ওয়ার্ক টু-উ, হয়্যারবাই আই অলমোস্ট কারেক্টলি ডিটারমাইন্ড
দ্য কম্পানিজ কম্পিটিটিভ মার্কেট পোজিশন অ্যালং ইউদ ফিউচার প্রোজেকশন।
- হোয়াই ডোন্ট ইউ প্রেফার সেল্স? ডোন্ট ইউ লাইক টু
ইন্টার্যাক্ট উইথ পিপল? আ লেডি উইথ সাচ আ চার্মিং পারসোনালিটি লাইক ইউ আর সাপোজ্ড
টু উইন ওভার পিপল ভেরি ইজিলি, ইফ শী নোওজ হাও টু টক।
- স্যর আই ডোন্ট মাইন্ড টু ডু সেল্স। বাট আই হ্যাভ
অ্যাপ্লায়েড অ্যান্ড কোয়ালিফাইড দ্য রিটন অ্যাপটিট্যুড টেস্ট ফর দিস পার্টিকুলার
জব।
- আর ইউ রেডি টু জয়েন আওয়ার সেল্স টীম?
- আই উড লাইক টু জয়েন ইওর মার্কেটিং রিসার্চ টীম, হোয়াট আই
হ্যাভ বিন কল্ড ফর।
-ওকে। উই শ্যাল গেট
ব্যাক টু ইউ, ইফ ইউ আর শর্টলিস্টেড।
সূত্রপাত
অনেক দিন পর জয়েন করে অফিস থেকে বেরোতে এত
দেরি হল, শেষ বাসটাও পাওয়া গেল না। একটা ট্যাক্সি পেয়ে অগত্যা গা এলিয়ে আদর্শ বলল,
“বিধান নগর স্টেশন”। যা গেল
-বাঁচাটাই উদ্দেশ্যহীন অপরাধ হয়ে গেছে। মা বোবা, স্ত্রী জিবন্মৃত।
চালকের সিটের পেছনে ট্যাক্সির নম্বরটা দেখেই
চমকে উঠল। গত ডিসেম্বরে এই নম্বরটাই ছিল পুপাইয়ের মুখের শেষ কথা। সত্তর শতাংশ
ঝলসানো দেহটাকেও আইসিইউ-তে নেয়নি। এসি কেবিনে বারো দিন ধরে চেতনা ফিরলেই পুপাইয়ের
আর্তনাদ। হঠাৎ শব্দস্ফূরণ হতে এই নাম্বরটাই চেঁচিয়ে শোনাতে শোনাতে শেষ হয়ে গিয়েছিল
মেয়েটা।
শেষের শুরুটা অবশ্য যশোর রোডের ওপর উৎকট জোরে বাজনা বাজিয়ে
ছুটে চলা একটা গাড়িতে ছজন যুবক মিলে করে দিয়েছিল। পায়ে রক্তের স্রোত, মুখে
গ্যাঁজলা, সর্বাঙ্গে আঁচড়-কামড়, পুরুষালি ক্লেদ.... নর্দমার ধারে পড়ে থাকা নিজের
কন্যাকে দেখে প্রথমে গা পাক দিয়ে উঠেছিল। সুমনা ভাগ্যিস সঙ্গে ছিল না। কয়েকজন
অনিচ্ছুক পথচারীর হাতে-পায়ে ধরে নার্সিংহোম। পুলিস কেস। ডায়রি ছাড়া ভর্তিই হবে না।
খবর গেল। থানাতেও, বাড়িতেও। স্থানীয় থানা এফআইআর নেবে না; বলে ব্যাগ হারানোর জিডি
করতে! পাড়ার দাদা-দিদিরা পরের দিন থানা ঘিরে এফআইআর করাল। আদর্শরা তাহলে একা নয়?
বাড়ি ফিরে পুপাই সদর দরজা খুললেই আঁৎকে উঠত। প্রতিশোধের
বদলে মেয়েকে জীবনে ফিরিয়ে আনাই বড় চিন্তা। কিন্তু শুরু হল শাসানি গালাগালি; দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে – ডাইরি ফিরিয়ে
নিতে হবে। এক দিন রাতে দরজাও ভাঙল। মা-বাপ ঠাকুমার সামনে পোষাকের সাথে ক্যাথিটার
হেঁচকে খুলে ঘা না শুকোনো দেহটাকে ....! “খিক্-খিক্-খিক্। কী দিন এল
মাইরি! আগে মেয়ের ইজ্জত গেলে গোটা পরিবার মুখ লুকোবার জায়গা পেত না, দড়ি-কলসি
খুঁজত। এখন থানা, আদালত, টিভি – ছিছিছিঃ, এত বেহায়া হয়েছে সব! নিকেষ না করলেই ঝামেলা-”
আবার তিন মাস শয্যায়। ওরা জেল হাজতে জেনে পুপাই আস্তে আস্তে
বাবার হাত ধরে কলেজ যাচ্ছে, মাকে জড়িয়ে ফিরে আসছে। এক দিন মা পৌঁছনোর আগে কতগুলো
মুখোশ পরা জোয়ান পুপাইকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছিল। ঝলসানো দেহটা উদ্ধার হল
সন্ধ্যেতেই। বন্ধুদের হেনস্থার প্রতিশোধ। ট্যাক্সি-চালকের মদত স্পষ্ট। তবে এবারের
কাউকে ধরা যায়নি।
শরীরটা সেকেন্ডারি ইনফেকশনে সবুজ হয়ে গিয়েছিল শেষে।
পুপাইয়ের বিকৃত মুখ থেকে বারো দিন বণর্নাতীত কাতরানির পর অকস্মাৎ চিৎকার বার হতে
লাগল, “ডাব্লিউবি-টোয়েন্টি থ্রি-কে..”।
লড়াই তো ছেড়েই দিয়েছিল আদর্শরা। মুমূর্ষু মেয়ের দেওয়া
সুত্রটা হাতে পেয়ে ফেলে দেবে? পকেট হাতড়ে লাইটারটা বার করল। কিন্তু রাস্তাটা ফাঁকা পাওয়া দরকার।
বলল, "বারাসাত চলুন। এখন আর উল্টোডাঙা থেকে ট্রেন ধরা যাবে না।
ফল
ফাইনাল
সেমেস্টার দিয়ে বাড়িতে আছি। আর চাকরির দরখাস্ত করে চলেছি দিনে গড়ে চার-পাঁচটা করে।
হুট করে কলকাতায় গিয়ে ‘ওয়াক-ইন-ইন্টারভিউ’ দেওয়া সম্ভব নয়। তখন কলকাতার অফিসগুলো এসটিডি
খরচ করে দূরের জেলার প্রার্থীদের ফোন করত না; কলকাতা টেলিফোনের আওতাভূক্ত জায়গাগুলোয়
খবর দিত মূলত। কদাচিৎ পত্র মারফৎ সাক্ষাৎকারের ডাক আসত। তখন আমার ঠাকুমা শয্যাশায়ী
ছিলেন। মা কাকিমাদের সঙ্গে আমিও হাসপাতাল বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছি। বাড়িতে আনার পর
দরকারে বেড-প্যানও ধরছি। এই সময় একটি বহু প্রতীক্ষিত কল লেটার পেলাম। আমার
পড়াশুনোর সাথে একদম মানানসই। না আর সুযোগ নষ্ট করব না। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে ভোর
বেলা বরাকর থেকে কোল্ডফিল্ড ধরার বদলে ঠাকুমার বমি পরিস্কার করতে হল। দুর্লভ সুযোগ
হাতছাড়া করায় আফশোস হচ্ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, গুরুজনের সেবা করতে গিয়ে
চাকরি ফস্কেছি - বেশ পুণ্য হল।
আমার পরীক্ষার
সময় রাত জেগে পড়ার অভ্যাসের জন্য ছুটির পরেও রাতে ঘুম আসতে চাইত না। তাছাড়া কলেজে
শিক্ষকতা ও নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য পড়াশুনোটা ঝালিয়ে রাখাও জরুরি ছিল।
সেদিনও সারা রাত ঘুমোইনি যথারীতি। ভোরবেলা নতুন কিনে সদ্য শেখা সাইকেল নিয়ে বাড়ি
থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দামোদরের তীরে দেবী ছিন্নমস্তার মন্দিরে গেলাম খানিক
মাঙন-যাচন করতে। মনে পুণ্য-সঞ্চয়ের মনোবল। সাইকেলে তালা দিয়েও মনে খচ্খচানি; কেউ
যদি নিয়ে চম্পট দেয়। মাকে প্রণাম করার সময়ও মনটা পড়েছিল সাইকেলের দিকে। তা দোষ
কোথায়? ঠাকুর রামকৃষ্ণও তো কীর্তনে গিয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়ার পর জ্ঞান ফিলে এলে
প্রথমেই নিজের জুতোর খোঁজ করতেন। আর আমার তো সাইকেল, জুতো দুটোই বাইরে। যা জায়গা!
না, চুরি যায়নি।
আমি ফিরছি। রাস্তায় মুখোমুখি যানবাহন এড়াতে পীচ রাস্তা ছেড়ে বাঁ পাশে নেমে গেলাম।
আবার যখন ডান দিকে হ্যান্ডেল বাঁকিয়ে উঠতে যাচ্ছি, তখন গতিবিজ্ঞানের অঙ্ক মেনে
সপাটে ধড়াস্। ডান দিকচেপে পড়লেও বাঁ হাতে অসহ্য যন্ত্রণা। ডান কনুই কেটে রক্তপাত
হচ্ছে। রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে মুখে রক্ত, লালার মিশ্রধারায় ধূলো-বালির কিচ্কিচ্।
নিজে ওঠার সামর্থ্য ছিল না। ওপাশ থেকে আসা একটা মিনিবাস এগোতে গিয়েও থেমে গেল।
আমায় রাস্তার লোকজন আর বাসের আরোহীরা মিলে উঠিয়ে একটা গাছের নীচে বাঁধানো বেদীতে
বসিয়ে দিল। যন্ত্রণার তাড়সে আমার মাথা ঘুরছে, গা পাক দিচ্ছ, চোখে সর্ষে ফুল। আমার
আনচানানি দেখে কয়েকজন রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট সম্ভবত টালির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে
খাটিয়ায় শুইয়ে দিল।
লোকে জানতে
চাইল, বাড়ি কোথায়? কোন বাড়ির মেয়ে জানার পর একজন অচেনা আরএকজন অচেনাকে বলল, “সাইকেলটো স্বরূপদাদের বাড়িতে
পৌঁছায়েন দিয়ে খবর করে আয়”।
যা! সাইকেল বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছবে তো? আমার উদ্বেগ আর আপত্তি অগ্রাহ্য করে এক গ্লাস
লেবু চিনির শরবৎ খাওয়ানো হল। বাড়ির ছেলেটির নাকি সেদিন বিয়ে। অবর্ণনীয় কষ্ট আর দুশ্চিন্তা নিয়ে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা
করছি, কখন বাবা আসবে। হঠাৎ কানে এল, “কী করে পড়লি ইডিয়েট?”
ছোটকা। স্কুটার নিয়ে হাজির।
“আমার সাইকেল পেয়েছ?”
“পেয়েছি। সে ভাবনা পরে। কোথায়
লেগেছে? পেছনে বসতে পারবি?”
“পারব”। বমিভাব, মাথা ঘোরা আর যন্ত্রণাটা
থাকলেও অস্তিত্ব ওলট-পালট করা আনচান ভাবটা একটু যেন কম। বোধহয় শরবতের গুণে।
মন্দিরে গিয়ে
পাঁচ মিনিট কাটানোর সময়ও মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছিলাম না। তার কুড়ি মিনিটের
মাথায় সম্পূর্ণ বেহাল অবস্থায় অজানা অচেনা মানুষের জটলায় খুঁজতে লাগলাম কাকে কাকে
কৃতজ্ঞতা জানাব। আমার সাইকেলের চালক তথা বার্তাবাহককে তো চোখেই দেখিনি। আর বুঝতে
পারলাম না, মাকালী আমায় কীসের ফল দিলেন, ঠাকুমাকে সেবা করার না মানুষকে অবিশ্বাস
করার?
স্বনির্ভরতা
_ মা ভিক্ষা-
_
ভিক্ষা? খেটে খেতে পারো না?
_
কে বলে ভিক্ষা করতে খাটনি নেই। আমি খেটেই খাই।
_
ইয়ে, মানে – এমন খাটনি খাটো কেন, যাতে অন্যেরা বিরক্ত হয়?
_
তাহলে সেলস্ম্যান হয়ে দুপুর বেলা আপনার কলিংবেল বাজালে ভালো হোত?
আচ্ছা
ত্যাঁদোড় তো! এমন উপমা দিল, অন্বেষা কথা খুঁজে পেল না। তবু বলল,_ ঐ আর এক উৎপেতে
জীব! তবু তারা কিছু দিয়ে তার বদলে পয়সা চায়। তোমার মতো শুধু হাত পাতে না।
_
আমি বড়ি, আচার পাঁপাড় বিক্রি করলে নেবেন?_ বলল আপাদমস্তক ঝিকুট ময়লা লোকটা।
_
এত নোংরা না থাকলে কিনতাম। স্নান করে কাচা কাপড় পরতে পারো না?
_
বাথরুম কোথায় পাব? শালা ছোঁচাবার জল পাই না সব সময়।
_
ভিক্ষা করে তো রোজগার মন্দ হয় না। সুলভ শৌচালয়ে যেতে পারো পথঘাট নোংরা না করে।
নতুন জামাও কিনতে পারো।
_
শুনুন দিদি, এই ময়লা পোষাকটা আমার উর্দি। এর জোরেই রোজগার। তাহলে মানলেন তো আমি
রোজগার করি? আপনি কী করেন দিদি?
তোলা কাজের মেয়ে আছে, রান্নার রাঁধুনি আছে,
ছেলের জন্য টিউটর আছে, বরের মোটা মাইনের চাকরি আছে। ভিক্ষা বার করতে করতে অন্বেষা
ভাবতে লাগল সে কী করে।
কষ্ট যে পায়
-
আচ্ছা মাকে এসব কথা শোনাস কেন? - - আর কাকে শোনাব?
-
কিন্তু মা কি কিছু করছে? শুধু শুধু নিজের যাবতীয় সমস্যার কথা জানালে মায়ের কষ্ট হয়
না? মা কী করবে?
-
তা ঠিক।
-
তাহলে কী লাভ হয় বলতো?
-
মাই যে একমাত্র রিঅ্যাক্ট করে।
মীমাংসা
- কজন ছিল?
- ছ জন।
- তার পরেও বেঁচে আছো? গত জন্মে ক্লিওপেট্রা ছিলে নাকি? খিক্ খি্ক্..
ডিফেন্স লইয়ারের সরস জেরায় বাদী পক্ষের উকিল, টাইপিস্ট,
রক্ষী এমনকি ধর্মাবতারও হেসে উঠলেন। প্রতিপক্ষ দুই কৌঁসুলি নিজেদের মধ্যে
হাসি-ঠাট্টা করছে। এখন খোলা আদালতে জনসমক্ষে এ ধরণের মামলার শুনানি হয় না। রুদ্ধ
দ্বারে নির্যাতিতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ম। তাই হচ্ছে। কিন্তু ফরেন্সিক রিপোর্টের
কথা কেউ তুলছে না কেন?
বিচারক মোবাইল কানে কার সঙ্গে যেন হাসি মুখে কথা বলছেন।
হঠাৎ “দূষ্টান্তমূলক শাস্তির” দাবিতে চমকে উঠে
বললেন, “অ্যাঁ, কী বলছিলেন?”
মেয়েটির উকিল কিছু বলার আগেই একজন ঘরে ঢুকে হুজুরের কানে
কানে খবর দিল।
_ ও,
তাহলে তো হয়েই গেল। একজন অ্যাকিউজড ভিকটিমকে বিয়ে করতে রাজি। সেই ভালো। সব
অ্যাকিউজড চাঁদা করে বিয়ের খরচ তুলুক। দেবেশ মণ্ডল আর ভিকটিম শতাব্দী গাঙ্গুলির
শুভ পরিণয়ে মধুরেণ সপাপয়েৎ। ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ, জাতপাত বিভেদের বিপক্ষে একটা
নজিরও তৈরি হবে। আসামি দেবেশ মণ্ডলের স্টেটমেন্ট টাইপ করা হোক।
_ কিন্তু আমি ঐ জানোয়ারটাকে বিয়ে করব না। আমায় যা করেছে
ওরা, আমি তো মরেই যেতাম!
_ মরোনি তো।
_ কিন্তু বিয়ে করলে আমায় রোজ হ্যানস্থা করবে, তিলে তিলে
মেরে ফেলবে। আমি এমএসসি পড়ছি। ও গোমুখ্য ক্রিমিনাল। মা বাবা বেঁচে থাকতে এভাবে
আমার জীবন নষ্ট হতে দেবেন না।
_ চোপ্! রেপড্ হয়ে বড় বড় কথা?
ছেলেমেয়েগুলোর
মস্তিতে কাটলেও মা দুর্গার পূজোর দিনগুলো ভালো গেল না। হারু ময়রা গণেশ সেজে অন্তত
নিজের দোকানে পূজোর যাবতীয় মিষ্টির বরাত বাগিয়ে নিয়েছে। পিঠে সাঁটানো দুখানা
থার্মোকলের হাত, হাতে থামোর্কলের গদা আর নাকে শুঁড় -এতেই ব্যাটা ভুঁড়িদার টাল খেয়ে
হ্যাঁচ্চো দিচ্ছে। দর্শকরা হেসে কুপোকাত।
গলতি করেও টিআরপি বাড়ানোয় বাড়তি খাতির।
ঋত্বিক তো ‘লাইভ ঠাকুর’এর থিম শুনেই তদ্বির করে কার্তিকের ভূমিকাটা যোগাড় করেছে।
উন্মুক্ত ঊর্ধাঙ্গে সরু উড়ুনি পেঁচিয়ে মাল্টিজিম করা পেশি প্রদর্শন করার
জবরদদস্ত সুযোগ। কাজ তো মাটির তৈরি
ময়ূরাসনে পোজ মেরে বসে থাকা। উপরি পাওনা চিনির বোন পাড়া-সুন্দরী মিনি সরস্বতীর
বেশে ঠিক পাশে। ব্রেকটাইমেও পাশাপাশি। কার্তিকের আবেশে কিনা কে জানে, সরস্বতীর হাত
থেকে কতবার যে বীণা হড়কালো; পূজো কমিটির যেন চোখেই পড়েনা। কপাল করেছে লক্ষ্মী।
পাছা পেরোনো চুলে উইগ লাগেনি। জুটেছে শ্যাম্পু আর হেয়ার অয়েলের বিজ্ঞাপণে
মডেলিং-এর দারুণ অফার।
জ্বালা শুধু মায়ের। পিঠে চারজোড়া সপ্রহরণ থার্মোকলের হাত
কেন বেঁকে যাচ্ছে, রণংদেহী চোখ কেন মোলায়েম হয়ে এদিক ওদিক চাইছে, ত্রিশূলের খোঁচা
অসুরের রঙ করা ক্ষতে কেন স্থির থাকছে না– শুধু হাজারো খিটখিট।
হাইয়েস্ট পেইড কেন্দ্রীয় চরিত্র যে। এমনিতেই থিয়েটার শিল্পী মন্দিরার ঘাড়ে কোমরে
স্পন্ডেলিসিস। মহিষাসুর মর্দিনী হয়ে টানা পাঁচ দিন ত্রিভঙ্গ মুরারীর বিভঙ্গে
দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গে যন্ত্রণা চাগাড় দিচ্ছে। অসুরও এবার একটা নয় - সুদীপ্ত সেন,
সঞ্জয় দত্ত, লালুপ্রসাদ, শ্রীসন্থ। কোনওটার বুকে ক্ষত আঁকা তো কোনোটার উরুতে।
ত্রিশূলের নিশানা ঠিক রাখা চাট্টিখানি কথা? হতচ্ছাড়াগুলো কেউ লুকিয়ে পায়ে সুড়সুড়ি
দেয়, কেউ চিমটি কাটে। বৃথা নালিশ। তিন বেলার খ্যাঁটন ছাড়া একটি পয়সা এখনও ঠেকায়নি
পূজো কমিটি। আজ দশমী, হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। সকালে ফুল পেমেন্ট না পেলে সন্ধ্যেয়
সিঁদুর খেলা ও বিসর্জ্জনে দুর্গা পারফর্মই করবে না এই বেহাল শরীরে।
সন্ধ্যেবেলা ঘট বিসর্জ্জনের শোভা যাত্রায়
দুর্গাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সিদ্ধি খেয়ে একটু গা ঝালিয়ে নেওয়ার। পাঁচদিন একটানা
দাঁড়িয়ে শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেছে। ম্যাটাডোরে
কার্তিক গণেশ ‘লুঙ্গিডান্স’এ দেহ উজাড় করে দিল। লক্ষ্মী সরস্বতী ফাটিয়ে দিল ‘চিকনি চমেলী’র সঙ্গে। মা কেবল
পিঠে কোমরে ব্যথা নিয়ে ব্যাজার মুখে ফুকফুক সিগারেট টানতে লাগল।
শস্স্স্
পোপ:
মর্ত্যে স্বাগত মিস্টার গাগারিন। আচ্ছা, আপনি মহাকাশে শুভ্র-বসন পরিহিত, সাদা
শ্মুশ্রু-গুম্ফ-শোভিত, দিব্য জ্যোতির্ময় কোনও পুরুষের সাক্ষাত পাননি?
ইউরি
গাগারিন: না তো?
পোপ: শস্স্স্! আমি জানি তিনি নেই। কিন্তু
একথা খবরদার কাউকে জানাবেন না।
স্তালিন: রাষ্ট্রে স্বাগত মিস্টার গাগারিন। আপনি মহাকাশে
কোনও সাদা আলখাল্লা পরা, সাদা দাড়ি-গোঁফওয়ালা জ্যোতির্ময় কোনও পুরুষকে দেখেছেন?
ইউরি
গাগারিন: হ্যাঁ, দেখেছি।
স্তালিন:
শস্স্স্! আমি জানি তিনি আছেন। কিন্তু একথা খবরদার কাউকে জানাবেন না।
ভারতে প্রথম অলিম্পিকের মশাল
নিজস্ব প্রতিবেদন: নয়া দিল্লি, ২৮ অগস্ট: সকাল থেকে সাজো সাজো নয়া দিল্লি
বিকেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য। ভারতের মাটিতে প্রথমবার শুরু হল অলিম্পিক গেমস্
আজ। একশো তিরিশ কোটি ছাড়ানো জনসংখ্যার এই দেশ অলিম্পিকে পদক জয়ের দৌড়ে বরাবরই লজ্জাজনকভাবে
পিছিয়ে। বিগত তিনটি মিটে গুটিকয় সোনা ও অন্যান্য পদক জয়ের পর আন্তর্জাতিক এই
ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ভারতের সওয়াল ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল। তবে পদক
তালিকা নয়, বিশাল বাজার ও ক্রয়ক্ষমতাই বহুজাতিক স্পনসরদের আকর্ষণ করে ভারতবর্ষের
মাটিতে এই প্রতিযোগিতা টেনে আনল বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
তিরন্দাজী, শ্যুটিং, অ্যাথলেটিকস্, কুস্তি, বক্সিং,
ভারোত্তোলন-এ পদক জয়ের আশা কতটা সফল হয়, তা আগামী পনেরো দিন বলে দেবে। আপাতত তাক
লাগিয়ে শুরু হয়ে গেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ‘তিলোত্তমা’ স্টেডিয়ামের
মধ্যিখানে যখন একে একে আটটি ভূগর্ভস্থ মঞ্চ মাটি ফুঁড়ে উঠে এল বিবিধ পরিবেশনার
সমন্বয়ীত রূপসহ, তখন ইওরোপ আমেরিকার দেশগুলিও বিস্ময়ে হতবাক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের
জন্য বিগত ছয় মাস ধরে মহড়া দিয়ে এসেছে ছ’ হাজার লোকনৃত্য, ধ্রুপদী
নৃত্য শিল্পীর সঙ্গে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠিত ডান্স রিয়্যালিটি শোয়ের সেরা
প্রতিভারা। সঙ্গীত পরিচালনায় বলিউড কাঁপানো দুই বাঙালী দিকপাল – অতনু মিত্র ও
গৌতমের প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ফিউশন কম্পোজিশন যেন রহমানের অস্কার বিজয়ের গৌরবকেও
ছাপিয়ে গেল। ক্ষুদে থেকে পোড় খাওয়া নৃত্য শিল্পীদের অবিশ্বাস্য ছন্দোবদ্ধ শারীরিক
কসরত দেখে চেকোস্লোভাকিয়ার জিমনাস্ট কোচের মন্তব্য, “এরা জিমনাস্টিক্সে
তালিম পেলে ভারতের পদক সংখ্যা হয়তো বাড়তে পারত”। কিন্তু আমাদের
দেশে ক্রিকেট গুঞ্জন, বেটিং কেলেঙ্কারিও যতটা গণমাধ্যম ও জনপ্রিয়, অন্যান্য খেলা
ততটা নয়। লিয়েন্ডার, মহেশ, সানিয়া, সাইনা, সিন্ধু, মেরি কম, বিজয়েন্দ্র, ধনরাজদের
কথা গ্র্যান্ডস্লাম, ওয়ার্লড-কাপ, এশিয়াড, অলিম্পিক ছাড়া মনে থাকে না। আমাদের
দেশের সেরা ক্রীড়া প্রতিভারা হয়তো তাই অজানতেই বিনোদনের জগতে তারকা হওয়ার দৌড়ে
শামিল হচ্ছে।
সমাপ্তির অনুষ্ঠানে নাকি আরও চমক অপেক্ষা
করছে। খরচ হচ্ছে মোট সতেরো হাজার কোটি টাকা, বারো হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যা
দিয়ে অন্তত হাজার খানেক গ্রামের চেহারা বদলানো যেত। যাই হোক আয়োজক দেশ হিসাবে
পদক-তালিকায় প্রথম দশের মধ্যেও জায়গা না পাওয়ার লজ্জাজনক বিশ্বরেকর্ড না গড়লেই মুখরক্ষা হয়।
ফের পরীক্ষার ফল ফের বহুতল
নিজস্ব সংবাদদাতা: ইন্টারনেটে আইসিএই-র ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর নিজের ফল
দেখে এক ছাত্রী বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে গত মঙ্গবার। ঘটনাটি ঘটে
বাইপাসের ধারে একটি অভিজাত আবাসনে। নিজের অফিসে ইন্টারনেটে রেজাল্ট দেখে দেবিকা
গুহ নামের ঐ ছাত্রীটির বাবা অনিরুদ্ধ গুহ মেয়েকে আনন্দচিত্তে অভিনন্দন জানাতে
যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে এক প্রতিবেশীর কাছে ফোনে শোনেন এই মর্মন্তুদ ঘটনা।
দেবিকার মা শ্রীজাদেবী শয্যাশায়ী। তিনি জানান
নেটে সেন্ট জোসেফের দেবিকা গুহর বদলে সেন্ট জুডাসের দেবিকা গুহর রেজাল্ট দেখেই এই
হটকারী সিদ্ধান্ত। ‘ও তো শিক্ষিত মেয়ে, নিজের রোল নাম্বারটাও মিলিয়ে দেখল না?
সোজা ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্জিট দিয়ে ন-তলা থেকে নীচে লাফ দিল! আমাদের কথা একবারও
ভাবল না?”
জগিং ট্র্যাকে পড়ে থাকা দেবিকার রক্তাত্ত দেহ দেখে আবাসনের
অন্যান্য আবাসিকরা শ্রীজাদেবীকে খবর দেন। শোকগ্রস্ত মা শুনেই পাগোলের মতো লিফ্টের
বদলে সিঁড়ি, ন’তলার আপৎকালীন নির্গমণ পথ আর করিডোরের মধ্যে ছোটাছুটি করতে
থাকেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে সামলে প্রথমে অনিরুদ্ধবাবুকে ও পরে পুলিসে খবর দেন।
অপর যে দেবিকা গুহের উনসত্তর শতাংশ নম্বর দেখে এই দেবিকার
এমন সিদ্ধান্ত, সে নিজের ফলে উচ্ছ্বসিত না হলেও খুব একটা হতাশ নয়। কিন্তু তার
রেজাল্টের জেরে তারই মতো আরটি মেয়ের এভাবে অকালে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। “আমি নিজের কাছে
নয়, ঐ দেবিকার পরিবারের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব”। চোখের জল মুছেতে
মুছতে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে সে।
সমাজবিদ্ ও মনস্তাত্বিক ডাঃ সর্বাণী মল্লিক বলেছেন, “অত্যধিক উচ্চাশাই
এই সর্বনাশের কারণ। যারা পরীক্ষায় ভালো করে তারা নিজেদের ও তাদের পরিবারের
প্রত্যাশা এতটাই বেড়ে যায় যে মনমতো রেজাল্ট না হলেই তীব্র হাতাশার শিকার হয়। এই
হতাশা ও পারিবারিক চাপ তাদেরকে চূড়ান্ত পথ বেছে নিতে প্ররোচিত করে।
কন্যাহারা দেবিকা গুহর মা-বাবার দাবি তাঁরা প্রেরণাই
দিয়েছেন, চাপ নয়। অন্য দেবিকার প্রতি তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই। বরং তার দীর্ঘায়ু ও
মঙ্গল কামনা করেছেন এই শোকগ্রস্ত দম্পতি।
মামলা
- হুজুর।
এটি একটি চিরন্তন ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। নারী যে কতটা সর্বনাশা তা এই ঘটনা থেকে
বোঝা যায়। আসামি কামাল ও জামাল একই মেয়েকে ভালোবাসত। দুজনেই এক ইদের সন্ধ্যায়
মেয়েটিকে উপহার দিতে তার বাড়িতে হাজির হয়। মেয়েটা কামালের উপহার গ্রহণ করায়
জামালের রাগ হয়। সেই থেকে হাতাহাতি। জামাল নিজের ভাই কামালকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে।
জামালও কামালকে ছোরা দিয়ে প্রত্যাঘাত করে। দুজনেই গুরুতর আহত হয়ে আট মাস হাসপাতালে কাটায়। বর্তমানে আপনার এজলাসে। আপনি
বিহিত করুন।
-
সেই মেয়েটি কোথায়? কী নাম? সে কী চায়?
-
হুজুর, সে তো আট বছর আগে সেই ঘটনার রাতেই মারা গেছে।