বাঙালির সহিষ্ণুতা ও খণ্ডিত জাতীয়তা
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯০৫, ১৯১১, ১৯৪৭,
১৯৫২, ১৯৬১, ১৯৭১, ২০১৩ । কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় এই বছরগুলোর মধ্যে? বঙ্গভঙ্গ,
বঙ্গভঙ্গ রদ, স্বাধীনতা, পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষা আন্দোলন, আসামের বারাক-কাছাড়ে
বাংলাভাষীর সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, শাহবাগ আন্দোলন। সেই
পরাধীনকাল থেকে ঔপনিবেশিক রাজশক্তির কোপে পড়া, স্বাধীনতার নামে রক্তে আগুনে ছারখার
হয়ে যাওয়া, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের মতো মৌলিক অধিকারের জন্য উর্দুপন্থী মৌলবাদের হাতে
রক্তাত্ত হওয়া, হীন প্রাদেশিকতার শিকার হয়ে প্রাণত্যাগ, লাগাতার রক্তপাতের বিনিময়ে
ভাষাগত পরিচয়ে জাতীয়তা লাভ, ‘দেশদ্রোহী’ চিহ্নিতদের চরম শাস্তি প্রদানের দাবিতে গণ-আন্দোলন।
শেষেরটি শুনতে ইতিবাচক হলেও তার প্রভাব নিয়ে পরে আলোচনায় আসছি। কিন্তু পরপর যে
ঘটনাগুলি উল্লিখিত হল, সেগুলো সবকটাই হয়েছে একটি বুদ্ধিমান, সাহসী কিন্তু
অতিমাত্রায় শহনশীল আদর্শবাদী ভারতীয় জাতিকে বিচ্ছিন্নতার বিষে জর্জরিত করে,
যন্ত্রণা-ক্লেশে তছনছ করে। উপনিবেশ স্থাপনকারীদের উদ্দেশ্য সাধু না হওয়াই
স্বাভাবিক। তারপরেও কেন ভিন্ন ভাষাভাষীদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছে দেশ কাল
ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি জাতি? রাজনৈতিক আক্রমণ, ধর্মনৈতিক আক্রমণ, সাংস্কৃতিক
আক্রমণ – যার ফলে আজ জাতটার চরিত্রেও কেমন বিচিত্র বিবর্তন ঘটে
চলেছে যাকে সদর্থক বলা মুশকিল।
পরাধীন দেশে কিছু বুদ্ধিমান বাঙালির কুশলতায়
অনুপ্রাণিত বাঙালি “রাখী”, “স্বদেশী” ভাবাবেগ দ্বারা প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে বাংলা ভাগ করার
বিচ্ছিন্নতাকামী সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধিটি শেষমেষ ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিল। ১৯০৫
থেকে ’১১ পর্যন্ত ছ’বছর লেগেছিল বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার হতে। কিন্তু তবু
শেষরক্ষা হল কৈ? ১৯৪৭-এর একটি অভিন্ন রাষ্ট্রের বদলে দুটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নামক
প্রাপ্তিটি এই উপনিবেশে আর যাই হোক শান্তি স্থাপন করতে পারেনি। স্বাধীনতার চরম
মূল্য দিতে হয়েছে পাঞ্জাবকেও। কিন্তু ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের কাঁটাতার শুধু অখণ্ড
বাংলার মানচিত্র নয়, পুরো জাতিটাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানি বাঙালিরা তবু পাকিস্তানি সামরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা
সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল; ছিনিয়ে নিয়েছিল মাতৃভাষা ব্যবহারের
অধিকার এবং পরবর্তীকালে সার্বভৌম রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা অভিন্ন।
কিন্তু বিপদ ঘণিয়ে থাকল ভারতীয় বাঙালিদের ওপর। ওপার বাংলা থেকে সর্বস্ব খুইয়ে আসা
ছিন্নমূল বাঙালিদের চেয়ে কিছু কম করুণ নয় আসামের বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালিদের
কাহিনী, যারা মানচিত্রের ওলট-পালটে নিজেদের জাতিগত ও ভাষাগত পরিচয়টুকু বজায় রাখার
অধিকারও পেল না। স্বাধীন ভারতে জায়গাটার অন্তর্ভূক্তি ঘটল আসাম রাজ্যে। ত্রিপুরাও
মুক্তি পায়নি অনুপ্রবেশের সমস্যা থেকে। তীব্র আদিবাসী বিদ্রোহের কবলে পড়তে হয়েছে পূর্ববঙ্গ
থেকে বহিরাগত বাঙালিদের। হিসাব মতো ভারত ভাগ পাঞ্জাবকে দু-টুকরো করলেও বাঙালিকে
চার টুকরো করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, আসামের বাঙালি, ত্রিপুরার বাঙালি এবং
অবশ্যই প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের বাঙালি। এর মধ্যে স্বাধীন
বাংলাদেশের বাঙালিদের জাতীয়তা সুসংহত হতে
পেরেছে, কারণ জাতিগত, ভাষাগত ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় তাদের অভিন্ন। কিন্তু ভারতীয়
বাঙালিরা উচ্চাঙ্গের ভাষা সংস্কৃতির ধারক হয়েও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে ‘হিন্দুস্তানী’। ভারতের
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দীকে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে হিন্দীভাষীদের চেয়েও বোধহয়
বাঙালি মণীষা ও সহনশীলতার অবদান বেশি। তবু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা
বাংলা, এই সত্য বাংলাদেশীদের সাথে সাথে এদেশীয় বাঙালিদেরও শ্লাঘার বিষয়।
দেশভাগ এবং ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে
তার অভিঘাত:
দেশভাগ
দ্বারা পাঞ্জাব ও বাংলাই সবচেয়ে বীভৎসতার শিকার হয় ঠিকই, তবে দেশের পশ্চিম
প্রান্তে ও পূর্ব দিকে ঘটনাটা ঠিক এক ভাবে ঘটেনি। প্রসঙ্গত, প্রসঙ্গত, বৃটিশ ভারত
থেকে বার্মা ও শ্রীলঙ্কার পৃথক হয়ে যাওয়া বা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের পাকিস্তান
থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দেশভাগের আওতায় পড়ছে না। “The secession of Bangladesh from Pakistan in
1971 is not covered by the term Partition of India, nor is the
earlier separation of Burma (now Myanmar) from the
administration of British India, or the even earlier separation of Ceylon (now Sri Lanka).
Ceylon was part of the Madras
Presidency of British India from 1795 until 1798 when it became a
separate Crown Colony of the Empire. Burma, gradually
annexed by the British during 1826–86 and governed as a part of the British
Indian administration until 1937, was directly administered
thereafter. Burma was granted independence on 4 January 1948 and Ceylon on
4 February 1948”. উপমহাদেশে বাঁটোয়ারা (Partition) বিষয়টা মূলত ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাক সংঘাতের নিরীখেই তাৎপর্যপূর্ণ।
Wikipedia অনুসারে দক্ষ প্রশাসনিক ও ভূততাত্বিক হিসাবে
পরিচিত লর্ড কার্জন ১৯০৫-এ ভাঙলেন “Bengal Presidency, into the Muslim-majority
province of East Bengal
and Assam and the Hindu-majority province of Bengal(present-day
Indian states of West Bengal, Bihār, Jharkhand and Odisha).” লর্ড উইলিয়াম
বেন্টিঙ্কের আমল থেকেই এমন একটা প্রস্তাব নাকি ছিল। হিন্দু বাঙালিরা বিশেষত
মধ্যবিত্ত শ্রেণী একদিকে পূর্ববঙ্গে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের দ্বারা বিপন্ন বোধ করল;
অন্যদিকে বিহারী, ওড়িয়াভাষীদের মোট সংখ্যাগুরুত্বের কাছে অস্তিত্বহীনতার সংকটে ভুগতে
লাগল। স্পষ্টত সেই বঙ্গভঙ্গের প্রবল প্রতিবাদ ধ্বণিত হয় হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে, যার
সাথে কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ‘স্বদেশী’ ও ‘বয়কট’ আন্দোলন জুড়ে গিয়েছিল; জুড়ে
গিয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কল্পিত দেশমাতৃকার সম্মানে রচিত ‘বন্দে মাতরম’ গানটির আবেগ, রবীন্দ্রনাথের ‘রাখি’ সখ্য। কিন্তু ভবি যতদিনে ভুলল,
ততদিনে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবাবেগ যথেষ্ট উস্কে গেছে। “The overwhelming, but
predominantly Hindu, protest against the partition of Bengal and the fear, in
its wake, of reforms favouring the Hindu majority, now led the Muslim elite in
India, in 1906, to meet with the new viceroy, Lord Minto, and to ask for separate
electorates for Muslims. In conjunction, they demanded proportional legislative
representation reflecting both their status as former rulers and their record
of cooperating with the British. This led, in December 1906, to the founding of
the All-India Muslim League in Dacca.” এদেশের মুসলমানদের তখন ইংরেজের কাছে একদা ক্ষমতা
হারানোর ক্ষতিপূরণ এবং তদ্পরবর্তী ব্রিটিশ আনুগত্যের দাম চাই দ্বি-জাতি তত্বের
বিষবৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে। ১৮৫৭র সিপাহী বিদ্রোহ বা ‘অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ’র পর থেকে ইংরেজের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে মুসলিম সমাজের অংশগ্রহণ
বিশেষ পরিলক্ষিত হয় না। মুসলিম ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষালাভে অনীহা থাকলেও ইংরেজ
আনুগত্য ও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিস্পৃহতা বজায় থাকায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মূলত ‘দয়ানন্দ সরস্বতীর ‘আর্য সমাজ’, লোকমান্য তিলকের ‘শিবাজী’ ও ‘গণপতি উৎসব’, বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ ইত্যাদি হিন্দু ভাবাবেগ কেন্দ্রিক রূপ পেতে
থাকে। অন্যদিকে “...Dacca Nawab, Khwaja Salimullah, who hosted the
League's first meeting in his mansion in Shahbag, was
aware that a new province with a Muslim majority would directly benefit Muslims
aspiring to political power.” (বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজাকার
বিরোধী অভ্যূত্থানে শাহবাগ শহরটির চয়নের পশ্চাদ্পটটি তার মানে যথেষ্ট ঐতিহাসিক
তাৎপর্যময়!)। ১৯১১-য় বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নেওয়াটা ভারতীয় মুসলিমরা ভালো চোখে
দেখেনি। ওদিকে জার্মানি ও তুর্কির যুদ্ধকালীন সমঝোতা ব্রিটিশ সরকারের পছন্দ হয়নি। তার
ওপর ব্রিটেন মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমের ওপর তুরস্কর সুলতান বা খলিফার আধিপত্য
সমর্থন না করায় ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের ধর্মীয় নিরপেক্ষতার ওপর আরও
সন্দিহান হয়ে পড়ে। ১৯১৬-র কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ-এর অধিবেশনে একটা পারস্পরিক সমঝোতা
হয়। মুসলীম লীগ জাতীয়তাবাদী কাজে সমর্থন দেবে এবং পরিবর্তে তাদের পৃথক ইলেকটোরেট
মেনে নেওয়া হবে। সুতরাং অখণ্ড বাংলার ধারণাটা মুসলমানদের কাছে বরাবরই সাম্প্রদায়িক
স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। ১৯১৬ সালে লীগের সমর্থক ছিল মোটে ৫০০ থেকে ৮০০-র মধ্যে।
তবে এর তাৎপর্য পরে টের পাওয়া যায়। ঐ অধিবেশনেই মহম্মদ আলি জিন্না নামে এক তরুণ
মুসলিম উকিল মুসলীম লীগের সমর্থক হয়ে পরবর্তী কালে গোটা দেশটার নিয়তির নিয়ামক হয়ে
উঠেছিল। ১৯১৯-এর মন্টেগু চেমস্ফোর্ড সংস্কার (the Government of
India Act of 1919, also known as
the Montagu-Chelmsford Reforms) প্রথম প্রাদেশিক স্তরে পূর্ণ বয়স্ক ভারতীয় পুরুষদের
ভোটাধিকার মেনে নিলেও ভোটারের সংখ্যা ছিল মোট পুরুষ জনসংখ্যার মাত্র ১০%, যার
মধ্যে অনেকেই অশিক্ষিত। তবু সংস্কার হিসাবে ইতিহাসে এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
মুসলিম অভিজাতদের জাতীয় কংগ্রেসে
যোগদানের উদ্দেশ্যও ছিল অভিন্ন ভারতভূমির মুক্তি নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ
সুরক্ষিত করা ও বাকি ধর্ম সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দুদের প্রান্তিক করে দেওয়ার
অভিপ্রায়। মহম্মদ আলি জিন্না মাতৃভাষার চেয়ে ইংরেজীতে স্বচ্ছন্দ হলেও মুসলিম
সম্প্রদায়ের স্বপ্নের যথাযথ রূপকার। আজকে কাঁটাতারের বেড়ার জন্য অশ্রু
অপনোদনকারীরা বোধহয় ভুলে থাকতে চান, একটা সম্প্রদায় চেয়েছিল বলেই ঐ বেড়ার সৃষ্টি হয়েছিল
এবং তা ভারতীয় রক্ত ঝরিয়ে এবং ভারতীয় কোষাগার লঘু করেই।
“পাকিস্তান”, (The Land of Pure) শব্দটি চৌধুরী রহমত আলি ১৯৩৩-এ একটি প্যামফ্লেটে প্রথম
ব্যবহার করেন, যার মধ্যে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা North West Frontier Province (Afghania), কাশ্মীর, সিন্ধ এবং বালুচিস্তানের দাবি ছিল। তখন শব্দটা
তেমন রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু ১৯৩৫-এ Government of India Act, 1935 দ্বারা ‘Provintial Autonomy Headed by Indians’ বা ‘ভারতীয় প্রশাসক
পরিচালিত প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন’ চালু হয়ে ভারতীয় ভোটারের সংখ্যা ৩
কোটি ৫০ লক্ষে উন্নিত হলে মুসলিমরা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, শিক্ষার ভাঁড়ার যে গোল্লা।
ব্স্তুত, Indian provincial elections, 1937-এ মুসলিম লীগ,
মুসলিম অধ্যুষিত ‘ইউনাইটেড প্রভিন্স’-এর ৬৪ খানা মুসলমানদের
জন্য সংরক্ষিত আসনের মধ্যেও কোনও মতে ২৯টা দখল করতে পারে, যেখানে মুসলিম প্রধান
পাঞ্জাব ও বাংলাতে স্থানীয় দলগুলির কাছেও লীগ কোনও প্রতিদ্বন্দিতাই সৃষ্টি করতে
পারেনি। পাঞ্জাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও শিরোমণি আকালি দল-এর সমর্থন নিয়ে সিকন্দর
হায়াত খান নির্বাচন জিতে প্রদেশ সরকার গঠন করে। বাংলায় লীগকে এ. কে. ফজলুল হকের
নেতৃত্বে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়।
অন্যদিকে কংগ্রেস ১৫৮৫-র মধ্যে ৭১৬ টি আসন জিতে ১১টি ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশের মধ্যে ৭টিতে
সরকার গঠন করে। “In UP, where the Congress won, it offered to share power with the League on
condition that the League stop functioning as a representative only of Muslims,
which the League refused.” গোবলয়ে ‘হিন্দী’ বলিয়েদের সঙ্গে সহাবস্থান ? তাও ‘শুধু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব’ করার ঊর্ধ্বে উঠে? –কভি নহি। হিন্দুদের অগ্রগতিতে তথা
হিন্দু প্রধান কংগ্রেসের শাসনে মুসলমানরা নিরাপদ নয়, এই বিশ্বাস সাধারণ মুসলমান
জনমানসে অকারণেই গেঁড়ে বসল বা বসানো হল।
ব্রিটিশ
সরকার কোনও একজন ব্যক্তি নয়। স্বায়ত্ব শাসন দেবার পর ১৯৩৯-এ ভাইসরয় লিনলিথ্গো
সাহেব ভারতীয় নেতাদের সাথে আলোচনা না করেই ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ
ঘোষণা করে দিলেন। দেশে সমস্যার অভাব? তার ওপর যুদ্ধের বোঝা! কংগ্রেসের নেতারা
প্রতিবাদে পদত্যাগ করলেন। মজার খবর, মুসলিম লীগ মহা আনন্দে "Deliverance
Day," (from Congress dominance)উদ্যাপন করল এবং ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধে সমর্থনও জানাল।
লিনলিথ্গোর চোখে গান্ধী আর জিন্নায় প্রভেদ নেই। এরপরে তো জানা ইতিহাস। লাহোরে
অনুষ্ঠিত ১৯৪০-এর মার্চে মুসলিম লীগের তিনদিন ব্যাপি বার্ষিক অধিবেশনের প্রথম দিনই
জিন্না দু ঘণ্টায় দুর্দান্ত ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে ‘দ্বিজাতি তত্ব’ বা Two-nation theory ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন। ঐতিহাসিক ট্যালবট ও সিংহকে উদ্ধৃত করে জানালেন, "Muslims
and Hindus ... were irreconcilably opposed monolithic religious communities and
as such no settlement could be imposed that did not satisfy the aspirations of
the former." অধিবেশনের শেষ দিনে “Lahore
Resolution” বা “পাকিস্তান দাবি”। মুসলমান সংখ্যাধিক্য আছে
এমন অঞ্চলগুলো অর্থাৎ দেশের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের প্রদেশগুলো নিয়ে তৈরি হবে
সার্বভৌম ‘পাকিস্তান’ –পবিত্র ভূমি। তিন দশক আগে গঠিত হলেও মুসলিম লীগ এই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্ত মুসলমানকুলের সমর্থন
পেল।
১৯৪৬-এ নৌ বিদ্রোহ সহ কয়েকটা বিদ্রোহ হয়। ইংল্যান্ডেও লেবার পার্টি
ক্ষমতায় আসে। সুভাষ বসুর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নিয়ে ‘দিল্লী চলো’ বলে দেশকে স্বাধীন করার প্রয়াস বিফল। মানুষটার চরিত্র দেশবাসীর মনে ভূত হয়ে
অনুপ্রেরণা দিলেও নেতাজীর অস্তিত্বের প্রমাণ জাপানে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার পর আর
পাওয়া যায়নি। এই অশান্ত সময়ে টুকটাক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পশ্চিম সীমান্তে লেগেই
ছিল। এর পরেরটা সরাসরি উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত করি, বাঙালিদের বুঝতে সুবিধা হবে, “Jinnah proclaimed 16 August 1946, Direct Action Day, with the stated goal
of highlighting, peacefully, the demand for a Muslim homeland in British India. However, on the morning of
the 16th armed Muslim gangs gathered at the Ochterlony Monument in
Calcutta to hear Huseyn Shaheed Suhrawardy, the League's Chief
Minister of Bengal, who, in the words of historian Yasmin Khan, "if he did
not explicitly incite violence (which) certainly gave the crowd the impression
that they could act with impunity, that neither the police nor the military
would be called out and that the ministry would turn a blind eye to any action
they unleashed in the city..." That very evening, in Calcutta, Hindus
were attacked by returning Muslim celebrants, who carried pamphlets distributed
earlier showing a clear connection
between violence and the demand for Pakistan, and implicating the
celebration of Direct Action day directly with the outbreak of the cycle of
violence that would be later called the "Great Calcutta Killing of August 1946". The
next day, Hindus struck back and the violence continued for three days in which
approximately 4,000 people dead (according to official accounts), Hindus and
Muslims in equal numbers. Although India had had outbreaks of religious
violence between Hindus and Muslims before, the Calcutta killings was the first
to display elements of "ethnic cleansing," in modern parlance. Violence
was not confined to the public sphere, but homes were entered, destroyed, and
women and children attacked. Although the Government of India and the
Congress were both shaken by the course of events, in September, a Congress-led
interim government was installed, with Jawaharlal Nehru as united India's Prime
Minister.” সুরাবর্দি এক সময় বাংলা ভাগের
পক্ষপাতী ছিলেন না; কারণ তাহলে পাটকল সহ অধিকাংশ শিল্পাঞ্চল, কয়লা খনি, কলকাতার
মতো বাণিজ্য কেন্দ্র ও ব্যস্ত জাহাজ বন্দর এগুলো সবই হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম
বাংলায় থেকে যাবে, মুসলমান প্রধান পূর্ব বঙ্গ যেখানে কৃষি ছাড়া শিল্পোৎপাদন নগণ্য
তার অর্থনীতি মার খাবে। ২৪ এপ্রিল ১৯৪৭-এ দিল্লিতে একটা প্রেস কনফারেন্সও করেছিলেন
two-nation theory-র বদলে দেশকে তিন টুকরো করে স্বাধীন বাংলা দেশে একাধিপতিত্ব
করার বাসনায়। কারণ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিহার ও উড়িষ্যা আলাদা হয়ে গেলে সমগ্র
বাংলায় মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জিন্নার মত আদায় করে তিনি দ্বিধান্বিত মুসলিম
নেতাদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্টও হন। যে মুসলিম লীগ ১৯০৬ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত বাংলার
অখণ্ডতার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিল, সেই লীগই মুসলমান
আধিপত্যের গন্ধ পেয়ে ‘অখণ্ড বাংলা’র দাবিদার হয়ে উঠল। শরৎ চন্দ্র বসুর
মতো কংগ্রেসের কোনও কোনও নেতা সুরাবর্দির স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা মেনে নিলেও নেহেরু,
প্যাটেল সহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা মানেননি। অখণ্ড বাংলার উন্নতির স্বার্থে নেতাজীর
দাদা শরৎ বসু সুরাবর্দির সঙ্গে আলোচনা ও চুক্তিও করেন। একদিকে কংগ্রেস নেতারদের
বাংলার অখণ্ডতার প্রতি উদাসীনতা, অন্যদিকে সুরাবর্দির মুসলিম ও অমুসলিমদের পৃথক
ইলেকটোরেট বজায় রাখার অভিসন্ধিমূলক দাবি। শেষ পর্যন্ত শরৎ বসু সুরাবর্দির
মন্ত্রীত্বে বাংলায় হিন্দুদের প্রান্তিক করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র থেকে সরে যান। ওদিকে
চলছে মুসলিম লীগের লাগাতার দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার। বাঙালি হিন্দুদের অবস্থা হল শাঁখের
করাতের মতো। দুরভিসন্ধির আঁচ পেলেন শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা। “The Hindu nationalist party Hindu
Mahasabha under the leadership of Shyama Prasad Mukherjee vehemently opposed it. Their opinion was that the plan is
nothing but a ploy by Suhrawardy to stop the partition of the state so that the
industrially developed western part including the city of Kolkata remains under
League’s control. They also opined that even though
the plan asked for a sovereign Bengal state, in practice it will be a virtual
Pakistan and the Hindu minority will be at the mercy of the Muslim majority forever”. সুরাবর্দি এর প্রতিশোধটাও
নিলেন জমিয়ে। হিন্দু বাঙলিরা মুসলমানদের অধীনে
ও দয়ায় বেঁচে থাকতে যখন রাজি নয়, তখন মরেই যাক। শেষ পর্যন্ত জিন্নার পরামর্শে সুরাবর্দি আহূত ও
পরিকল্পিত ১৯৪৬-এর আগস্ট মাসে কলকাতা তথা সারা বাংলায় হিন্দু নিকেশের ভয়াবহতা খুব
স্পষ্ট ভাবে পাকিস্তান দাবি আর দাঙ্গা যে সমার্থক তা প্রমাণ করল। প্রসঙ্গত, এই হুসেন শাহিদ
সুরাবর্দিই পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে সদ্য গঠিত আওয়ামি লীগে
যোগ দেয় এবং এ. কে. ফজলুল হক ও মৌলানা ভাসামির সাহচর্যে ‘Pan-Bengali United Front alliance’ গঠন করে ১৯৫৪-র নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে বা পূর্ববঙ্গে মুসলিম
লীগকে উড়িয়ে দেয়। ১৯৫৬ সালে ফেডারেল পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে পাকিস্তানের পঞ্চম
প্রধান মন্ত্রীও হন, যাঁকে পাকিস্তানের সামরিক প্রধান আইয়ুব খান পরে বরখাস্ত করে।
অর্থাৎ বিষাক্ত খুনে সাম্প্রদায়িকতাই অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার
হয়ে উঠেছিল। আমাদের ইতিহাসের পাঠ্য-পুস্তকে এই নেতিবাচক দিকগুলো আড়াল করে, ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রামে ও বঙ্গভঙ্গ রদে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত অবদানের কল্পকাহিনী শেখানো
হয়।
ফিরে যাই ১৯৪৬-এ। এই দাঙ্গা আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যে কাটল
দম বন্ধ করা দেড় বছর। পাঞ্জাব ও উত্তরপূর্ব সীমান্তে মুসলমানদের জন্য পৃথক
রাষ্ট্রের দাবিতে লাগাতার দাঙ্গা চলেছে। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে হিন্দু
নিধনের প্রতিক্রিয়ায় বিহারে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ, উইনাইটেড প্রভিন্সের
গড়মুক্তেশ্বরে দাঙ্গা যাতে মূলত মুসলমানদরা আক্রান্ত ছিল, রাওয়ালপিণ্ডিতে হিন্দু
হত্যা –হানাহানির নরককুণ্ড!! ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করে
ব্রিটেনের Labour Party-র সরকার বিদ্ধস্থ। তারা উপনিবেশগুলো বিশেষ করে ভারতের দায়
ঝেড়ে ফেলতে চায়। নাও বাপু স্বাধীনতা। তৎকালীন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটন ক্ষমতা
হস্তান্তর করার জন্য ছ মাসের সময় সীমা দিলেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কংগ্রেসের তরফে
জাতীয়তাবাদী নেতা জওহরলাল নেহেরু ও আবুল কালাম আজাদ, পাকিস্তানের দাবিদার মুসলিম
লীগের তরফে মহম্মদ আলি জিন্না, অস্পৃশ্যতা বিরোধী সম্প্রদায়ের নেতা বি. আর.
আম্বেদকর এবং শিখ নেতা মাস্টার তারা সিং "Mountbatten Plan" মেনে দেশভাগে মত দিলেন। জিন্না ছাড়া বাকিরা মূলত দাঙ্গা থামাতেই দেশ
ভাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা মেনে নিলেন। কিন্তু Radcliffe Line-এর ঘোষণা মাত্র ভয়াবহতা
দুঃস্বপ্ন ছাড়িয়ে গেল। ট্যালবট ও গুরুহরপাল সিং-এর মতে অনেক জায়গায় দেখা দিল Genisidal
tendency; অপর
সম্প্রদায়ের পুরো প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ণ করে দাও, প্রজনন রোধ করো। “The catalogue of horrors
includes the disemboweling of pregnant women, the slamming of babies' heads
against brick walls, the cutting off of victims limbs and genitalia and the
display of heads and corpses. While previous communal riots had been deadly,
the scale and level of brutality was unprecedented.”
পাঞ্জাব ও পশ্চিম বাংলায়
ভিন্ন পরিস্থিতি:
ভৌগোলিক অবস্থানের জেরে পাঞ্জাবের লাহর,
রাওয়ালপিণ্ডি, মুলতান ও গুজরাট হিন্দু প্রধান অঞ্চল হলেও ভাগাভাগিতে চলে যায়
পাকিস্তানে; যার ফলে সেখানকার হিন্দু ও শিখরা খুব কমই প্রাণ নিয়ে র্যাডক্লিফের
এপারে আসতে পেরেছিল। অন্যদিকে অমৃতসর, লুধিয়ানা, গুরুদাসপুর ও জলন্ধর মুসলিম
অধ্যুসিত হওয়া সত্তেও থেকে যায় ভারতীয় পাঞ্জাবে। যথারীতি সেখানে মুসলমানরা
আক্রান্ত হয় ও কিছু পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। ওদিকে মালদা, মুর্শিদাবাদ মুসলিম
প্রধান হয়েও পশ্চিমবঙ্গে পড়ে। আর খুলনা হিন্দু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধ প্রধান
হলেও চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানে।
দেশভাগের
৩.৬ বছর পর পাকিস্তানের ১৯৫১-র সেনসাস দাবি করেছিল ঘরছাড়া ৭২,২৬,৬০০ জন মানুষের
সবাই ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমান। আর ১৯৫১-র ভারতীয় সেনসাস অনুসারে ৭২,৯৫,৮৭০
জন হিন্দু ও শিখ পাকিস্তান থেকে এদেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসে। ব্যাপক জনসংখ্যা
বিনিময় (population
exchange)-এর পরিস্থিতিটা পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে এক ছিল না।
দাঙ্গার সময় ভারতীয় পাঞ্জাবে হিন্দু-শিখ শরণার্থী এসেছিল প্রায় ৪৭ লক্ষ, যেখানে ৬৫
লক্ষ মুসলিম পাঞ্জাব থেকে পাকিস্তানে চলেও যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব
পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আসে ২৬ লক্ষের বেশি আর যায় মাত্র ৭ লক্ষ। সুতরাং
পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয় অনেক বেশি। অন্যদিকে হিন্দু সিন্ধিদের সাথে
হিন্দু বা মুসলমান কারোরই বিশেষ বিরোধ ছিল না। তবু মুসলিম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে
৭,৭৬,০০০ হিন্দু সিন্ধি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসে। তারা
সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পাকিস্তান ১৯৯৮ সেনসাসের দাবি তখনও
ওদের সিন্ধু প্রদেশে ২২.৪ লক্ষ হিন্দু সিন্ধি নাকি রয়ে গেছে, যেখানে ২০০১-এর ভারতীয় সেনসাস জানাচ্ছে ভারতে
সিন্ধির সংখ্যা ২৫.৭ লক্ষ। বাস্তব সত্য হল, সীমান্তের ওপারে হিন্দু সিন্ধিরা ক্রমশ
সংখ্যায় কমছে যাকে ‘minority in decline’ বলা যায়।
কত অগুণতি মহিলা যে ধর্ষিত, খুন ও
লুঠ হয় তার সামান্যই নথিভুক্ত করা গেছে। ভারত থেকে ১৯৪৯ সালে যদিও বা ১২,০০০
মুসলিম মহিলাকে উদ্ধার করা গেছে, পাকিস্তানে উদ্ধার হয় মাত্র ৬০০০ হিন্দু ও শিখ
রমণী। এটা সরকারি সূত্রের হিসাব। সংখ্যাটা ১৯৫৪ সালে গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২০,৭২৮
ও ৯,০৩২। পরিবার ফিরিয়ে নেবে না অশঙ্কায় অনেক মহিলাই, বিশেষত হিন্দু মেয়েরা ‘দেশে ফেরা’র পথও খুঁজে পায় না।
দেশভাগের আগে থাকতেই পশ্চিম
সীমান্তে পাকিস্তানের দাবিতে লাগাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য জন-বিনিময়টা
কিছুটা অনুমান করা গিয়েছিল। তাই দিল্লি ও পাঞ্জাবে শরণার্থী পুনর্বাসন দেওয়ার
কাজটা তুলনায় সচল ছিল; ঘর পালানো মুসলমান এলাকায় পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের
জায়গা দেওয়া গিয়েছিল। যদিও দেশভাগের জন্য আকস্মিক জনসংখ্যার ভারও দিল্লিকে নিতে
হয়েছিল। ১৯৪১-৫১ এই এক দশকে দিল্লির জনসংখ্যা ৯,১৭,৯৩৯ থেকে
১৭,৪৪,০৭২ হয়ে যায়। পুরানা কিলা, লালকেল্লার মতো ঐতিহাসিক সৌধের পাশাপাশি কিংসওয়ের
মিলিটারি ব্যারাক শরণার্থীতে ছেয়ে যায়। তাদের যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে, যথেষ্ট অর্থ
ব্যয় করে লাজপত নগর, রাজিন্দর নগর, নিজামুদ্দিন, পাঞ্জাবি বাগ, গুংপুরা ও কিংস্ওয়ে
ক্যাম্প এলাকায় পুনর্বাসন দেওয়া হয়। মোটামুটি এক বছরের মধ্যে পাঞ্জাব-দিল্লিতে
উদ্বাস্তু স্রোত থিতু হয়। অন্যদিকে বঙ্গে দাঙ্গাটা মূলত কলকাতা ও নোয়াখালিতে
কেন্দ্রীভূত ছিল। আর গরম হাওয়ার আঁচ পেয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে দেশভাগের আগেই সম্পন্ন
হিন্দুরা এপারে চলে আসছিল। কিছু মুসলিম পরিবারও যে ওপারে যায়নি তা নয়। পড়েছিল
কৃষিজীবী ও শ্রমিকের দল। তাই ১৯৪৭-এ পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর জন্য কেন্দ্র
বা রাজ্য কারোরই তেমন প্রস্তুতি ছিল না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অভাবে পশ্চিমবঙ্গ,
আসাম ও ত্রিপুরায় উপর্যুপরি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায় রাজ্য
সরকারগুলি। আন্দামানে ও পতিত ভূমির দণ্ডকারণ্যেও চলে যেতে হয় কিছু শরণার্থীকে। নদিয়া,
২৪ পরগণা ও কলকাতার আশেপাশে গজিয়ে উঠতে থাকে জবরদখলি এলাকা। ঘটি বাঙালের অম্ল-মধুর
ঝগড়ার সম্পর্কে ক্রমশ তিক্ততা জমে উঠতে লাগল।
The second
partition of Bengal left behind a legacy of violence which continues to this
day. As Bashabi Fraser put it, "There is the reality of the continuous
flow of 'economic migrants' / 'refugees' / 'infiltrators' / 'illegal
immigrants' who cross over the border and pan out across the sub-continent,
looking for work and a new home, setting in metropolitan centers as far off as
Delhi and Mumbai, keeping the question of the Partition alive today”. এক ধাক্কায়
আশ্রয়প্রার্থী যা এসেছিল, ভাগাভাগির পর তিনদশকে তার চেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে।
এপারে আত্মীয় পরিচিতের মাধ্যমে অনুপ্রবিষ্টরা স্থিতিও লাভ করে। মুশকিলে পড়ে
নমশূদ্ররা ও কৃষিজীবীরা, যাদের স্থাবর ভূমি বা ভাগচাষের কাজ ছাড়া কোনও সম্পদ ও
দক্ষতা ছিল না। তারা ১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তানে আবার আক্রান্ত হয় ও হতেই থাকে।
নমশূদ্র যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল জাতপাত বৈষম্যের প্রতিবাদে হিন্দু হয়েও পাকিস্তানের
দাবি সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তানের স্বরূপ চোখে পড়তে প্রধানমন্ত্রী
লিয়াকত আলি খানের কাছে পদত্যাগ-পত্র দিয়ে ক্যাবিনেট মিনিস্টারের পদ ছেড়ে ভারতে এসে
আশ্রয় নেন। যখনই পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক হামলার মুখে পড়েছে, তখনই খেপে খেপে
হিন্দুরা কাঁটাতারের এপারে এসেছে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে। শুধু হিন্দু নয়, মুসলমান ও
অন্যান্য সম্প্রদায়ও অর্থনৈতিক সুবিধা ও
অন্যান্য কারণে ক্রমান্বয়ে অনুপ্রবেশ করে পশ্চিম বংলার ভূমি ও অর্থনীতি সবই সংকটে
ফেলে দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গীয়
বাঙালীরা রিফিউজির মুখে জমিদারির গল্প শুনতে শুনতে নিজেদের জমি জিরেত জবর দখল হতে
দেখেছে। ওপার থেকে আসা সবর্হারা বাঙালীরাই অবৈধ ভোটাধিকার লাভ থেকে ক্রমশ
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে। আবার যারা সম্পদ স্বজন
হারিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল একদিন, তারাও এখন বেশিরভাগ হামলাকারীদের প্রতি আক্রোশ
ভুলে ওদেশবাসীদের জন্য আবেগসিক্ত হয় আশ্রয়দাতা ‘এদেশী ঘটি’দের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে। স্বাধীনতা ও
দেশভাগের ষাঠ বছর পরেও ঠাকুরদার ঠাকুরদার আমলে তাড়া খেয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে
আসা পরিবারের এদেশে জন্মানো এ প্রজন্মের সন্তান দেশের বাড়ি বলতে বোঝে বাংলাদেশর
কোনো গ্রাম বা শহরকে; বিশ্বাস করে ‘এদেশী’রা অতিথি সৎকার, রান্নাবান্না, ভদ্রতা
কিছুই জানে না। এদেশে খেয়ে পরে, উপার্জন করে সম্পত্তির মালিক হয়ে, এদেশের মাটিতে
ত্যাজ্য-বর্জ্য ত্যাগ করেও ‘ওরা এদেশী’ নয় বরং ‘এদেশী’দের প্রতি গভীর তাচ্ছিল্যপ্রবণ। কারণ এদেশী
হিন্দু বাঙালি আত্ম-সমালোচনা করে, অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, কিন্তু পরধর্ম
পর-সংস্কৃতির প্রতি অহেতুক শ্রদ্ধা না দেখালে নিজেদের উদার শিক্ষিত প্রগতিশীল বলে
পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। ‘এদেশী’ বা ‘ওদেশী’, যারা বেশি বেশি উদার তারা বাংলাদেশী
অনুপ্রবেশ নয় ‘হিন্দী’র আধিপত্যকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। যারা
অন্যরকম উদার, তারা বাংলায় হিন্দীর মিশেল না দিয়ে কথা বলতে পারে না। বড় বিচিত্র,
স্ববিরোধী ও বিভ্রান্তিকর এই দ্বন্দ্ব! অখণ্ড বাংলার আবেগ ভুলতে না পেরেই ভারতীয়
বঙ্গভূমি ‘পশ্চিমবঙ্গ’, যেখানে ভারতীয় পাঞ্জাব ‘পূর্ব পাঞ্জাব’ নয়, শুধু পাঞ্জাব।
দেশের অর্থনীতি ও
পরিষেবাগত প্রভাব
র্যাডক্লিফ লাইন বাংলায় একটা অবিমিশ্র অর্থনৈতিক অঞ্চলকে দুটুকরো করে দিল, যে
দুটো টুকরো একে অপরের পরিপূরক ছিল। উর্বর আবাদি জমির সিংহ ভাগ চলে গেল পূর্ববঙ্গে
যা ধান ছাড়াও পাট ও অন্যান্য কাঁচামাল উৎপাদন করত। সেই মাল পশ্চিমাংশ ব্যবহার করে শিল্পদ্রব্য
সরবরাহ করত পূর্বাঞ্চলে। বাঁটোয়ারার পর পশ্চিমবঙ্গে দেখা দিল খাদ্যশষ্য ঘাটতি। এই
ঘাটতি চলেছিল ১৯৫০ থেকে ’৬০
পর্যন্ত এক দশক ধরে। ১৯৫৯-এ বার্ষিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯,৫০,০০০ টন। ‘মা ফ্যান দাও’ –!!!
কলকাতায় চলত বু্ভূক্ষুর মিছিল। রেশন চালু করেও কান্না থামানো যায়নি।
আবার পশ্চিম দিকে পাটকল, পূর্ব দিকে ৪/৫ অংশ পাট চাষের জমি।
পাকিস্তান পূর্ব দিকে পাটকল স্থাপন করে ভারতে পাট রপ্তানি করা বন্ধ করে দিল।
পশ্চিমবঙ্গের পাটকল ও শ্রমিকরা তো সংকটে পড়লই, পূর্ববঙ্গেও উৎপন্ন পাটের বাজার
বন্ধ হয়ে গেল, কারণ পশ্চিমবঙ্গে পাট রপ্তানি করা মানে দেশদ্রোহিতার। পশ্চিমবঙ্গ
পঞ্চাশের দশক থেকে পাট ঊৎপাদন বাড়িয়ে কলগুলো সচল করে তুলল। ১৯৬১-তে ৯,১৭,০০০
হেক্টর জমিতে ১১,৪৪,৪০০ মেট্রিকটন পাট উৎপাদন করা গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্য
এর চেয়ে কম জমিতে (৮,৩৪,০০০ হেঃ) উন্নত মানের আরও বেশি পাট উৎপন্ন হয়েছিল
(১৩,১৪,৫৪০ মেঃটন)। পাট শিল্প যদিও বা সাময়িক সংকট কাটিয়ে উঠল, পূর্ববঙ্গ থেকে
আমদানি করা চামড়া ও বাঁশের অভাবে চর্মশিল্প ও কাগজ কলগুলো পড়ল বিপদে। তীব্র খাদ্য
সংকট, উদ্বাস্তু সমস্যায় এই বাংলা যখন বিধ্বস্ত, তখন ডঃ বিধান চন্দ্র রায় জওহরলাল
নেহেরুর সহযোগিতায় একাধিক বহুমুখী প্রকল্পের সুবিধা পশ্চিমবঙ্গে আনলেন। DVC, ময়ূরাক্ষী
প্রকল্প, দুর্গাপুর শিল্পনগরী স্থাপন, সল্টলেক নগরী, কল্যাণী। কিন্তু বৃটিশ ভারতে
শিল্পে দেশের প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য পরবর্তী তিন দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতায়, অনুপ্রবেশে,
সংঘর্ষে, বন্ধ্ সংস্কৃতির জেরে ক্রমশ অন্যান্য রাজ্যগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়তে
লাগল, যে নিম্নগতি আজও অব্যাহত। অবনতির কারণ হিসাবে কয়লার মাসুল সমীকরণ নিয়েও
রাজনৈতিক চাপান-উতোর আছে। নীরোদ চন্দ্র চৌধুরীর “আত্মঘাতী বাঙালী” কথাটা ফেলে দেবার
মতো নয়। অন্যদিকে জেলা সদর হওয়া ছাড়া ঢাকায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ছিল না। পূর্ব
পাকিস্তানের সরকারি দ্প্তরেও আসীন ছিল অধিকাংশ ইংরিজি শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি। তারা
এপারে চলে আসাতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রশাসনিক দপ্তরগুলো কব্জা করে বসল। সেই জোরে
বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিল উর্দু শিক্ষার বাধ্যবাধকতা। ওপারের বাঙালি দেখল, তারা
আদৌ স্বাধীন হয়নি। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠল যার ফলশ্রুতি মাতৃভাষার দাবিতে আর
এক প্রস্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। পূর্ববঙ্গকে সাহায্যের জন্য তাকাতে হল সেই ভারতের
দিকে, যাকে রক্তাত্ত করে কয়েক দশক আগে সে বেরিয়ে এসেছে এবং ক্রমাগত হিন্দু খেদিয়ে,
অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, বাণিজ্য সম্পর্ক ত্যাগ করে তখনও যত ভাবে পারা যায় তার ওপর
অশান্তি বর্ষণ করে চলেছে।
শুধু তো অর্থনীতি নয়, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান
হয়ে যাওয়ায়, রেল ও সড়ক পথ বিপর্যস্ত হয়ে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত ভারতের কেন্দ্রীয়
ভূখণ্ড থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কলকাতা-শিলিগুড়ি, আসাম-চট্টগ্রাম রেল পথ
রুদ্ধ হয়ে গেল। আসাম তো ভারতীয় রেলসংযোগ ব্যবস্থার বাইরেই চলে গেল। চা, কাঠ সহ
বিভিন্ন পণ্য পরিবহন বন্ধ। আসামের চা শিল্পে ব্যবহৃত হোত চট্টগ্রামের কয়লা।
পাকিস্তান পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের কাছে চড়া মাসুল ধার্য করল। ১৯৫০-এর মধ্যে
যদিও বা শিলিগুড়ির মাধ্যমে আসামকে রেলপথে জুড়ে দেওয়া গেল, চা রপ্তানির জন্য কলকাতা
বন্দর পৌঁছনো যথেষ্ট ব্যয়-সাপেক্ষ হয়ে উঠল। চট্টগ্রাম বন্দর বিকল্প হিসাবে কিছুদিন
ব্যবহৃত হলেও ১৯৬৫-র যুদ্ধের পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান
বাংলাদেশ-এ রূপান্তরিত হয়, কিন্তু ‘কৃতজ্ঞ’ বাংলাদেশ ২০০৩-এর আগে তার ভূখণ্ডে ভারতের কোনও রেলপথ
মঞ্জুর করেনি। আজকের তারিখেও ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর, আসামের বরাক উপত্যকা
ইত্যাদি অঞ্চলে যোগাযোগের যথেষ্ট সংকট রয়ে গেছে। যে দেশটাকে আমরা স্বাধীন করলাম,
রেলপথ নির্মাণের অনুমতির জন্য আজও আমরা তার অনুমতি ও অনুকম্পার মুখাপেক্ষী। ’৪৭-এর পর
উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোর বাড়-বাড়ন্তের পেছনে এই আহত
পঙ্গুকৃত যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেকটা দায়ী।
পূর্ব-পাকিস্তানে মাতৃভাষা
আন্দোলন ও ভারতে তার প্রভাব
কাঁটাতারের বেড়া
উপমহাদেশবাসীর অনাহূত নয়। একটা সম্প্রদায় ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে ভারতের ভাগাভাগি
চেয়েছিল এবং লাগাতার দাঙ্গায় লিপ্ত ছিল। পাঞ্জাবের সীমান্তে আগুন, জিন্নার
প্রেরণায় সুরাবর্দীর পরিকল্পিত “"Great Calcutta Killing of August 1946”-এর বিভীষিকা প্রত্যক্ষদর্শীরা
স্মরণ করলে শিউরে ওঠেন। শান্তি স্থাপনের তাড়ায় অখণ্ড ভারতভূমির স্বাধীনতাকামীদের
নতিস্বীকারমাত্র যেন জমানো বারুদে আগুন আগল। দাঙ্গা বন্ধ হওয়ার বদলে দাবানলের মতো
ছড়িয়ে পড়ল। মুসলিম রাষ্ট্র থেকে প্রাণ বাঁচাতে কাতারে কাতারে হিন্দু
বাস্তুস্বজনহারা হয়ে ভারতে এল। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ থেকেও মুসলমানরা তৎকালীন
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে বিতাড়িত হয়েছিল। কিন্তু ধর্মগত ঐক্যের ভরসায় দেশভাগ যে
বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে মঙ্গল হয়নি তা তারা অবিলম্বে টের পেল। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও
অসহিষ্ণুতা একমুখী নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মতো ধ্বংসাত্মক যা ক্ষুদ্রকে ক্ষুদ্রতর
ক্ষুদ্রতম অংশে ভেঙেই চলে। বাঙালিদের
সঙ্গে বাংলাদেশের পাকিস্তান-পন্থী বিহারি মুসলমানদের সংঘর্ষ এখনও হয় (১৫..৬.১৪,
স্টেসট্ম্যান)। বিহারি মুসলমানরা নিজেদের পাকিস্তানি মনে করে ও পাকিস্তানেই বসবাসের
অধিকার চায়। পাকিস্তান সরকার তাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে
ব্যবহার করেছিল মাত্র, কিন্তু পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। ফলে মার খাওয়া
বিহারি মুসলমানরা মাঝপথে গৌরী সেনের ভারতেই আস্তানা গাড়ছে এবং নানা সামাজিক অপরাধ
ছাড়া নাশকতাতেও নিজেদের সাম্প্রদায়িক অবদান রেখে চলেছে, কারণ তারা এখনও কয়েক
প্রজন্ম পরেও মনেপ্রাণে পাকিস্তানি।
বাহান্নর আন্দোলনের উপলক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার
প্রশ্নে নিজাউদ্দিনের একটি উক্তি, “উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। ১৯৫২ সালের ২৬শে
জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় এই ঘোষণার পর
থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ধ্বণিত হতে থাকে। এর আগে ১৯৪৮ সালেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রভাষা কমিটি’র উদ্যোগে ৩০শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্রসভা
অনুষ্ঠিত হয় ও ধর্মঘট পালিত হয়। ঐদিন বার লাইব্রেরির হলে আতাউর রহমান খানের
সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ‘সর্বদলীয়
রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি প্রথম সভাতেই স্থির করে
২১শে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসাবে পালন করবে। অমনি
জারি হয় ১৪৪ ধারা। আন্দোলনে গতি প্রবল হয়। একদিকে আইন, পুলিস-প্রশাসনের বল প্রয়োগ,
আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি অন্যদিকে মুসলিম লিগের হামলা, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ,
মানবাধিকার হরণ। এই পরিস্থিতিতেই কৃষক, ছাত্র, শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলন এবং চরম
নির্যাতনের মুখে পড়া। ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থান আসলে বিগত চার বছর ধরে জমাট
বাঁধা ক্ষোভেরই বিস্ফোরণ।
ঢাকায় স্থাপিত সাভার বা শহিদ-স্মৃতিস্তম্ভ সশ্রদ্ধায় স্মরণ
করিয়ে দেয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ রফিউদ্দিন অহমেদ (জন্ম ১৯২৬), মোহাম্মাদ
সালাউদ্দিন (২৬), আবদুল জব্বার (৩০), আব্দুল বরকত (২৫), শফিউর রহমান, সালাম, এমনকি
আবদুল আওয়াল নামে এক রিকশা চালককেও। শহিদের তালিকায় হিন্দু নাম দুষ্প্রাপ্য হলেও
হিন্দুস্তানকে কিন্তু নিতেই হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা উভয় সম্প্রদায়
মানুষের বাড়তি চাপ। পশ্চিমবঙ্গে ভাষা আন্দোলনকারীদের আস্তানাও ছিল, জনমানসে
সমর্থনও ছিল, বিপন্নদের জন্য আশ্রয়ও ছিল।
১৯৬৫-তে প্রথম ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। স্বাধীনতা লাভের
পর ১৯৭২-এ ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদ্যাপিত হয়। ঐ তারিখটির আন্তর্জাতিক
মর্যাদার দাবিদারও স্বাধীন বাংলাদেশের গফরগাঁও। ১৯৯৮ সালের ২১শে মার্চ কানাডা
প্রবাসী রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আন্নানের কাছে “আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস”এর দাবিতে এক পত্র লেখেন। ঐ পত্র সাক্ষর করেন সাতটি জাতি ও
ভাষার দশজন সদস্য। এলবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল (ফিলিপিনো), জাসেন মোরিন ও
সুজান হডগিন্স (ইংরেজি), ডঃ কেলভিন চাও (ক্যান্টনিজ), নাজনীন ইসলাম (কাচি), রিনাতে
মার্টিন্স (জার্মান), করুণা যোগী (হিন্দী) এবং রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম
(বাংলা)। ১৯৯৯-এর ৩রা মার্চ ইউনেস্কোর সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের সচিব আন্না মারিয়া
মেজলোক রফিকুলকে লেখেন “Regarding your request to declare the 21st
February as International Mother Language Day, the idea is indeed very
interesting.” কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে বিষয়টি উত্থাপনের কোনও সুযোগ নেই,
ইউনেস্কোর পরিচালক কোনও সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে উত্থাপন করতে হবে। পরে প্যারিসে
ইউনেস্কোর অধিবেশনে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিনিধি দলের নেতা ১৯৫২-র ভাষা
আন্দোলনের মাহাত্ম ১৮০টি দেশের সামনে তুলে ধরেন, বিভিন্ন দেশের শিক্ষমন্ত্রীদের
সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারি “আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস” হসাবে স্বীকৃতি লাভ করল বলতে গেলে বাংলাদেশের একক
প্রচেষ্টায়। বিষয়টির প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরব; আর সমর্থক ছিল
ভারত, ওমান, বেনিন, হন্ডুরাস, শ্রীলঙ্কা, মিশর, রাশিয়া, বাহমাস, ডোমিনিয়ন রিপাবলিক
অব বেলারুশ, ফিলিপিনস্, আইভরি কোস্ট, গাম্বিয়া, সাইক্লোনেসিয়া, ভেনেজুয়ালা,
ইন্দোনেশিয়া, ইটালি, পাপুয়া নিউগিনি, কমোরস, ইরান, লিথুয়ানিয়া, সিরিয়া এমনকি
পাকিস্তান। ভাষার প্রশ্নে নৈতিক সমর্থন ছাড়া বাড়তি সাহায্য দেওয়ার উপায় নেই
বহুভাষাভাষীর দেশ ভারতবর্ষের, যেখানে “ইন্তি ওড়িকা, তামিল বাড়কা” অর্থাৎ ‘হিন্দী নিপাত যাক,
তামিল দীর্ঘজীবী হোক’ বলে তীব্র আবেগে নিজের দেহে অগ্নিসংযোগ করে আত্মাহূতি দেয়
ভারতীয় যুবক।
অন্যদিকে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার
পেছনে বাঙালির অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশি। নেতাজীর কথা তো বাচ্চারাও জানে, রামমোহন
রায়ের উদ্যোগে আধুনিক মান্য হিন্দী পত্রিকার সূচনা হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত
গ্রন্থাগারে ছিল একাধিক হিন্দী পুস্তক যেগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। জাতীয়
সংহতির কথা ভেবে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষাভাষী বাঙালিরা যেখানে হিন্দীকে সংসদের
ভোটাভুটিতে এক ভোটে জিতিয়ে দেয়, হিন্দীর আধিপত্যে বাংলা সংস্কৃতিকে আক্রান্ত হতে
দেখলে তাদের বুকে একটু বাজবে এটা তো স্বাভাবিক। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাজাতিক
স্বীকৃতির মধ্যে এপারের বাঙালিরাও গর্বিত বোধ করে। গর্ববোধ শুধু ভাষাগত সাদৃশ্যের
কারণে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরির জন্য যে ত্যাগস্বীকার, রক্তক্ষয় ও অর্থনৈতিক
সংকট ভোগ করতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতবর্ষকেই, তাতে এই সাফল্যে গর্বিত হওয়ার
ন্যায়সঙ্গত অধিকার আমাদের আছে। পররাষ্ট্রের প্রতি এই একাত্মবোধ অনেক সময় আমাদের
জাতীয়তাবোধকেও বিভ্রান্ত করে ফেলে। এই দ্বন্দ্ব, এই যন্ত্রণা শুধু ভারতীয়
বাঙালিদের, যারা একদিকে বারবার প্রাদেশিকতার শিকার হয়, অন্যদিকে সীমান্ত
অনুপ্রবেশে জর্জরিত থেকে যায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি।
বাংলার মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আত্মঘাতী অবদান
দেশ ভাগাভাগিতে চুকেবুকে যায়নি। মৌলবাদী হানা প্রতিনিয়ত আরও
ভাগভাগিতে মত্ত যদিও লক্ষ্য আরও বেশি জমির দখল। ‘মুসলিম লীগের আসনে
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, কলকাতায় ও তার আভিঘতে নোয়াখালি সহ বাংলা জুড়ে ১৯৪৬-এ হিন্দু
নিধনের রূপকার অক্সফোর্ড স্নাতক হুসেন শাহিদ সুরাবর্দি দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে
গিয়ে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে ‘আওয়ামি লীগ’এ যোগদান করে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের
মাটিতে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেন ও বাঙালিয়ানার কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন। আগেই উল্লেখ
করেছি এই ইতিহাস। সাধারণ নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েও আইয়ুব
খান দ্বারা বরখাস্ত হন। ভাষাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমের মূলত পাঞ্জাবী মুসলমান ও
পূর্বের বাঙালি মুসলমানদের পারস্পরিক বিদ্বেষ বাড়তেই থাকে। ভাষা আন্দোলনে পূর্ব
পাকিস্তানিদের জয় উর্দুপন্থী (যদিও মুষ্টিমেয় সুশিক্ষিত ছাড়া অধিকাংশ পশ্চিম
পাকিস্তানির ভাষা হয় বিহারি ঘেঁষা হিন্দী নয় পাঞ্জাবী) পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে এক
বড় ধাক্কা। ভারতীয় সেনা শিবিরে তৈরি ভারতীয় ভাষার কাঠামোয় আরবি-ফারসির তকমা লাগানো
ভারতীয় ভাষাই তাদের কাছে ইসলামিক সংস্কৃতির পরিচায়ক, ন্যায্য উত্তরাধিকারী।
বঙ্গালী আবার মুসলমান নাকি? অবদমন, অত্যাচারের ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে।
নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের পূর্ব
পাকিস্তান ছেড়ে ভারতমুখী আশ্রয়লাভের স্রোতও। ভাষার কারণে নতুন দেশাত্মবোধ জেগে ওঠা
বাঙালি বাধ্য হয়ে শামিল হয় আর একবার ভাগাভাগির সংগ্রামে। বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা
কেবলই আরও আরও ছিন্ন-বিচ্ছিন্নতার দিকে এগোয়। স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে
আহূত অনেক অতিথিদেরই গর্ব করে বলতে শুনি, “আমি মুক্তি যুদ্ধ করেছি।
আপনাদের সোদপুরেও আমাদের ঘাঁটি ছিল”। লুকোনোর উপায় নেই, অস্বীকাকেরও পথ নেই। তৎকালীন ভারতীয়
প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রসংঘের কাছে বারবার আবেদন করে জানান, ভারত যুদ্ধ চায় না।
প্রতিদিন লক্ষ-লক্ষ শরণার্থী, ভেঙে পড়া অর্থনীতি, উপচে পড়া শরনার্থী শিবিরে
হাহাকার – পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘ
কোনও সদর্থক হস্তক্ষেপ করেনি। সম্ভবত সাদা চামড়ার প্রভূরা আমাদের খেওখেয়ির দিকে
তাকিয়ে মজা দেখছিল, বুঝুক কালা আদমিরা স্বাধীনতায় কত সুখ! উত্তাল সত্তর; আবার
লোকক্ষয়, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, হরণ। ভারতীয় জওয়ানরা তাদের মহিলা প্রথানমন্ত্রীর মান
রাখতে নারী নির্যাতন থেকে বিরত থাকলেও পাকিস্তানি জওয়ানদের তো কোনও প্রতিশ্রুতি
রাখার দায় ছিল না। তাছাড়া যুদ্ধের কিছু অবশ্যম্ভাবী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকেই। “মেরা ভারত মহান”এ সবার জন্য দরজা
খোলা। কাঁটাতার? সে তো লঙ্ঘনের জন্যই, মানবতার খাতিরেও, আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে
অনুপ্রবেশ ঘটাতেও। আপাত জয় হল ভারতের, স্বাধীন বাংলাদেশের; কলকাতা রেডিও থেকেই
প্রথম ঘোষিত হল, “জয় বাংলা”!! ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটিকে রাষ্ট্রীয় নারা মেনে নেওয়ার মধ্যে ভারতীয়
বাঙালি মণীষা যদি একটু আহত হয়ে থাকে, ‘জয় বাংলা’ যেন সেই আঘাতে
একটা ওষধি-প্রলেপ।
কিন্তু আমরা কী পেলাম? আমরা, ভারবাসী, পশ্চিমবঙ্গবাসী? একটি
শত্রু রাষ্ট্রের কাছে চিরশত্রুতার অঙ্গীকার। আরও স্পষ্ট করে বললে একটির বদলে দুটি
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্পষ্ট ও গোপন শত্রুতা। সাংস্কৃতিক দৌত্য করতে ওপার বাংলায়
ঘুরে আসা ইন্টালেকচ্যুয়াল ভারতীয় বাঙালি শাখ দিয়ে মাছ ঢাকতে ব্যস্ত। হিন্দীর
আধিপত্যই নাকি বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শত্রু, বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে আসা
সন্ত্রাসবাদী বা অনুপ্রবেশকারীরা নয়; ভারতের বুকে পররাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন বা
জয়ধ্বণিও নয়, এমনকি একের পর এক হামলায় প্রাণহানি ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি দুষ্কৃতিদের
নিরাপদে আশ্রয়গ্রহণও নয়, সম্ভবত আজকে মেয়েদের ওপর সংঘটিত অপরাধে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের
দ্বিতীয় স্থানাধিকারও নয়, ঘটনাগুলোর নজির-বিহীন নৃশংসতা তো নয়ই। আমাদের সাহিত্যসভা
মন্দ্রিত করে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ যখন সদর্পে ও আবেগকম্পিত স্বরে ঘোষণা করে, “যতদূর বাংলা ভাষা
ততদূর আমার বাংলাদেশ”। আমরা শুনে আপ্লুত হই। আমাদের ভাষাগত পরিচয়, জাতীয় পরিচয়ের
সাথে সচেতনভাবেই সংঘাত করে; আর আমরা নিজেদের উদারতা প্রদর্শনের নেশায় নিজেদের আত্মবিস্মৃতিতে
নিজেরাই অভিভূত হই।
প্রসঙ্গত অনুপ্রবেশের একটা খতিয়ান দিলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনামূলক সংকটাপন্ন অবস্থাটা পরিস্কার হয়।
Year
|
Reason
|
Number in lakhs
|
1947
|
Partition
|
3.44
|
1948
|
Hyderabad annexation by India
|
7.86
|
1950
|
Barisal
riots
|
15.75
|
1956
|
Pakistan becomes Islamic Republic
|
3.20
|
1964
|
Riots over Hazratbal incident
|
6.93
|
1971
|
Bangladesh
liberation war
|
15
|
The 1951 census in
India recorded 2.523 million
Refugees from East Bengal. Among them 2.061
million
settled in West Bengal. The rest went to
Assam, Tripura and other states. By 1973 their
number reached over 6 million. The following
shows major waves of refugee influx and the cause of
each.
অন্যদিকে 1951 census in Pakistan recorded 671,000
refugees in East Bengal, the majority of which came from West Bengal. Rest were from Bihar. By 1961 the numbers reached 850,000.
Crude estimates suggest that about 1.5 million Muslims migrated from West
Bengal and Bihar to East Bengal in two decades after partition.
একটি বিশ্বস্ত
সূত্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী “During Bangladesh
liberation war 11 million people from both communities took shelter in India. After the
war 1.5 million decided to stay.”
আসামের প্রাদেশিকতায় বিপন্ন বাঙালি
বাংলাদেশবাসী কিছু বাংলাভাষীর লাগাতার প্রচেষ্টায় ১৯৯৯
সালের ১৭ই নভেম্বর থেকে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ দিনটির আন্তর্জাতিক
খ্যাতি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে। দিনটা
এপার ওপার এমনকি সাগরপার সব বাঙালির কাছে গৌরবের. শ্রদ্ধার ও উদ্যাপনের। অন্যদিকে
বাংলা ভাষা আন্দোলনের আর একটি রক্তঝরা দিন ১৯ শে মে-র ইতিবৃত্ত আমাদের উদাসীনতায়
প্রায় বিস্মরণের পাতায়, অথবা একেবারেই অজানা অনেকের কাছে।
তাই প্রসঙ্গক্রমে বরাক উপত্যকা, কাছাড় ও
আসামের ইতিহাসটাই সংক্ষেপে ঝালিয়ে নেওয়া যাক। বরাক উপত্যকার কাছাড় ছিল স্বতন্ত্র
ভূমি। কাছাড়-রাজ গোবিন্দচন্দ্রের সীমানা ছিল বর্তমান নওগাঁ জেলার যমুনামুখ ও
ডবকলার নিকট পর্যন্ত। উত্তরাংশের বা পার্বত্য কাছাড়ের নেতা কাচাদিন (বা Kahi Dan)কখনই
গোবিন্দচন্দ্রের অধীনতা মানেন নি। কাচাদিন বা কাহিদানকে গোবিন্দচন্দ্র কৌশলে
হত্যার পর তাঁর পুত্র তুলারাম প্রতিশোধ নিতে কাছাড়রাজের ওপর নাগা, কুকি প্রভৃতি
পার্বত্য উপজাতিদের সংঘবদ্ধ করে বারবার আক্রমণ চালান। পরপর তিনটি যুদ্ধে জিতেও
যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যস্থতায় চুক্তি অনুযায়ী গোবিন্দচন্দ্র উত্তর কাছাড়ের
স্বাধীন সেনাপতি বা করদ রাজা হিসাবে তুলারামকে মেনে নেন। ১৮৩০ সালে
গোবিন্দচন্দ্রের অপমৃত্যু। ১৮৩১ সালে উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাবে তাঁর রাজ্য চলে
যায় কোম্পানির দখলে। তুলারামের মৃত্যুর পর (১৮৫১) তাঁর দুই পুত্র নকুলরাম ও
ব্রজনাথ উত্তরাধিকার ভোগ করতে থাকে। কিন্তু চুক্তি ভেঙে নকুলরাম নাগাদের সঙ্গে
বিবাদে জড়িয়ে মারা যাওয়ার পর ইংরেজ সরকার ১৮৫৪তে উত্তর কাছাড়ও কব্জা করে নেয়।
১৮২৬ সনে যখন ইংরেজ প্রথম অহমরাজ্য অধিকার
করে তখন তার অন্তর্ভূক্ত ছিল মাত্র পাঁচটি জেলা – কামরূপ, দরং,
নওগাঁ, শিবসাগর ও লখিমপুর। এর ছয় বছর পর ১৮৩২-এ দক্ষিণ কাছাড় এবং তারও পরে ১৮৫৪তে
উত্তর কাছাড় কাম্পানির শাসনে চলে আসে। প্রথমে ঢাকা, ও পরে কলকাতা থেকে এইসব
অঞ্চলের শাসনকার্য চালানো হোত। এরও পর ১৮৭৪ সালে শিলং-এ রাজধানী স্থাপন করে
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূর্বোক্ত পাঁচটি জেলার সঙ্গে আশেপাশের অন-আসামীয় অঞ্চল জুড়ে
আধুনিক আসাম রাজ্যের পত্তন করে ইংরেজ। প্রশাসনিক সুবিধা ও রাজস্ব ঘাটতি পূরণের কথা
ভেবে তিনটি বঙ্গবাসী জেলাকে আসামের সাথে জুতে দেওয়া হয়।
কাছাড় কোনও কালেই আসামের অংশ ছিল না। সমতল কাছাড়ের
শতকরা আশি ভাগ বাংলাভাষী। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সরকারি ভাষাও ছিল বাংলা।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাকি অংশে অবশ্য অসমীয়া ভাষার চল বেশি যদিও পার্বত্য ভাষার
চেয়ে অধিক বলা যায় না। বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে থাকার কারণে লর্ড উইলিয়াম
বেন্টিংক ১৮৩৫ সালে বাংলাকে সমগ্র আসামের শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে লাগু করার পর
থেকেই বিবাদের শুরু। অসমীয়াকে তখন বাংলারই একটা উপভাষা ভাবা হোত। ব্যাপটিস্ট
মিশনারীদের গবেষণা অসমীয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর অসমীয়ারা
ভাষার দাবি উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৮৭৩ সালের ৯ই এপ্রিল শিক্ষার মাধ্যম হিসাবেও অসমীয়ার
দাবি স্বীকৃত হয়। আর শহুরে স্কুলগুলোয় বাঙালি ছাত্রসংখ্যা মাথায় রেখে বাংলা
শর্তসাপেক্ষে নিছক একটি বিষয়ে পরিণত হয়। বাংলাভাষীরা পরভাষা, পরধর্ম ও
পরসংস্কৃতিসহিষ্ণু; কোনও অশান্তি করেনি তাই নিয়ে।
অথচ ১৯৩১ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার ১৬ বছর আগের
এক গণনায় প্রকাশ:
১.
সুরমা উপত্যকা (সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ)-এ বাংলাভাষী- ২৮,৪৮,৪৫৪,
অসমীয়াভাষী- ৩৬৯২
২.
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা (নেফা ও পার্বত্য অঞ্চল)-এ অসমীয়াভাষী- ১৯,৭৮,৮৩২,
বাংলাভাষী- ১১,০৫,৫৮১, পার্বত্য- ১২,৫৩,৫১৫
অর্থাৎ
তথাকথিত আসামরাজ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল অসমীয়াভাষীর দ্বিগুণ। স্বাধীনতার পরেও
তাই স্বাভাবিক ভাবে বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই গেছে। তাছাড়া সরকারী চাকরি ও
অন্যান্য উচ্চপদে সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই বাঙালিরা অগ্রসর। সংখ্যালঘু অসমীয়াদের
ঈর্ষার কারণ এগুলোও। তাই ১৯৫৫-তে প্রথম বঙ্গাল খেদানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যদিও
তা বেশি দুর ছড়াতে পারেনি। পরম সহিষ্ণু বাঙালিরা সংখ্যাগুরু হয়েও একতরফা মার খেয়ে শান্তিরক্ষা করে।
কিন্তু অশান্তি করার মতো বিষয়, যেমন অসমীয়াকে
বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা করার যে দাবিটা অহমদের ছিলই। প্রতিরোধহীন বাঙালির শান্তিপ্রিয়তার
সুযোগ নিয়ে তা ১৯৬০ সালে “বঙ্গাল খেদা” আন্দোলনের রূপ নেয়। এবারে সমগ্র আসাম জুড়ে এক-তরফা নিধনের
আগুন জ্বলে ওঠে। ৪ঠা জুলাই থেকে টানা দশদিন। বহু বাঙালি নরনারী শহীদ শিরোপা না
পেয়েই মারা গেল। আর নরমেদ যজ্ঞ সফল হল ’৬০-এর ২৪শে অক্টোবর আসাম
বিধানসভায় “একক অসমীয়া ভাষা বিল” পাস হওয়ার মাধ্যামে।
বঙ্গভাষীরা না হয় ভেদ্য লক্ষ্য, বিবেচিত হল না বিপুল সংখ্যক পার্বত্য জনজাতির
কথাও। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য হল (State
Recognisation Commission, Report, Pg-211, sec 733, Para 719)।
চমৎকার! যে বাঙালিরা বহিরাগত শরণার্থী,
তাদেরও যাহোক একটা পুনর্বাসন হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, দন্ডকারণ্যে বা
আন্দামানে। কিন্তু বরাক-কাছাড়-করিমগঞ্জের যেসব বাঙালিরা সেখানকারই ভূমিসন্তান,
তাদের রাতারাতি উচ্ছেদ প্রাদেশিক আন্দোলনের রূপ পেয়ে গেল। রাজ্যভাষাবিরোধী কাছাড়কে
রাজ্যের মানচিত্র থেকে অপসারণের প্রস্তাবও ওঠে। অথচ কাছাড়ের
বাঙালাভাষীরা অসমীয়া সাহিত্য-সংস্কৃতি বর্জন করার বদলে তার দ্বারা সমৃদ্ধই হতে
চেয়েছে। তাই এত অত্যাচারের পরও পৃথক রাজ্যের সঙ্গত দাবি ওঠেনি সেভাবে। হয়ত
দেশভাগের ফলে দাঙ্গার নারকীয় স্মৃতিই তাদের রাজ্য ভাঙাভাঙির প্রতি অনীহা তৈরি
করেছিল। কিন্তু আরও একটু আগে ‘ভালোমানুষ’ বাঙালি জেগে উঠলে একতরফা প্রাণনাশ কিছুটা ঠেকানো যেত।
অন্যদিকে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথ
বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ শোনা যায় একটি বেনিয়া জনগোষ্ঠীর প্ররোচনা। শিক্ষিত
সম্প্রদায় – তা অভিবাসীই হোক বা ভূমিসন্তান, অর্থনৈতিক শোষণের পথে
অন্তরায়। তাই তাদের বিরুদ্ধে উস্কানি বা হিংস্রতায় অর্থ যোগান –কোনওটা দিতেই
কার্পণ্য করেনি মাড়োয়ারিররা।
১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী করিমগঞ্জ রমণীমোহন
ইনস্টিটিউটে আহূত কাছাড় জেলা সম্মেলনে যে কঠিন সংকল্প গৃহীত হয় তা, মারের বদলা মার
দেওয়ার শপথ নয়, মাতৃভাষার সম্মানার্থে আত্মোৎসর্গের অঙ্গীকার। এতদিন অস্ত্র বলতে ছিল
মাসের পর মাস ‘সত্যাগ্রহ’, শান্তিপূর্ণ পিকেটিং। ১৯শে মে শিলচর
স্টেশনে অবরোধের সময় হঠাৎ খবর করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিস
লাঠিচার্জ করেছে। হরতাল তবু মনে হচ্ছে সফল। শিলচর স্টেশন দিয়ে একটাও গাড়ি চলাচল করতে
পারেনি। অকস্মাৎ চিৎকার – কাটিগড়ায় ধরা সত্যাগ্রহীদের গাড়িতে আগুন। আন্দোলনকারীরা
ছুটে গিয়ে কাদা, পাঁক, জল দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলল। তারপর লাঠিচার্জ না করে উপায়
থাকে? “হরতাল সফল হতে চলেছে, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ”! তিন হাজার
কণ্ঠ্যে একই কথা! তাই নাকি? ২টো ৩৫মিনিটে গুলি চলে। এগারোজন ঘটনাস্থলেই শহীদ। আহত
শতাধিক। কিশোরী কমলা, বালিকা মঙ্গলা কেউ রেহাই পেল না। আন্দোলন চলে একমাস। আসাম
সরকার বাধ্য হয় করিমগঞ্জসহ কাছাড় জেলার সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলাকে মেনে নিতে।
বাঙালিরা অবশ্য বাংলা ভাষাভিত্তিক অঞ্চল নয়, চেয়েছিল সমগ্র আসামে দ্বিতীয় সরকারি
ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। মিলল না। তবু পৃথক বঙ্গভাষী রাজ্যের দাবি তোলেনি।
যেখানে রক্তস্নাত না হয়েও বোড়োল্যান্ড, কার্বি আলং রাজ্যের দাবি তুলছে বিভিন্ন
জনজাতির মানুষ।
ইতিহাসের পরিহাসও তেমনি! একদিন যারা “বঙ্গাল খেদা”র জিগির তুলেছিল,
তাদেরই উগ্রতম অংশ (হয়ত বা প্রচ্ছন্নভাবে অনেকেই) ভারত থেকেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি
তুলছে। প্রথমদিকে এদেরও বাঙালি হত্যায় মদত দিয়েছিল ‘অহিংস’ ঐ বেনে গোষ্ঠী।
পরে আসু, আগফা, আলফার আক্রোশ তাদের দিকেও বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। যতদিন আসামে শুধু
বাঙালিরা মার খেয়েছে, ততদিন দিল্লীর চোখ না খুললেও হিন্দীভাষীরাও আক্রান্ত হওয়ার
পর থেকে আসামে ধ্বণিত হচ্ছে সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ।
আমরা এপার বাংলার মানুষ প্রতিবছর আন্তরিক
শ্রদ্ধার সঙ্গে ২১শে ফেব্রুয়ারী স্মরণ করি। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে ভারতবর্ষে
বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদদের মনে রাখতে আমাদের বিস্ময়কর অনীহা। ১৯৬১-র ১৯শে
মে কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরোকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস,
শচীন পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্রদেব, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদ দাস,
বীরেন্দ্র সূত্রধর; অথবা ১৬ই আগস্ট ১৯৭২-এ করিমগঞ্জের বিজন চক্রবর্ত্তী, ২১শে
জুলাই করিমগঞ্জের জগন্ময় দেব, দিব্যেন্দু দাস এবং আরও অসংখ্য নাম না জানা মানুষের
আত্মবলিদান কি এতই ফেলনা?
বাঙালি আপাদমস্তক ঐক্যসংহতিপ্রেমী,
পরসংস্কৃতি সহিষ্ণু শ্রদ্ধাশীল জাতি। ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়ে সম্প্রদায়
বিশেষের প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি গৃহীত হয়েছে জাতীয়মন্ত্র (National Anthem). জাতীয়মন্ত্র
(জনগণমন) ও জাতীয় সঙ্গীত (বন্দে মাতরম) দুটোর রচয়িতাই বাঙালি। ভারতবর্ষই সম্ভবত
পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ন্যাশনাল অ্যানথেম-এর ভাষা রাষ্ট্রভাষার মার্যাদা
পায়নি। আমাদের অভিযোগ নেই। কিন্তু আমাদের সহিষ্ণুতা যেন আত্মবিস্মরণের কারণ না
ঘটে। আসলে এত সমৃদ্ধ ভাষার অধিকারী হয়েও আমরা বড় অসহায়। প্রাদেশিক বিশিষ্টতা,
মাতৃভাষার জন্য দাবি – এসব যেন জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। আবার একতার স্বার্থে
হিন্দীর আধিপত্য মেনে নিতে গিয়ে একদিকে বাংলাভাষার পিণ্ডি চটকাই, অন্যদিকে
দীর্ঘশ্বাস গোপন করি!
ত্রিপুরায় আদিবাসী বিদ্রোহ
স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য মূলত ছিল আদিবাসী প্রধান। তবে স্বাধীনতার
আগে থেকেই শিক্ষিত বাঙালির সমাদর ছিল রাজার সভায় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। দেশভাগের
পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার তাড়া খাওয়া বাঙালির আগমণ ঘটে রাজ্যটার
জনসংখ্যার চরিত্রই(demography)
বদলে দিল, যেখানে আদিবাসীরা নিজেদের ভূমিতে সংখ্যালঘু হয়ে উঠতে থাকে। তাদের জমিও
বেহাত হতে লাগল। শুরু হল আদিবাসী বিদ্রোহ (Tribal
insurgency)। কিন্তু কারণটা সঙ্গত হলেও হিংস্রতা ও নৃশংসতার যা
নিদর্শন দিয়েছিল ত্রিপুরার উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষ হিন্দু বাঙালিদের ওপর তার
স্মৃতিটাও আজও শিরদাঁড়ায় হিম স্রোত বইয়ে দেয়।
১৯৮০-তে আগরতলা থেকে ৩০ কিলোমিটার
উত্তর-পূর্বে ‘মাণ্ডাই’ (মাণ্ডাভি) গ্রামে বাস ছিল বাঙালী ও
ত্রিপুরীদের। ৬ই জুন স্থানীয় TUJS ও TNV নেতারা বাঙালী নিধনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে
ফেলে। সেই রাত থকেই উপজাতির পুরুষেরা হিন্দু বসতিতে ঘাঁটি গাড়ে। ৭ই জুন ভোর থেকেই
রক্তস্রোত বইতে থাকে; আর প্রাণ ভয়ে পলায়মান হাজার হাজার হিন্দু বাঙালি ঘর-বাড়ি
ফেলে আশ্রয় নিতে থাকে ৪৪ নং জাতীয় সড়কের ধারে। জিরানা গ্রামের বিডিও পশ্চিম
ত্রিপুরার জেলা শাসকের নির্দেশে ঘরছাড়াদের জন্য পরে খয়েরপুর স্কুলে ত্রাণ শিবিরও
খুলে দেন। গুড় চিঁড়ে বণ্টনের নির্দেশ আসে। কিন্তু তার মধ্যে আদিবাসীদের
আক্রমণে সরকারি হিসাবেই এ রাতে ২৫৫ জন হিন্দু বাঙালি ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায়।
বেসরকারি সূত্র বলে অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ জন। সংখ্যাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে
না, তাই তো? তাহলে একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। “Many of the victims had their heads crushed and their limbs
severed. The children were spiked through.[1] Pregnant women had their
stomach slit open. According to UNI reports,
the attackers inserted sharp weapons in the genitalia of the victim women.[5]”en.wikipedia.org/wiki/Mandai_massacre.মাথা গুঁড়িয়ে, হাত পা ছেদ করে, বাচ্চাদের
এ ফোঁড় ওফোঁড় করে এবং অবশ্যই মহিদের আর একটু বেশি যত্ন করে, মানে গর্ভবতীদের পেট
চিরে, বন্দি মেয়েদের জজনাঙ্গে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে – যত রকম বীভৎসতা হয় আর কি! গুজরাটের গোধরা ও তার পরবর্তী
দাঙ্গা বা দিল্লির ‘দামিনী’-কাণ্ডের লোহার রড পর্বের গর্ব চুরমার করে এই ভারতভূমিতে
অনেক আগেই ত্রিপুরা রেকর্ড গড়ে রেখেছে। তার আগে হয়েছে ‘মাই লাই ম্যাসাকার’ - বাঙালীদের ওপর ত্রিপুরী আদিবাসীদের ক্ষুব্ধ আক্রমণ। তবে অমৃত বাজারের খবর ও
মেজর আর. রাজামাণির সেটা বীভৎসতায় ‘মাণ্ডাই ম্যাসাকার’-এর অর্ধেকও ছিল না। ৭ই জুন সন্ধ্যে বেলায় জিরানিয়া ব্লকেও শুরু
হয় লুঠপাট। প্রশাসনের সবাই নিষ্ক্রিয় ছিল না। কিন্তু জেলা শাসক পি. এম. শর্মা ও
অতিরিক্ত জেলা শাসক এম. এল. দাশগুপ্ত দুই কোম্পানি সেনার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু
আর্মির ওপর নির্দেশ ছিল শুধু ফ্ল্যাগ মার্চ করার। ততক্ষণে চম্পকনগর, বড়মুড়াতেও
আগুন জ্বলছে। ৮ই জুন মাণ্ডাইয়ের LAMPS ম্যানেজার সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী ও শচীন সাহা
নামে জনৈক সিপিআই(এম) নেতা বিডিও অফিসে খবর দেন ৫০০-র বেশি হিন্দু বাঙালী বন্দি
অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুণছে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে শুনশান পুলিস চৌকিতে। শেষ পর্যন্ত পরের দিন সকাল ৬টা নাগাদ রাজস্থান সশস্ত্র বাহিনী (Constabulary) এবং ত্রিপুরা সশস্ত্র পুলিস বাহিনী
জিরানিয়া থেকে মাণ্ডাইয়ের দিকে রওনা হল। রাস্তায় তখন দেখা যাচ্ছে পূর্বা নোয়াবাড়ি
জ্বলছে। আর মাণ্ডাই পৌঁছে নেভানো মতো আগুনের শিখাও নয়, পাওয়া গেল রক্তপিচ্ছিল
গ্রামময় ভস্ম-স্তূপ। কেবল LAMPS ভবনটি টিঁকে আছে। দুজন বাঙালী হিন্দু রমনীকে
পুলিস চৌকিতেই কুপিয়ে খুঁচিয়ে ফেলে রাখে জীবন দেব্বামা নামক এক বীর পুংগব। আহতদের
দু ঘণ্টা পরে ট্রাকে করে জিবি নিয়ে যাওয়া হল মৃত ঘোষণা শোনার জন্য। ৮ই জুলাই, ১৯৮০
সরাষ্ট্র মন্তক থেকে ‘দীনেশ সিংহ’ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায় চোকানো হয়।
১৯৪৭-এর বাংলাভাগ সহ দেশভাগ ত্রিপুরাকে
একেবারে প্রান্তিক ও বিধ্বস্থ করে দিয়েছিল। একটি স্বাধীন রাজতন্ত্রী দেশ থেকে
ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে তার অন্তর্ভূক্তিতে ততটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু
ভাগাভাগির পর যে শরণার্থীর ঢল নেমে জনসংখ্যার অনুপাতটাই বদলে দিল। অথচ ভারতের মূল
ভূখণ্ড থেকে এর ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটির
অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনাকে কবর দিয়ে দিল। স্বাধীনতার অর্থ শতাব্দী পরেও মাত্র
৮০ কিলোমিটার রেল পথ আর একটি মাত্র অমসৃণ জাতীয় সড়ক (NH 44)। আগরতলার বিমান
বন্দরের যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা আর কতটুকুই বা সামাল দিতে পারে? মাত্র দু জন
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পার্লামেন্ট সদস্য মারফৎ রাজ্যবাসীর অভাব অভিযোগ দিল্লির
কানে পৌঁছনোর আগেই পথে হারিয়ে যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অশান্তির আদর্শ প্রজনন
ক্ষেত্র। ত্রিপুরী আদিবাসীদের ভাষায় ত্রিপুরা মানে ‘জলের ধারে ভূমি’। রাজার সভায়
বরাবরই বাঙালীর কদর। মহারাজ বিজয় মাণিক্য বাংলার সাতটি নদীতে পুণ্য-স্নান করেছেন।
পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, অংশত চট্টগ্রাম, নোয়াখালি এমনকি ঢাকা মহকুমার কিছু অংশও ছিল
ত্রিপুরারাজের শাসনাধীন; অর্থাৎ দশ হাজারের বেশি বাঙালী ত্রিপুরেশ্বরের প্রজা ছিল।
১২৮০-তে ত্রিপুরার রাজা প্রথম অনেক উচ্চ বর্ণের বাঙালীদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করে
আনেন। তারা বেশির ভাগই বাংলার ‘বারো ভুঁইয়া’
(H.L. Chatterji, ‘Glimpses of Tripura’s History’,Tripura Review,
15 August 1972)। সুতরাং ত্রিপুরার সঙ্গে
বাংলা ও বাঙালীর যোগ স্বাধীনতা উত্তর ঘটনা নয়, রীতিমতো ঐতিহাসিক ও প্রাচীন। তবে
শুধু মাত্র মাণিক্য রাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রীতিবশত বাঙালী আহ্বান নয়।
বাংলা ছিল বিভিন্ন জনজাতিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার সাধারণ ভাষা, অর্থাৎ lingua franca.
তাছাড়া বাঙালিরা ইংরেজ প্রনীত আধুনিক শাসন ব্যবস্থার রূপকারও ছিল; আবার
পূর্ববঙ্গীয় বাঙালিদের চাষাবাদের স্বাভাবিক দক্ষতা ও জ্ঞান কৃষিশুল্ক দ্বারা
রাজকোষকে রীতিমতো সমৃদ্ধ করে রাখত। তখন আদিবাসীদের কোপে পড়তে হয়নি। কিন্তু বিংশ
শতাব্দীর গোড়া থেকেই মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত বা নিরাপত্তাহীন
হিন্দু বাঙালির ঢল, তাদের বাড় বাড়ন্ত ত্রিপুরার মোট পূর্ববঙ্গীয় বাঙালিদের
সংখ্যাধিক্যের কারণে উপজাতিগুলোকে একেবারে প্রান্তিক করে দিল। বাঁটোয়ারার ঠিক
প্রাক্কালেও ত্রিপুরী উপজাতিদের সংখ্যাধিক্য ছিল না; বরং চিটাগং পার্বত্য অঞ্চলে
বা Chittagong Hill Tracts (CHT)-এ পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠীই প্রধান ছিল,
বাঙালীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২%। অন্যদিকে ত্রিপুরার সবচেয়ে আদিবাসীপ্রধান পাহাড়ি
এলাকা তিপ্পারাতেও উপজাতি জনসংখ্যা ৪০%-র বেশি ছিল না। কিন্তু ১৯৪৭ যেন পূর্ব
পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত অশ্রয়প্রার্থী বাঙালির বাঁধ ভেঙে দিল। দুই দশকে উপজাতি জনগোষ্ঠী স্পষ্টত
সংখ্যালঘু হবে পড়ল। নীচের তালিকার দিকে চাইলে পরিস্থিতির একটা ধারণা পাওয়া যাবে –
Decadal Variation of Population and percentage of Tribals
Year
|
Total
Population
|
Percentage
Variation
|
Total
Tribal Population
|
Percentage
of Tribes
|
1874-75
|
74,523
|
–
|
47,523
|
63.77
|
1881
|
95,637
|
28.33
|
49,915
|
52.19
|
1891
|
137,575
|
43.85
|
70,292
|
51.09
|
1901
|
173,325
|
25.99
|
91,679
|
52.89
|
1911
|
229,613
|
32.48
|
111,303
|
48.47
|
1921
|
304,347
|
32.59
|
171,610
|
56.37
|
1931
|
382,450
|
25.63
|
203,327
|
52.00
|
1941
|
513.010
|
34.14
|
256,991
|
53.16
|
1951
|
639,028
|
24.56
|
237,953
|
37.23
|
1961
|
11,42,005
|
28.71
|
360,070
|
31.50
|
1971
|
15,56,342
|
36.28
|
450,554
|
28.95
|
1981
|
20,53,058
|
31.92
|
583,920
|
28.44
|
(Source: Census Reports)
আর একটি সূত্র জানাচ্ছে “As
per census records tribals constituted 52.89% of Tripura's population in the
first census of the last century held in 1901 while non-tribals formed
47.11%.The balance remained relatively stable in 1931 census when Tripura's
tribal population was 50.26% and non-tribal Bengali population was 49.74%. Even
in 1941 tribal and non-tribal population was respectively 50.9% and 49.91%.”
রাজতন্ত্রের অবসান এবং ভারতীয় ব্যালট বাক্স গণতন্ত্রের সূচনা ত্রিপুরায় উপজাতিগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সত্যিই গুরুত্বহীন অন্তেবাসী করে দিল। রাজতন্ত্র অবসানের ৪০ বছর পর ত্রিপুরা তার প্রথম উপজাতি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পেল দশরথ দেবকে, যিনি পাহাড়ি প্রদেশের রাজা দশরথ বলেও পরিচিত। ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দশরথ ১৯৯৩-এ কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় ফেরার পর চার বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। এই দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব ১৯৭৮ CPI(M)প্রথম ক্ষমতায় আসার পরেই উঠেছিল; তুলেছিলেন ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের হোতা বীরেন দত্ত, একজন বাঙালি। সেবারে অবশ্য পলিটব্যুরো নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তর তৎপরতায় নৃপেন চক্রবর্তীকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বীরেন দত্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই নিয়ে নিজের আক্ষেপ জানিয়ে গেছেন, ‘one big mistake by our party in Tripura’(২৩.০৪.১৯৮৭)। ১৯৭৮-এ দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করলে আদিবাসী আবেগ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর বিশ্বাস দুটোই অটুট থাকত - ‘Tribal extremism would never have taken off had Deb been made the chief minister and we would have been able to spread the communist movement to other tribal-dominated states of Northeast. But we missed that great chance by foisting Nripen Chakrabarty who was always described by tribal extremists as the refugee chief minister’ (Dutta, ibid). তার আগে কংগ্রেস সরকারও উপজাতি জনগোষ্ঠীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি এবং বাঙালী শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল রাজা বীর বীক্রমের দ্বারা ১৯৪৩-এ চিহ্নিত ১৯৫০ বর্গ মাইল Tribal Reserve অঞ্চলেই [...,but in 1948, the Regent Maharani’s Dewan A.B. Chatterji vide order no. 325 dated 10th Aswin, 1358 Tripura Era (1948 AD) threw open 300 sq. miles of this reserve for refugee settlement. Later, more of these areas would be opened to the refugees]। ফলে ক্ষোভ জমছিলই ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকে। নীচের তালিকা অনুপ্রবিষ্ট পূর্ববঙ্গীয়দের একটা হিসাব দেয় –
রাজতন্ত্রের অবসান এবং ভারতীয় ব্যালট বাক্স গণতন্ত্রের সূচনা ত্রিপুরায় উপজাতিগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সত্যিই গুরুত্বহীন অন্তেবাসী করে দিল। রাজতন্ত্র অবসানের ৪০ বছর পর ত্রিপুরা তার প্রথম উপজাতি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পেল দশরথ দেবকে, যিনি পাহাড়ি প্রদেশের রাজা দশরথ বলেও পরিচিত। ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দশরথ ১৯৯৩-এ কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় ফেরার পর চার বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। এই দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব ১৯৭৮ CPI(M)প্রথম ক্ষমতায় আসার পরেই উঠেছিল; তুলেছিলেন ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের হোতা বীরেন দত্ত, একজন বাঙালি। সেবারে অবশ্য পলিটব্যুরো নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তর তৎপরতায় নৃপেন চক্রবর্তীকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বীরেন দত্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই নিয়ে নিজের আক্ষেপ জানিয়ে গেছেন, ‘one big mistake by our party in Tripura’(২৩.০৪.১৯৮৭)। ১৯৭৮-এ দশরথ দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করলে আদিবাসী আবেগ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর বিশ্বাস দুটোই অটুট থাকত - ‘Tribal extremism would never have taken off had Deb been made the chief minister and we would have been able to spread the communist movement to other tribal-dominated states of Northeast. But we missed that great chance by foisting Nripen Chakrabarty who was always described by tribal extremists as the refugee chief minister’ (Dutta, ibid). তার আগে কংগ্রেস সরকারও উপজাতি জনগোষ্ঠীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি এবং বাঙালী শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল রাজা বীর বীক্রমের দ্বারা ১৯৪৩-এ চিহ্নিত ১৯৫০ বর্গ মাইল Tribal Reserve অঞ্চলেই [...,but in 1948, the Regent Maharani’s Dewan A.B. Chatterji vide order no. 325 dated 10th Aswin, 1358 Tripura Era (1948 AD) threw open 300 sq. miles of this reserve for refugee settlement. Later, more of these areas would be opened to the refugees]। ফলে ক্ষোভ জমছিলই ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকে। নীচের তালিকা অনুপ্রবিষ্ট পূর্ববঙ্গীয়দের একটা হিসাব দেয় –
TABLE 2
Year-wise Influx of Displaced Persons into Tripura
Year
|
Number of Displaced Persons
|
1947
|
8124
|
1948
|
9554
|
1949
|
10575
|
1950
|
67151(up to February)
|
1951
|
184,000
|
1952
|
233,000
|
1953
|
80,000
|
1954
|
3,200
|
1955
|
4,700
|
1956
|
17,500
|
1957
|
57,700
|
1958
|
3,600
|
Hereafter, from 1959 to 1963,
registration of refugees was discontinued
|
|
1964-65
|
1,00,340
|
1965-66
|
13,073
|
1966-67
|
1,654
|
1067-68
|
12,299
|
1968-69
|
3,120
|
1969-70
|
4,334
|
1970-71 (upto 24 March)
|
5,774
|
Total
|
6,09,998
|
মনে
রাখতে হবে, ত্রিপুরায় এই স্রোত ছিল সর্বতোভাবে একমুখী। ত্রিপুরা থেকে কোনও
আদিবাসী, কোনও অহিন্দু পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়নি। এই একমুখী জনস্রোতের অভিঘাত যে
স্থানীয় ও বহিরাগত উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ভয়াবহ হবে তা বুঝেও কিছু করার ছিল না।
সীমন্তের এপারে বা ওপারে হিন্দু বাঙালিকে মার খেতেই হোত।
আর একটা মারাত্মক আত্মঘাতী ভুল করেছিল কমিউনিস্ট দল। ত্রিপুরায় দল হিসাবে
সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্য বিধানসভা গড়ার উপায় ছিল না কেন্দ্রশাসিত রাজ্যটির। ১৯৭৮-এ
ক্ষমতায় এসেই উপজাতিদের রাতারাতি “আমরা বাঙালি” তকমায় দাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। সবাই তো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নয়, যে উড়ে এসে জুড়ে
বসাটা মেনে নেব। Tribal
National Volanteers (TNV)-এর
নেতৃত্বে কতটা হিংসা ও বিদ্বেষ জমা ছিল ও তার গতি প্রকৃতি কোন দিকে, তা নিয়ে কোনও
চিন্তা ভাবনা কাজ করেনি এই আরোপিত অভিন্নতার প্রয়াসে। পুঞ্জিভূত বারুদে অগ্নিসংযোগ
হল। ১৯৮৮-তে বাম সরকার পরাভূত হওয়া পর্যন্ত হিন্দু বাঙালীদের ওপর TNV-র
তাণ্ডব চলতেই লাগল। সিপিআই(এম) নির্বাচনে হারার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে TNV-র
একটি চুক্তি হয় যাতে বিধান সভায় ত্রিপুরী উপজাতির প্রতিনিধির জন্য তিনটি আসন
সংরক্ষিত হল। এর ফলে TNVকে প্ররোচিত করে বামপন্থীদের ওপর ওপার থেকে আগত
বাঙালীদের আস্থা নষ্ট করার কংগ্রেসি ষড়যন্ত্রেরও সন্ধান পেতে লাগল ত্রিপুরার বাম
দল। প্রমাণ স্বরূপ হাতে পাওয়া গেল ত্রিপুরা অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের দুমাসের মধ্যে মিজোরামের
সাপ্তাহিক কাগজ জোয়িং (Zoeng)-এ প্রকাশিত কংগ্রেসি মিজো মুখ্যমন্ত্রী লণ্ঠনহাওলা ও TNV নেতা বিজয় কুমার হ্রংখওয়ালের আঁতাত
পত্র-বিনিময়। রাজনৈতিক চাপান-উতোর ষড়যন্ত্র-অবিশ্বাস বাঙালি-আদিবাসী সংঘাতকে ক্রমশ
জটিলতর করে চলল। এর চরমরূপটা আবার দেখা গেল ২০০২-এ Tripura
Tribal Areas Autonomous District Council (TTADC)-র নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাবাদী National Liberation Front of Tripura (NLFT) কয়েকজন বামপন্থী প্রার্থীকে অপহরণ ও খুন করে
পুনরায় আতঙ্কের বাতাবহ সৃষ্টি করল Indigenous Peoples Front
of Tripura (IPFT)-র
প্রচারের স্বার্থে। IPFT প্রত্যাশিতভাবে TTADC
নির্বাচন জিতল। TTADC গঠনের পর এই প্রথম বামফ্রন্ট ভোটে নিশ্চিহ্ন
হয়ে গেল। NLFT ইতিমধ্যেই বামপন্থী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে ২০০৩ বিধানসভা
নির্বাচনের দিকে চোখ রেখে। বাম নেতাদের অবস্থা হল না ঘরকা, না ঘাটকা। আদিবাসী
এলাকায় তারা NLFT-র আক্রমণের নিশানা, আর বাঙালি পাড়ায় তারা
চিহ্নিত হল হয় অপদার্থ নয়তো বাঙালি-বিদ্বেষী হিসাবে। ৬.৬.২০০০ সালে দেওয়া এক টেলিফোন
সাক্ষাৎকারে UBLF নেতা বিজন বসুর বক্তব্য, ‘It is because we Bengalis vote for them that the communists enjoy
some clout in Indian politics. But these are the people who have, instead of
protecting the Bengalis, dropped us before the tribal wolves and let them feast
on our rotting flesh. We will punish them as much as the tribal extremists,
though we will not touch tribals who are fighting the militants,’ বাঙালি উল্টে নিজেদের মধ্যেই অন্তর্দন্দ্বে
জড়িয়ে পড়ল।
মাণ্ডবি রাত্রির পর দাঙ্গায় প্রাণ হরিয়েছে অন্তত ১০০০ জন,
যাদের সিংহ ভাগ বাঙালি। US Committee for
Refugees, Special Report on Northeast India, compiled by Hiram Ruiz, 2000-র খতিয়ান অনুযায়ী দু লক্ষের বেশি পুনর্বাসিত শরণার্থী আবার
বাস্তুহারা হয়েছে। অন্যান্য সূত্র থেকে দেখা যায় গত কুড়ি বছরে ৬০০০ বাঙালি
জাতি-দাঙ্গায় খুন হয়েছে, ৫০০-র বেশি অপহৃত হয়েছে যাদের কেউ কেউ মুক্তি পেয়েছে এমন
অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে যাতে পরিবারটির আর্থিক ভিত উপড়ে যায়, আর নোখোঁজ যে কত শত
তার হিসাব নিতেও আতঙ্ক।বাঙালিরাও যে এক তরফা মার খেয়েছে তা নয়। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে
প্রাণরক্ষায় তৈরি United Bengal Liberation
Front (UBLF) যান বাহনে বোমা মেরে ২০ জন
আদিবাসীকে উড়িয়ে দেয়। এক দিকে দিল্লির ‘উপজাতি
গণমুক্তি পরিষদ’কে লাগাতার অবহেলা, অন্য দিকে বাঙালী বাম
শক্তির ক্রমাগত উত্থান ত্রিপুরার জনজাতির মধ্যে যে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের বীজ বুনে
জন সিঞ্চন করেছে, তার কোপ থেকে ত্রিপুরার বাঙালিদের মুক্তি নেই। লাগাতার
রক্তক্ষরণের এই ইতিহাসে আরও আরও বীভৎসতা ও রাজনৈতিক জটিলতার তথ্য ও বিশ্লেষণ সংযোজন
করা যায়, কিন্তু আজও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল কোনও সমাধান সূত্র খুঁজে আজও পাওয়া যায়নি।
দেশভাগের ইতিহাস পর্যালোচনায় ত্রিপুরার সমস্যাটাই সব চেয়ে কম আলোচিত থেকেছে।
সেখানে বাঙালি জনসংখ্যার সংখ্যা গরিষ্ঠই রাজনৈতিক ভাগ্য ও মানচিত্রের ফেরে বহিরাগত
শরণার্থী। আদিবাসী উপজাতি বা জনজাতিদের ক্ষোভও হ্য়তো সম্পূর্ণ অহেতুক নয়; কিন্তু
একটি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক স্বার্থে বা ভাবাবেগে দেশ তিনখণ্ড (ভারত, পশ্চিম
পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান:বস্তুত মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে শতখানেক স্বাধীন
রাজতন্ত্রী রাজ্যও থেকে গিয়েছিল, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ছাড়া তাদের কী গতি হোত
কে জানে?) করার মূল্য হিন্দু বাঙালিদের আর কত প্রজন্ম ধরে দিয়ে যেতে হবে তার উত্তর
আমাদের এখনও জানা নেই। এই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দায় তো পাকিস্তানের দাবিদারদের ওপর
বর্তায়ই, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশও দায় অস্বীকার করতে পারে না। তবে এ নিয়ে আমাদের,
মানে পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু বাঙালীদেরই মাথা ব্যথা নেই, তো পররাষ্ট্রের দায়স্বীকার!
এত কিছুর পরেও, এত মার খেয়েও আমরা একতাহীন, পরধর্ম, পরসংস্কৃতি, পররাষ্ট্র লেহনকারী
আত্মবিস্মৃত এক জাতি। শুধু সাহিত্যচর্চার খাতিরে আগরতলা গিয়ে কি আমাদের জাতিগত
চরিত্রের সামান্যতম উন্নতির প্রয়াস করছি?
বাঙালি-চীনি ভাই ভাই
বাঙালির
দেশে প্রদেশিক শত্রু, নিজেদের মধ্যে জাতি ধর্মের রেশারেশি, ঘটি-বাটির ঠোকাঠুকি।
তাহলে বিশ্ব-বন্ধুত্বের দিকে হাত বাড়ানো যাক। মার্কস্ ও এঞ্জেলের অর্থনীতি এবং
দর্শন যে জারের অপশাসন ঘুচিয়ে আধুনিক রাশিয়ার বা ইউএসএসআর-এর রূপকার লেনিনের
মার্গ-দর্শক সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; লেনিন গ্রাদ সেন্ট পিটার্স বার্গে নামান্তরিত
হওয়ার পরেও নয়। বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে যাওয়ার দুই জার্মনির মিলনের উচ্ছ্বাস কিন্তু
প্রমাণ করে, একটা রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে যে এক জাতি এক প্রাণের তাগিদ প্রবলতর।
একটি অর্থনীতির বই একদল বুদ্ধিজীবীকে সমস্ত কিছু শ্রেণী চেতনার নীরিখে দেখতে,
শোষনের বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়ে সত্যিই
পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কোথাও কমিনিউজম বহু
ভাষা-সংস্কৃতিকে একই রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে এনেছে, কোথাও একই জাতি ও ভাষাভাষীকে খণ্ডিত
করেছে। যেমন প্রাক্তন ইউএসএসআর তৈরি হয়েছিল রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ভিন্ন ভাষা
সংস্কৃতির দেশকে জোর করে জুড়ে দিয়ে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির
ডানা ছাঁটতে যে বার্লিন প্রাকার তোলা হয়েছিল তার পূর্ব দিকটা রাশিয়ার মতাদর্শগত
সাম্রাজ্যবাদে কমিউনিস্ট দেশ হয়ে যায়, ভিয়েতনাম দু-টুকরো হয় ভিয়েতনাম ও লাওস নামে;
অখণ্ড কোরিয়া দক্ষিণপন্থী দক্ষিণ কোরিয়া আর উত্তর কোরিয়ায় দু-টুকরো হয়। রুমানিয়া,
চীন এবং কিউবা আদ্যন্ত কমিউনিস্ট দেশ হয়ে যায়। সাম্যবাদ সকল রাজনৈতিক মতেরই
আবশ্যিক ঘোষিত দাবি। কেউ সকলের একই রকম ব্যক্তি স্বাতন্ত্র, মত প্রকাশ, সুযোগ
সুবিধা লাভের পক্ষে; আর এক দল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দ্বারা দেশের উৎপন্ন সম্পদ সবার
মধ্যে সম বণ্টনের পক্ষে। বলা বাহুল্য কোনও পক্ষই প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে
পারেনি। আমরা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে স্লাভ দেশগুলোর মুক্তির লড়াই দেখেছি, নিজের
দেশে লেনিনের মরণোত্তর অপমানও দেখেছি, দেওয়াল ভেঙে জার্মানির জুড়ে যাওয়ার আনন্দ
দেখেছি। তবু বিশ্বের কাছে, বিশেষত বাঙালির কাছে কমিউনিস্ট দুনিয়ার দুই শক্ত দূর্গ
ছিল জোড়-তাপ্পি দেওয়া রাশিয়া এবং চীন। প্রথমটি নিজের পূর্বতন অবস্থান থেকে ১৮০০
সরে এলেও বঙ্গবাসীর হৃদয়ে নস্টালজিয়া। দ্বিতীয়টি যথেচ্ছ নীতি বদল করেও
সোস্যালিজমের তকমা সেঁটে আছে বলে বাঙালির আরাধ্য। রাশিয়ার কম্যুনিস্টরা রাশিয়ান,
চীনের কম্যুনিস্টরা চীনা, কোরিয়ার কম্যুনিস্টরা কোরিয়ান, কিউবাররা কিউবান,
রুমানিয়াররা রুমানিয়ান, ভিয়েতনামেররা ভিয়েতনামি। কিন্তু ভারতীয় কম্যুনিস্টরা
ভারতীয় নন, বিশ্ব নাগরিক। চেয়ারম্যানের চায়না বারবার ভারতের সীমা লঙ্ঘন করে
যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করলেও ভারতীয় কমরেডদের চোখে বিদেশী হামলাকারীরা নয়, দোষী
ভারত সরকার। তাই ১৯৬২ সালে চীনা আগ্রাসনের সময় যথার্থ কমিউনিস্টরা চীন-প্রীতি ও
স্বদেশ-বিদ্বেষ দেখিয়ে ‘প্রতিক্রীয়াশীল’ ভারত সরকারের ষড়যন্ত্রে কারাবরণ
করে। এমন দেশদ্রোহিতার শাস্তি মহাচীনেও সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু এদেশে কয়েক
মাসের রাজকীয় মর্যাদায় কারাবাসের অতিরিক্ত কিছু না।
বস্তুত পাকিস্তান আমাদের চেনা
শত্রু, গুপ্ত ঘাতক, কিন্তু পরিচয়টা গোপন নয়। বাংলাদেশও প্রায় জন্ম ইস্তক ভারত
বিরোধীদের আশ্রয় ও মদত দিয়ে এসেছে। বর্তমান সরকার হয়তো সম্পর্কের উন্নতি চায়
নিজেদের মঙ্গলামঙ্গল বুঝতে পেরে। তবে সেখানেও তা সম্ভব বাংলাদেশের অনুকূলে ‘তিস্তা চুক্তি’, ‘ছিট মহল বণ্টন’ সহ
একাধিক রফাসূত্র মেনে নিয়েই। একই ভাষার সুযোগে ও ভারতীয় বাঙালি মুসলমানদের মদতে
বাংলাদেশী জঙ্গীদের কাণ্ডকারখানা বর্ধমানের শিমুলিয়া বিস্ফোরণের আগে থাকতেই সবার জানা
ছিল। বর্ধমান বিস্ফোরণে বোমা বানাতে গিয়ে বাংলাদেশী মৌলবাদী জঙ্গী দুজনের মৃত্যু
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে তৎপর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল মাত্র। না হলে ‘শারদা’, পশ্চিমবঙ্গ
সরকার ও মাদ্রাসার আঁতাত গোটা দেশে
নাশকতার মাস্টার প্ল্যান চালিয়েই যেত। পশ্চিমবঙ্গ যে ইসলামিক মৌলবাদীদের নিরাপদ
আশ্রয় এবং তা নতুন নয়, অন্তত বিগত তিন দশক যাবৎ - তা জানার জন্য গোয়েন্দাসূত্র
লাগে না। তবু কেন্দ্রীয় সরাকারকে তৎপর হতে হল এত দিন পর, যখন বাংলাদেশ তার চিরন্তন
রীতি বদলে ‘জামাত’ সহ মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে
আর প্রশয় দিতে রাজি নয়, বরং বাংলাদেশের সন্ত্রাবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে
বলে অভিযোগ তুলল। সাপ্রতিক তৎপরতার পেছনে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরাকরের কতটা দেশের
জন্য সদর্থক চিন্তা কাজ করছে আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তা নিয়ে সন্দেহ যে অমূলক
নয় তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এই নিয়ে উচ্চবাচ্যের বদলে ‘যোগ দিবস’ পালন করলে বোধহয় দেশবাসীর শরীরের মেদ ও মাথা ব্যাথা দুটোই লঘু হবে। কিন্তু
দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের শাস্তির প্রশ্নে এবার থেকে হয়তো বাংলাদেশও আমাদের
পরামর্শদাতা হয়ে উঠবে। অন্য দিকে তামিল বিদ্বেষের কারণে শ্রীলঙ্কাও আমাদের প্রতি তেমন
বন্ধুভাবাপন্ন নয়। কিন্তু নাটের গুরু চীন নিজের সীমা লঙ্ঘন ছাড়াও এই
শত্রুভাবাপন্নদের কীভাবে উস্কানি, মদত ও সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে তা সকলের জানা। এমনকি
ভারতীয় সাহায্যে যে দেশটার অর্থনীতি ও সংযোগ ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে ও চলছে, সেই
ভূটানের প্রতি, আমাদের অঙ্গরাজ্য অরুণাচল প্রদেশ ও কাশ্মীরের লাদাখের প্রতিও চিনের
শ্যেনদৃষ্টি। কিন্তু ভারতীয়, বিশেষত বাঙালি কমিউনিস্টদের কাছে এইসব হাতেনাতে ধরা
পড়া তথ্যপ্রমাণ নিতান্তই কেন্দ্রীয় সরকারের ও মিডিয়ার অপপ্রচার, Pan Nationalism।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার তাদের ভাষায় “ইয়ে আজাদী ঝুটা হেয়”। সমাজতন্ত্র যেখানে দেশের যাবতীয় সম্পদ, শিল্প, সংস্থা
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, পশ্চিম বাংলার সমাজতন্ত্রীরা সেখানে কেন্দ্র
সরকারের হস্তক্ষেপের মধ্যে শুধুই “অগণতন্ত্র” দেখেছেন অথচ “কেন্দ্রীয় সাহায্য’ও চেয়েছেন। বর্তমান সরকারের কথা
আর না তোলাই ভালো। কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়ার জন্য ঘাসফুল যে কাস্তে হাতুড়ির
এত ভালো বিকল্প হতে পারে কে জানত? ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য মানুষ অনৈতিক কাজ করে,
সে অনেক পুরোনো গল্প। কিন্তু নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত জলাঙ্জলি দেয়, তাও দেখতে হল।
অবশ্য ‘পুতুল’ শাসকের নজির ইতিহাসে বিস্তর এবং
তারা বৈদেশিক বা বিশেষ গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপে নিজের মানুষদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে
ঘর গোছায় এর নিদর্শনও প্রচুর।
তলিয়ে দেখতে ‘মাকর্সবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’এর মধ্যে বাস্তবে প্রায়োগিক দিকে
থেকে দূরত্ব খুব কম। দুটোই অনমনীয়। Islamic
Fraternity-র প্রশ্নে যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানরা এক, তেমন
মার্কসবাদের খাতিরেও বাঙালী কমিউনিস্টরা স্বদেশের চেয়ে বিদেশের প্রতি একাত্ম বোধ
করেন। ইসলামিক মৌলবাদ যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানদের এককাট্টা হয়ে ধর্মযুদ্ধে শামিল
হওয়ার উস্কানি দেয়, কমিউনিস্ট মৌলবাদ তেমন কাল্পনিক বিপ্লবের জন্য ডাক দেয়। ধর্মের
খাতিরে মৌলবাদী মুসলিমরা যেমন ক্ষেত্রবিশেষে দেশদ্রোহিতাকেও পরম ধর্ম মনে করে, ‘মার্কসীয় আদর্শ’এর খাতিরে তেমনি ভারতীয়, বিশেষ
করে বাঙালি কমিউনিস্টারা ক্ষেত্রবিশেষে দেশ-বিরোধিতাকেই অবশ্য পালনীয় কর্তব্য মনে
করে। ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাস ছাড়ানোর নীতিতেও যে আশ্চর্য মিল, তা নকশালরা প্রমাণ
করে দিয়েছেন। কার্ল মার্কস বা অ্যাঞ্জেল বেঁচে থাকলেও নিজেদের তত্ত্বের এমন
বিচিত্র সমর্থক দেখে উল্লসিত হতেন কিনা সন্দেহ; বরং তাঁদের মতবাদকে অনমনীয়,
অপরিপবর্তনীয়, অযুগোপযোগী ঈশ্বর উবাচ ‘বাইবেল’
বা ‘কোরান’ বানানো হয়েছে দেখলে দুঃখই পেতেন।
অনেককেই বলতে শুনি, “মার্কস্বাদ
একটা বিজ্ঞান’।
তাঁরা কি জানেন না, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কোনও তত্ত্ব নতুন আবিষ্কারের নিরীখে খারিজ
হয়ে যেতে পারে বা পুরোনো সূত্র সংশোধিত হতে পার? সমাজবাদ উন্নততর বৈষম্যহীন সমাজ
গঠনের একটা সামাজিক তত্ত্ব, কোনও স্বতোসিদ্ধ সূত্র বা নিয়ম
(law) নয়। এর উদ্দেশ্য মহান, তবে তার
প্রয়োগকে তো যুগোপযোগী হতেই হবে। সিঙ্গাপুরের মতো গুটিকয়েকক গণতন্ত্রী এমনকি
ধনতন্ত্রী দেশেও সমাজবাদের আদর্শ অনুচ্চারিত ভাবে রয়েছে, রয়েছে নাগরিকদের স্বার্থে
রাষ্ট্রের দায়, দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। তারা কমিউনিস্ট চিনের মতো শিশুকন্যা হত্যা,
নারী নিগ্রহ কিংবা শিশু শ্রমিক শোষণের পরম্পরা জিইয়ে রাখেনি, বরং মেয়েদের ওপর
নিগ্রহ কঠোরভাবে দমন করে রেখেছে। কিন্তু তারা ঘোষিতভাবে কমিউনিস্ট দেশ নয় বলে বাঙালী
কমিউনিস্টরা তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে না।
এই সমস্ত সর্বহারার প্রতিনিধিরা
ঠাণ্ডা ঘরে বসে বোতলের পর বোতল বিলিতি ফাঁক করতে করতে বহুদিন পর্যন্ত অল্প
শিক্ষিতদের মগজে শ্রেণী চেতনার বীজমন্ত্র ও অশিক্ষতদের মগজে জঙ্গীপনার উৎসাহ
ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল। শিল্পে অথর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া ছাড়াও কয়েক
প্রজন্মের ধরে শিক্ষাক্ষেত্রেও পাকাপাকিভাবে দলতন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। এবং
বর্তমান শাসক দলও সাফল্যের সঙ্গে সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, ভবিষ্যতে যারা
আসবে তারাও করবে। এই অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে ও কতদিনে পূরণ হবে তা বলা দুস্কর।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলার মানুষ দল বদলাচ্ছে, কিন্তু চরিত্র আরও নিম্নগামী। আমাদের
জাতীয়তাবোধ কেন, কোনও মূল্যবোধই অবশিষ্ট নেই।
ভারতীয় বাঙালির
সাংস্কৃতিক জাতীয়তা
বিগত কয়েক বছর কিঞ্চিৎ লেখালিখির সুবাদে
বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সাহিত্যকেন্দ্রিক বিনোদনের আসরে উপস্থিত থাকার সুযোগ ঘটেছে।
সভাগুলোয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আগে ভাগে দীর্ঘ বক্তব্য রেখে বা নিজেদের রচনা পাঠ করে
প্রস্থান করেন। অবিশিষ্টদের কাছ থেকে তাঁদের কিছু শোনা বা জানার থাকে না। সন্ধ্যের
অনুষ্ঠানে দূরাগত ও মহিলাদেরও একটু ‘আগে ছেড়ে দেওয়া’ হয়। ঘোষক/ঘোষিকা, আয়োজক পক্ষের গুটিকয় মানুষ,
সভাপতি, মাইকম্যান এবং দিনের শেষে উদ্বৃত্ত জনাকয় কবি সাহিত্যিক ছাড়া অনুষ্ঠানের
শেষ পর্ব বিশেষ কেউ দেখে না। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকলে অবশ্য অন্য কথা। যাইহোক,
অনুষ্ঠানের শুরুতে থাকে উদ্বোধনী সঙ্গীত, মধ্যে মধ্যে গান, শ্রুতি নাটক, আলোচনা
ইত্যাদি। আর শেষের কথা তো শুরুতেই বললাম। ছোটবেলায় স্কুলে শিখেছিলাম, যেকোনও
অনুষ্ঠানের শেষে জাতীয় সঙ্গীত (আসলে জাতীয় মন্ত্র) গাইতে হয় ‘সাবধান’এ দাঁড়িয়ে। সেই
শিক্ষা বিদ্বজ্জন সভায় পরিত্যাজ্য। আমারও প্রথম দিকে মাথাতে আসেনি, সাহিত্য সভার
সাথে দেশাত্মবোধের কোনও যোগ থাকতে পারে।
কিন্তু ভাবনাটা গুলিয়ে গেল ডায়মন্ড হারবারে
এক গোষ্ঠীর আয়োজনে ইলিশ উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে। অনুষ্ঠান শুরু হল “আমার সোনার
বাঙলা/আমি তোমায় ভালোবাসি” উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে। গায়িকার সযত্ন পরিবেশনে বেশ আবিষ্ট
হয়েই শুনছিলাম সবাই। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে আগত দুই মহিলা কবি উঠে এসে গান থামিয়ে
সমবেতদের হুকুম করল, যেহেতু এটা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, সকলকে উঠে দাঁড়িয়ে শুনতে
হবে। দু-একজন একটু গাঁইগুঁই করলেও আদেশ পালিত হল। একজন বেয়াড়া মানুষ কেবল ‘আমার কাছে এটা
রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা বসে শুনলেই বেশি উপভোগ করতে পারব’ বলে বসে থেকে
গানটি শেষ হবার পর উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দেয়। স্বদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে ওভাবে মাঝপথে
থামিয়ে দেওয়া কতটা সঙ্গত জানিনা; তবে গানের তাল আবেদন ভঙ্গ করেও ঐ দুই মহিলা
পররাষ্ট্রে আমন্ত্রিত হয়ে এসে যে সাহসিকতা, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের পরিচয় রাখল,
তার প্রশংসা না করে পারি না। সেই সাথে মনটা আত্মগ্লানিতে ভরে যায় আমাদের দেশের
বঙ্গবাসীদের আপন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়াহীন অমেরুদণ্ডী
সমর্পণের জন্য।
এমনিতেই ওদেশ থেকে আসা সাহিত্যিক পদবাচ্যই
নয়(হুকুম কর্ত্রীদের একজন) এমন ব্যক্তিকেও পদক, স্মারক, পুষ্পস্তবক, মানপত্র,
উত্তরীয় ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সম্মান জানানোর পরও তার প্রতিক্রিয়া,
বক্তৃতা, রচনাপাঠের জন্য যথেচ্ছ সময় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যা হয়েই থাকে। এদেশের
নন-সেলিব্রিটি কবিদের করতালি দিয়ে বঙ্গালী উপভাষার মিশ্রণে কথিত বক্তৃতাকে স্বাগত
জানানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিল না। ভিআইপি স্লটের ফাঁকেই সামান্য সময় প্রার্থনা
করে নিজের সংক্ষিপ্ত কবিতা পরিবেশনের পর আমি বলেছিলাম, ‘আমন্ত্রিত কবি বন্ধুদের দেশাত্মবোধের
আন্তরিক প্রশংসা করে আমি প্রস্তাব রাখছি অনুষ্ঠান শেষ যেন হয় “জনগণমন” দিয়ে এবং যথাযোগ্য সম্মান
সহকারে। জয় হিন্দ।’ উত্তরে আয়োজক তথা ঘোষকের বিদ্রূপ ভেসে আসে, ‘অনুষ্ঠান রাত বারোটা
পর্যন্ত চলবে। জনগণমন নিয়ে চিন্তা নেই।’ বলা বাহুল্য সকলেরই ট্রেন ধরে সেদিন ফেরার
তাড়া ছিল, রাত বারোটার অনেক আগেই অনুষ্ঠানের সপাপ্তি ঘটে এবং যথারীতি ‘জনগণমন’ অগ্রাহ্য করে।
তবে সমবেত এদেশীয় কবি সাহিত্যিক সতীর্থরা অনেকেই আমায় করতালি সহ অভিবাদন জানিয়ে
বুঝিয়ে দেন, আমার বক্তব্য তাদেরও মনের কথা ছিল।
উক্ত আয়োজকের বক্তব্য ‘জনগণমন’তে সিন্ধুর কথা
উল্লেখ আছে, যা এখন পাকিস্তানে। সুতরাং গানটির জাতীয় সঙ্গীত (অনেকেই জানে না, এটি ‘জাতীয় মন্ত্র,
জাতীয় সঙ্গীত হল ‘বন্দে মাতরম’) হওয়ার যোগ্যতা নেই। প্রস্তর যুগের কিছু প্রাগৈতিহাসিক
নিদর্শন ছাড়া ভারতের সভ্যতার ইতিহাস শুরুই হয়েছে যে সিন্ধু সভ্যতার আলোচনা দিয়ে,
যে নদটির কিছু অংশ এখনও ভারতের(কাশ্মীর?) বুকেও বইছে, যে সিন্ধু থেকেই হিন্দু,
হিন্দুস্তান, ইন্দাস, ইন্ডিয়া শব্দগুলির উৎপত্তি; তার নাম ভারতের মানচিত্র থেকে
মুছে ফেলতে হবে? ১৯৪৭-এ অগণিত মানুষের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে ভারতের অঙ্গহানি ঘটিয়ে
সেই প্রদেশটির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটাই ভারতের জাতীয় পরিচয়ের নিয়ামক হবে? আমাদের
বেদমন্ত্রে যে সাতটি পবিত্র নদ-নদীর বা সপ্তসিন্ধুর উল্লেখ আছে তারা হল গঙ্গা,
যমুনা, সিন্ধু, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা ও কাবেরী। অথচ সম্প্রদায় নির্বিশেষে
এইরকম বিদেশী রাষ্ট্রতোষী প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু বাঙালী সাহিত্যিককূলের,
যার প্রতিফলন বারবার বিভিন্ন সাহিত্য সভায় দেখা যায়, বিশেষত যেখানে বঙ্গভাষী
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কেউ আমন্ত্রিত থাকেন।
১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের
দেশের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিও গড়ে ওঠে,
সরকারিভাবেই এদেশের অনেক সৈনিক পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।
১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনে শহিদের তালিকায় মূলত মুসলমান বাঙালির নাম দেখা গেলেও পূর্ব
পাকিস্তানের হিন্দু বাঙালিদের আত্মদান ছিল না ভাবাটা কষ্টকল্পিত। কলকাতা রেডিও
থেকেই প্রথম ঘোষিত হয় ‘জয় বাঙলা’। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রও প্রথম স্থাপিত হয়েছিল এই পশ্চিম
বাঙলার মাটিতে। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয়দের গর্ববোধ, বিশেষ করে
ভারতীয় বাঙালিদের বাড়তি আবেগ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই আবেগের আতিশয্যে
আমরা প্রায়শ নিজেদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়টি বিস্মৃত হই যেন। বাংলাদেশে কবিতা উৎসবে যোগ
দিতে গিয়ে দেখেছি তারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী কার্যক্রম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন
করে এবং সমস্ত বিদেশী আমন্ত্রিতদেরকেও সেই অনুষ্ঠানে শামিল করে। আবার পশ্চিবঙ্গের
এক একটি অনুষ্ঠানেও বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে
আবেগমন্দ্রিত কবিতা, বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বণি, তাঁকে নিয়ে লেখা গান কবিতার স্রোতে
সত্যিই ভুলতে বসি, কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমি ভারতবর্ষে, আমরা ভারতীয়। মনে হয় বাংলাদেশটাই
বুঝি আমাদের দেশ অথবা পশ্চিমবাংলা বাংলাদেশেরই অঙ্গ। জনৈক বাংলাদেশী কবির পংক্তি “যত দূর বাংলা
ভাষা, ততদূর আমার বাংলাদেশ” শুনতে বড় উদাত্ত হৃদয়স্পর্শী লাগে, কিন্তু এর মধ্যে উপ্ত
সাম্রাজ্যবাদটা আমাদের মষ্তিস্কে ধরা পড়ে না।
বস্তুত বাংলাদেশ তো আমাদেরই (ছিল)। এমন মনে
হওয়াতেও হয়ত গলদ থাকে না যদি পররাষ্ট্রস্তুতির পাশাপাশি সেই রাষ্ট্র গঠনে আমাদের
রাষ্ট্রের অবদানটাও স্মরণ করা হয়। ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে আমাদের তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সরাসরি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি তথা
রাষ্ট্রটির জন্ম। অথচ ভারতের মাটিতে বাঙালী বিদ্বজ্জন সভায় মুজিবরের নামে জয়ধ্বণি
ওঠে, মুজিব তথা বাংলাদেশের ত্রাণকর্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নামটি উচ্চারিতও হয় না।
ইন্দিরাকে সম্মান জানানো কি পশ্চিমবঙ্গীয় মনীষার পরিপন্থী? প্রায় চল্লিশ বছর পর
দেরিতে হলেও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ভারতের প্রাক্তন ও প্রয়াত
প্রধানমন্ত্রীকে মরণোত্তর ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মান জানিয়েছেন।
পাকিস্তানী মুসলমানদের অমানুষিক অত্যাচারে,
উর্দু নিয়ে জবরদস্তিতে শুধু হিন্দু নয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালী
মুসলমানও ভারতমুখী হয়েছিল আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা,
উত্তর-পূর্বাংশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে, জমি জবরদখলের জঙ্গীপনায়
জেরবার। তবু আমরা আশ্রয় দিয়েছি; কিছুদিনের জন্য নয়, পাকাপাকি। এর খানিকটা যদি
স্থানীয় ভোটব্যাংক তৈরীর অভিসন্ধিতে হয়েও থাকে, মূলত ছিল কিন্তু মানবতার খাতিরে।
শ্রীমতী গান্ধী বারংবার রাষ্ট্রসংঘকে আবেদন জানান বিহিতের জন্য। বোঝান, ভারত যুদ্ধ
চায় না, কিন্তু তার নাড়িছেঁড়া পেটের শত্রু (পাকিস্তান) ভারতের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে
দিচ্ছে; কারণ কোটি কোটি শরণার্থীকে জায়গা দিতে গিয়ে ভারতীয় জমি ও অর্থনীতি দুটোই
সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালি যারা এক সময় ভারত থেকে
বিচ্ছিন্ন হতেই চেয়েছিল, তাদের বাঁচাতে গিয়ে ভারত তাদের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়
নিজের সম্পদ ও জনসম্পদ ক্ষয় করে। সীমান্তে প্রহরা কড়া করে শরণার্থীর স্রোতে বাঁধ
দেয়নি। হয়ত দিলেই ভারতের পক্ষে মঙ্গল ছিল। জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ (যার জন্য
শরণার্থী প্রবেশ, অনুপ্রবেশ ছাড়াও আগত সম্প্রদায় বিশেষের জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনীহাও
দায়ী), অর্থনৈতিক সংকট এবং একটি শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের সাথে চির শত্রুতা এগুলোয়
জর্জরিত হতে হোত না। এই শত্রুতার ফলে এখনও আসমুদ্র হিমাচলে নাশকতা, লোকক্ষয়,
জনজীবনে ভীতি।
‘রাজাকার’দের মুণ্ডপাত আদতে
একটি নারা, স্লোগান। তারাও বাংলাদেশী যারা দেশের সার্বভৌমত্বের বদলে পাকিস্তান ও
উর্দুভাষীদের অধীনতা চেয়েছিল। কিন্তু তারা যে দেশটির হয়ে চরবৃত্তি করে,
স্বদেশবাসীর ওপর অত্যাচার চালায়, সেই দেশটির প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের মনোভাব কী?
ধর্মীয় কারণে ও ভারত-বিরোধিতার প্রশ্নে তারা কিন্তু আসলে মিত্র। Islamic fraternity-র এতটাই শক্তি যা বন্দুকের
নল ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই শুধু ভারতের কাশ্মীর বা পশ্চিম প্রান্ত থেকে নয়,
নাশকতাকামী জঙ্গী অনুপ্রবেশ ঘটে ভারতবর্ষের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়েও,
বাংলাদেশের মাটিতেও গড়ে ওঠে পাকিস্তানী জঙ্গীদের শক্ত ঘাঁটি, ভারতীয়
পাকিস্তানপন্থী উগ্রবাদী আবদুল করিম টুন্ডারা বাংলাদেশে পেয়ে যায় নিরাপদ আশ্রয়। এই
দ্বিচারিতার মধ্যে ভারতীয় বাঙালিদের নির্লজ্জ বিদেশী তোষণ ও খোসামোদি আমায় শুধু
লজ্জিত নয়, আতঙ্কিতও করে।
ওদেশের আতিথেয়তা নাকি অতুলনীয়। আমিও একবার
ওখানে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রশংসাই করব মুক্তকণ্ঠে। তবে অতিথিপরায়ণার চাইতে
আশ্রয়দাত্রী সাহায্যদাত্রীর ভূমিকা বড় বৈ ছোট মনে করব না। কতজনকে আর কত কারণে
আশ্রয় দেবে এই পোড়া দেশ? ১৯৪৭-এ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো কোটি কোটি ক্ষত-বিক্ষত
উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পুনরায় শরণার্থী পালন, চীন তীব্বত
আক্রমণ করে অধিকার করে নিলে বৌদ্ধ শরণার্থীর স্রোত সামলানো, বাংলাদেশ থেকে খেদানো
চাকমা শরণার্থীর ভিড়কে আশ্রয়দান, প্রতিদিন হিসাবহীন অনুপ্রবেশকারীদের পাকাপাকি
রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, সম্পত্তিক্রয়ের অধিকার প্রদান__!! বাংলাদেশের বিরাঙ্গনা
শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে অমানবিক
হতে হয়। সে দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত ও বাস্তুহারা হয় চট্টোগ্রাম,
কক্সবাজার অঞ্চলের অগণিত রাখাইন বৌদ্ধ; যার প্রতিক্রিয়ায় আজ সামরিক শাসনাধীন
ব্রহ্মদেশ থেকে উৎখাত হচ্ছে রহিঙ্গা বা মুসলিম রাখাইনরা। বাংলাদেশ সরকারেরই নৈতিক
দায়িত্ব ছিল রহিঙ্গাদের পুনর্বাসন দেওয়া বা অন্তত শরণার্থী শিবির খুলে দেওয়া। তা
কিন্তু সে করেনি; সোজা তাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তে। এমন কি রহিঙ্গারা যাতে
বাংলাদেশের মূল স্রোতে কোনও ভাবেই মিশে যেতে না পারে, সেজন্য তাদের সঙ্গে বাংদেশী
নাগরিকদের বিবাহও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। মানবতায় দরাজ আমরা আবার খুলে দিয়েছি
শরণার্থী শিবির, হোম এবং বাধ্য হয়ে হয়ত বা কারাগারও -আমাদেরই সম্পদের বিনিময়ে,
নিজেদেরই অসুবিধায় ফেলে। আমরাও কি পারতাম না, যে দেশ নিয়ে এত আবেগাপ্লুত হই, তাদের
অনুসরণে নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ ঐসব উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের দায়িত্ব এড়াতে?
না, পারি না বলেই আমরা ভারতীয় যে দেশের মোট
জাতীয় উৎপাদন উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোকে টেক্কা দিলেও মুদ্রাস্ফীতি বিপদসীমার
ঊর্ধ্বে, মুদ্রার মূল্য আন্তর্জতিক বাজারে ক্রমশ পতনশীল; পারি না বলেই আমরা ভারতীয়
বাঙালি যারা হীন প্রাদেশিকতার শিকার হয়ে
আসামের বরাক উপত্যকায় কাছাড়-শিলচর সহ সর্বত্র রক্তাত্ত হয়েও ১৯৬১র ১৯শে মের
শহিদদের ভুলে ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অধিক উন্মাদনা দেখাই। হয়ত আসামের বঙ্গাল খেদা
নিয়ে খুঁচাখুঁচি সংকীর্ণ প্রাদেশিক আবেগের পরিচায়ক ও জাতীয় একতার পরিপন্থী হবে
বলেই এই বিস্মরণ, যেখানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সম্মান জানানোয় কোনও ঝুঁকি
নেই। হয়ত আমাদের ভাষাগত পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় এক নয় বলেই এই দিশাহীন অবস্থান;
এফএম রেডিওগুলোতে উদ্ভট মিশ্রভাষার ভাষার আধিপত্য। হয়ত ভাষার কারণেই আমরা পর
রাষ্ট্রের সঙ্গে এতটা একাত্মবোধ করি। তবে এমন কিম্ভূত জাতীয়তাবোধ যে দেশের
নাগরিকদের, সে দেশ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নিশ্চই হতে পারে, কিন্তু ঐক্যে হতদরিদ্র থেকে
যায়।
সূত্র:
১. ঐকতান
গবেষণাপত্র, শরৎ ১৪১৫
২. ত্রিসপ্তক সহযোদ্ধা মঞ্চ ইশতিহার
৩. শিলচরের মাতৃভাষা আন্দোলন, ঋষিণ মিত্র,
স্বয়ংনিযুক্তি, জৈষ্ঠ্য ১৪১০
৪. ১৯শে মে হোক ভাষা-প্রণাম দিবস, অমল রায়,
স্বয়ংনিযুক্তি, জৈষ্ঠ্য ১৯১০
৫. History
of Assam, Debabrata Dutta, Sribhumi Publishing Company, 1993
৯. www.india-seminar.com/2002/510/510%20subir%20bhaumhttp://www.india.seminar.com/2002/510/510 subir bhaumik.htmik.htm
১১.
স্বাধীনতার মুখ –
ত্রিপাঠি, 86, 87
১০. J Chakrabarty – The partition of Bengal and
Assam, page 132,138, 135, 137, 140-149
১১. Jalal – The sole spokesman, page 266
১২. Bandopadhyay – জিন্না/পাকিস্তান – নতুন ভাবনা, page – 266
১৩. Chatterjee- Spoils of Partition
১৪. P. N. Luthra – Rehabilitation, page 18-19
১৬. P. N. Luthra – Rehabilitation, page 18-19
১৭. www.en.wikipedia.org/wiki/migration_in
_tripura
১৮. Talbot, Ian. 1994.
"Planning for Pakistan: The Planning Committee of the All-India Muslim
League, 1943–46". Modern Asian Studies, 28(4):875–889.
১৯. Joya Chatterji Bengal
Divided: Hindu Communalism and Partition, 1932–1947. Cambridge: Cambridge University Press,
1994. ISBN 0-521-41128-9
২০. S.M. Ikram Indian Muslims
and Partition of India. New
Delhi: Atlantic Publishers and Distributors, 1992. ISBN 81-7156-374-0
২১. Hashim S. Raza Mountbatten
and the partition of India. New
Delhi: Atlantic Publishers and Distributors, 1989. ISBN 81-7156-059-8
২২. Bandyopādhyāẏa,
Śekhara (2004). From Plassey to partition: a history of modern India.
Delhi: Orient Blackswan. ISBN 978-81-250-2596-2.
Retrieved 5 November 2011
২৩. "350 Bengalis Are Massacred in Indian Village". Pittsburgh
Post-Gazette. June 16, 1980. Retrieved July 15, 2012.
২৪.Ghosh, Kamalini
(1984). Tribal Insurrection in Tripura: A Study in Relative Deprivation.
Hyderabad: Booklinks. p. 98.
২৫. "Indian tribe massacres 350 'outsiders'". The
Miami News. June 16, 1980. Retrieved July 15, 2012.
২৬. Paul, Manas
(2010). The Eyewitness: Tales from Tripura's Ethnic Conflict.
Lancer Publishers. pp. 86-94. ISBN 1935501151.
Retrieved July 16, 2012.
২৭. "Indian tribesmen reportedly massacre Bengali
villagers". St. Petersburg Times (St.
Petersburg, Florida). June 17, 1980. Retrieved August 20, 2012.
১৯. বিভিন্ন সাহিত্যসভায় উপস্থিতি যার স্থান
কাল নোট করে রাখা নেই
২০. পরাধীন ও স্বাধীন উভয় ভারতে জীবন কাটানো
প্রত্যক্ষদর্শী
২১. বিভিন্ন সংবাদপত্র, মূলত আনন্দবাজার, Telegraph, বাংলাদেশ বার্তা
[১১,৪৫০ শব্দ]
About
ESSAYS AND FEATURES
Some very bold articulation of some very bitter truth about this subcontinent
ReplyDelete