বৈদেহী
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
রসিক ব্যক্তিদের হিসাবে মহারাজ জয়চন্দ্রের অন্তপুরিকার
সংখ্যা নাকি ষোল হাজার। তার মধ্যে পাটরাণী সহ দু-চারজন ছাড়া আর কে কে তাঁর
বিবাহিতা, হিসাবটা মহারাজের নিজের কাছেও গুলিয়ে গেছে। এটা মনে রাখার তাগিদ অবশ্য
যাঁরা রাজরাণীর মর্যাদার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন তাঁদের। যাদের
রাজকোষের অর্থ ব্যয় করে কিনে আনা হয়নি, উপঢৌকন পাওয়া গেছে উচ্চ রাজপদের বাসনায়
নানা অমাত্য ও মন্ত্রীদের কাছ থেকে, তারা প্রায় সকলেই দাবি করে তারা মহারাজের
বিবাহিতা। সেই মতো এয়োস্ত্রীর সাজ ও চিহ্নগুলো সযত্নে বহন করে, দাসীদের সঙ্গে যাতে
তাদের এক পংক্তিতে বসানো না হয়। তা রাজার কাছে রাণী ও দাসীতে বিশেষ প্রভেদ নেই।
নারীদের জাত নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার পড়ে না। কারণ অগ্নি যদি পাবক হয়, তবে
মহারাজের কামাগ্নিতে ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্রাণী সবই অগ্নিশুদ্ধ হয়ে যায়। কলহ আর
ভেদাভেদজ্ঞান কেবল অন্তঃপুরিকাদের নিজেদের মধ্যে।
আরব আর তুর্কিরা জম্বুদ্বীপ আক্রমণের পর থেকে
‘হারেম’ শব্দটা শোনা যাচ্ছে। সেখানকার রাজাগজারাও নাকি হারেমে
মেয়েমানুষ পোষে। এই দেশেও কেউ কেউ ঘাঁটি গেড়ে প্রাসাদ ও হারেম গড়েছেন। অত অত মহিলা
তো তুর্কিস্তান বা আরব থেকে আনা সম্ভব হয়নি যুদ্ধবাহিনীর সাথে; তাই ম্লেচ্ছদের
অন্তঃপুরেও এই দেশের নারীই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সুতরাং সুসমৃদ্ধ দেশীয় মহারাজকে
নিজের মান বাঁচাতে সুন্দরী নারীর সংগ্রহশালা খুলতেই হয়েছে। তবে মুসলমানদের ঠেকাতে
মহারাজের বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। তাঁর রাজধানী তো কান্যকুব্জে। তুর্কিরা হানা
দিচ্ছে অনেকটা পশ্চিম দিক থেকে। ওখানকার শাসকদের পরাস্ত না করে কি কনৌজ পৌঁছতে
পারবে?
তা ষোল হাজার না হোক অতশত নারী ভোগ করা তো মুখের কথা নয়।
এমন অনেক অন্তপুরবাসিনী আছে, যাদের সঙ্গে জয়চন্দ্রের একবারও সংসর্গ হয়নি। এই তো
কদিন আগে বিশ বাইশ জন এল। তাদের মুখদর্শনই হয়নি। তাছাড়া বয়সের চেয়ে যেন বেশি
জ্বরাগ্রস্ত হয়ে গেছেন জয়চন্দ্র। আগে এক রাতে অন্তত পাঁচ-ছবার শয্যাসঙ্গিনী না
বদলালে চলত না, দুপুরেও বেশ তীব্র কামাবেগ অনুভব করতেন। এখন বড় তাড়াতাড়ি হাঁফিয়ে
উঠছেন। বয়স মোটে বাষট্টি। রাজ বৈদ্যকে দিয়ে এই নিয়ে তিনবার বাজীকরণ করিয়েছেন।
তারপরেও দেহে প্রত্যাশিত সাড়া জাগছে না। মহারাজের কুঞ্চিত চর্মে মোড়া শিথিল পেশিতে
বল নেই, ক্ষত্রিয় হয়েও শস্ত্রাভ্যাসের ধার ধারেন না বহুদিন, স্ফীত মধ্যপ্রদেশ নিয়ে
উঠতে বসতে অসাছ্যন্দ। পুরুষত্বের পরিচয় বলতে একমাত্র রমনীবিহার অবশিষ্ট; সেটাও
এবার যাই যাই করছে। তবে তাঁর স্ত্রী দাসীদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু
চৌষট্টিকলায় পারদর্শিনীরাও সুবিধা করতে পারছে না।
জয়চন্দ্র অন্দরমহলে রমনী পরিবৃত হয়েই ঢুলছেন। সভাকবি ভট্ট
কেদার শ্রীহর্ষ প্রবেশের অনুমতি চেয়ে পাঠালেন। মহারাজ সহর্ষে তাঁকে ভেতরে আসতে
আহ্বান করলেন। মহারাজের অত্যন্ত ঘণিষ্ঠ কবির সামনে অন্তপুরিকাদের থাকতে নিষেধ নেই।
কিন্তু একবার শ্রীহর্ষ রসিকতা করেছিলেন, “সুন্দরীদের পরিধেয় দেখছি দেহ ঢাকার পরিবর্তে
অঙ্গ সৌষ্ঠব প্রকটিত করার জন্যই রচিত। মহারাজের রুচি দারুণ সূক্ষ্ম বলতে হয়”। তার পর থেকে
রাণী শ্রেণীর নারীরা তাঁর সামনে আসতে চান না, সম্ভ্রমে লাগে। কিন্তু নিম্নকোটির
উপপত্নী ও দাসীদের খাদ্য পানীয় পরিবেশন ও ব্যজনের নিমিত্ত থাকতেই হয়। তাছাড়া
সর্বক্ষণের এই লোলচর্ম রোমশ বৃদ্ধের চেয়ে কিছুক্ষণের জন্য সুদর্শন ঋজু মেদহীন
পণ্ডিত মানুষটার উপস্থিতি অনেক অন্তপুরিকার ভালোই লাগে। লোকটা মহারাজকে বিলাসে
ডুবে থাকতে উৎসাহ দিলেও নিজে ঐসব স্খলিতবসনাদের দিকে ফিরেও তাকান না। মধ্যে মধ্যে
কেবল দু একটি রসিকতা করলে বোঝা যায় তাঁর চোখে সব অদেখা থাকে না।
জয়চন্দ্র প্রাণের বন্ধুকে পেয়ে হাঁউমাউ করে উঠলেন. “তুমি এসেছ কবিবর।
আমার সকল শক্তি নিঃশেষিত। ঐ অপদার্থ চক্রপাণিকে দিয়ে আবার বাজীকরণ করালাম। সব
বিফলে, কিছুতেই ইয়ে জাগছে না। চিকিৎসার মুরোদ নেই, আবার রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো”
“বৈদ্যরাজ একটু বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন। মহারাজ বোধহয়
ভোগধর্মের পর এবার যোগধর্মের পথে হাঁটছেন”।
“একজন যোগীর কাছে সহস্র সুন্দরী কোন কর্মের?”
“বিলিয়ে দিন মহারাজ। আপনি উদার হলে প্রার্থীর অভাব হবে না।
শুভক্ষণ দেখে ব্রাহ্মণদের দান করুন। বিক্রয় করাটা রাজার পক্ষে মর্যাদা হানিকর হবে।
সর্বেষামেব দানানং ভার্যাদানং বিশিষ্যতে”।
“কবি কুল তিলক নিজেও তো সদ্ব্রাহ্মণ”।
“রাজার ধন কাঙালের ঘরে মানাবে না মহারাজ। শ্রীহর্ষের একটি
ব্রাহ্মণীই যথেষ্ট”।
“কতদিন পরে এলে। নতুন কী লিখেছ শোনাও। তোমার কাব্যসুধাই আমার
একমাত্র সম্বল। নারীসঙ্গে অরুচি ধরে গেছে। সাধে কি শঙ্কর বলেছেন, নারী নরকের দ্বার”।
“আমি এখন ধর্ম বিষয়ে অধ্যয়ন ও পরীক্ষানিরীক্ষা করছি মহারাজ”।
“পরীক্ষা? তোমার কাব্য যদি বা রসসঞ্চার করে ধর্মতত্ত্ব তো
মগজে কিছুই ঢোকে না। তুমি তো শাক্ত”।
“আজ্ঞে, বজ্রযানরূপে শাক্ত-উপাসনার মালমশলা ঢুকিয়ে দিয়েছি
সুগতের পূজার মধ্যে। নিজের অবলম্বন
নাগার্জুনের মাধ্যমিক দর্শন...”
“দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি বুদ্ধের উপাসক হলে কবে থেকে? তুমি
শাক্ত বলে জানতাম। তোমার পদে মাঝেমধ্যে তোমায় বৈষ্ণব বলেও ভ্রম হয়। আর নাগার্জুনের
কী যেন? সেটা আবার কী?”
“পাপ-পুণ্য, আচার-দুরাচার, বন্ধন-মোক্ষ সবই সংস্কার।
স্বর্গ-নরক কল্পনামাত্র। পূজা উপাসনা এগুলো মূর্খদের ভোলানোর জন্য। দেবদেবীর
লোকায়ত ধারণা সব অলীক। পরজন্মে কর্মফলের আশা বা ভয় সেটাও ভাঁওতা, যদিও তথাগত
পুনর্জন্মের প্রচারক ছিলেন”।
“আমি তো তাহলে নাগার্জুনের নির্দেশিত পথেই জীবন কাটিয়েছি”।
“বুদ্ধিমান লোকে তাই করে মহারাজ। নির্বোধরাই নগদ ফেলে ধারের
পেছনে ছোটে”।
“কিন্তু তুমি যে নিজেকে বেদান্তবিদ্ বল”।
“আমি আমার গ্রন্থকে বেদান্ত হিসাবেই প্রসিদ্ধ করাতে চাই
মহারাজ। আপনার অনুগ্রহের অপেক্ষা”
“সব যে গুলিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মবাদী বেদান্তের সঙ্গে শাক্ত
বৈষ্ণব বৌদ্ধ মতের কী সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক থাকার দরকার নেই। বেদপন্থীরা প্রথমে সাংখ্য দর্শনের
প্রবল বিরোধিতা করেছিল। পরবর্তীকালে সাংখ্যের কার্যকারণবাদ অগ্রাহ্য করতে না পেরে
তাকে বেদ অনুমত তকমা দিতে শতশত শ্লোক রচিত হয়েছে। নাস্তিক সাংখ্য দর্শনের সঙ্গে
ঈশ্বরবাদী বেদের এখন গলায় গলায় ভাব। -.”
“এসব বড় গোলমেলে কবি। তুমি তোমার কাব্যই শোনাও”।
“ধর্ম ব্যাপারটাই গোলমেলে মহারাজ। আর্যরা যজ্ঞ করতেন। পূজো
করত অনার্যরা। আজ কেমন আমরা পূজোও করি, সেই পূজোতে হোমও করি। মেলালেই মিল, তলিয়ে
দেখলে গরমিলে ভরা। আমাদের সনাতন ধর্মের নাম যে হিন্দু ধর্ম, সেটাই কি
যবনদের(গ্রীক) আগমণের আগে আমরা জানতাম? আপনার মাথা আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না
রাজন্। আমি কবি শিরোমণি এবং বেদান্ত বিশারদ এই খ্যাতিটুকু পেলেই হল। আপনার
প্রশস্তি গেয়ে ‘জয়চাঁদ প্রকাশ’ গ্রন্থটি রচনা শুরু করেছি। তবে মুসলমান
আগ্রাসনের আগ বাড়িয়ে বিরোধিতা না করাই ভালো। আপনার জামাতা তরুণ, অনভিজ্ঞ”।
শ্রীহর্ষ এরপর প্রেমের পদ্য আবৃত্তি শুরু করলেন। মহারাজের
সুরাসক্ত চোখ আবার বুঁজে এল। জড়ানো গলায় বললেন, “অভূতপূর্ব। আজই তোমায় কবি
কুল তিলক উপাধি দিলাম। যাও পুরস্কার স্বরূপ চারজন দাসীও তোমায় দিলাম। তাদের ভোগ না
করো, গৃহকর্মে তো লাগাতেই পারো। ব্রাহ্মণী এই বয়সে একটু বিশ্রাম পান। বল, আরও বল। ”
কবির কাব্যপরিবেশনের মধ্যেই মহারাজের নাক ডাকতে শুরু করল।
সহসা আবৃত্তি থামিয়ে পরিপূর্ণ ঘুমিয়ে পড়ার আগেই জয়চন্দ্রকে জাগিয়ে ভট্ট কেদার
বিদায় নিলেন।
মহারাজের স্নান হয়নি। দ্বিপ্রা্রিক আহারের সময় পেরিয়ে
যাচ্ছে। রাঁধুনি থেকে দাসীরা সবাই তটস্থ। রাণীদের কানে খবর যেতে একজন এসে ব্যাজার
মুখে ঝাঁকিয়ে রাজাকে তুলে দিলেন। এক ঝাঁক দাসী গেল তাঁকে স্নান করিয়ে আনতে। মুখের
সামনে থালা বাটি বেড়ে পাখার বাতাস করতে করতে তারা ‘হাপুস হুপুস’ শব্দে বৃদ্ধের
খাওয়া শেষ হবার প্রতীক্ষা করতে লাগল। জয়চন্দ্রের পায়েস রক্তাভ হয়ে গেল। আর একটি
দাঁত মাড়ির আশ্রয় ত্যাগ করেছে।
খাওয়ার পর প্রমোদক্ষেই আবার একটু গড়িয়ে নেবেন ভেবেছিলেন।
রাজবৈদ্য চক্রপাণি দর্শনপ্রার্থী হয়ে এলেন। দূর ছাই! কাজের কাজ করতে পারলি না,
আমায় রাজকার্যে পরামর্শ দিয়ে মাথা খেতে এসেছে। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাঁকে প্রবেশের
অনুমতি দিলেন। সঙ্গে করে কুমার হরিশ্চন্দ্রকে এনেছেন যে। কুমারের মাতৃস্থানীয়া
অর্ধ-নগ্নিকার দল প্রমোদকক্ষ ত্যাগ করল।
“প্রণাম মহারাজ”। চক্রপাণি করজোড়ে নতমস্তক
হলেন।
“প্রণাম পিতা”। কুমার দায়সারা ভাবে রাজার চরণ স্পর্শ করল।
“পিতা, তাহলে কি রাজা পৃথ্বিরাজকে আমরা কোনওভাবেই সাহায্য
করব না?”
“কোন পৃথ্বীরাজ?”
“আপনার জামাতা। সংযুক্তার স্বামী”।
“ঐ কুলাঙ্গার যে সংযুক্তাকে হরণের পূর্বে আমার মাসতুতো
ভ্রাতা ছিল। সয়ম্বরের দিন আমার মুখে চুনকালি মাখিয়েছিল যে? সে আমার জামাতা কীসের?
সংযুক্তাও সয়ম্বরা হয়নি, কুল ত্যাগ করেছে”।
চক্রপাণি বিনীতভাবে বললেন, “মহারাজ, পৃথ্বীরাজ
শুধু আপনার জামাতা বলে নয়, হিন্দুদের বড় ভরসা। শেষ আশাও বলা যায়। ওঁর প্রবল
প্রতিরোধের জন্যই তুর্কী সুলতান কান্যকুব্জ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারছে না”।
“বটে? কাকা হয়ে যার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বিবাহ করতে বাধল না তার
কীসের হিন্দুত্ব? মুসলমানরাও তুতো ভাই-বোনে বিয়ে করে শুনেছি, কিন্তু এমন অনাচার
করে না। আরবরা সিন্ধু জয় করেছে। ঘোরি বড় জোর দিল্লী জয় করবে। দিল্লী তো আমার
দাদামশাইয়ের। আমায় ফাঁকি দিয়ে দিল্লীর সিংহাসন হাতাল পৃথ্বী। তাতেও শখ মেটেনি,
আমার মেয়েটাকেও কেড়ে নিল। এখন কনৌজের হিতাহিত শিখতে হবে তার কাছে?”
“মহারাজ, কান্যকুব্জ দুই শত বছর ধরে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য। তুলনায় পৃথ্বীরাজের আজমীর
কতটুকু? তাই হয়ত রাজা অঙ্গপাল তোমর ছোট দৌহিত্রকে দিল্লীর উত্তরাধিকার দিয়েছেন।
এখন এই নিয়ে রেষারেষি করার সময় নয় মহারাজ। তুর্কীরা শুধু দিল্লীতে থেমে থাকবে না।
ওরা শুধু রাজ্য জয় ও লুণ্ঠনেও থেমে থাকে না, জোর করে ধর্মান্তকরণ করিয়ে বিজিতদের
মধ্যে থেকেই সেনা সংগ্রহ করে নেয়, নিজের দল ভারি করে, দেবালয় ধূলিস্মাৎ করে। আপনার
জামাতা বাধা না দিয়ে যদি শুধু পথ ছেড়ে দিতেন, তাহলেই সুলতান দ্বারা পুরস্কৃত হতেন।
কিন্তু ঐ ছোট্ট রাজ্য আর সীমিত সেনাবল নিয়ে
তরাইনের যুদ্ধ জিতেছেন। কিন্তু সৈন্য কমতে কমতে তিনি ক্রমশ বলহীন হয়ে
পড়ছেন। আমাদের নিজেদের স্বার্থে, কনৌজের স্বার্থে, গহড়বার রাজবংশের স্বার্থে, ধর্মের
স্বার্থেও তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। আমাদের সেনানায়কগণ অনভ্যাসে যুদ্ধবিদ্যা ভুলতে
বসেছে। তাদের তৈরী হতে আদেশ করুন মহারাজ”।
“থামুন দেখি। নিজের কাজটা ঠিক মতো করতে পারলেন না, রাজনীতি
শেখাতে এসেছেন। তিন তিনবার বাজীকরণ করালাম। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বিশজন নগ্ন
নারীর আলিঙ্গনেও কাম জাগছে না..”
কুমার হরিশ্চন্দ্র নতমস্তকে মুখ ফেরাল। একেবারে মতিচ্ছন্ন।
পুত্রের সামনেও মুখে আগল থাকছে না। দাঁতে দাঁত চেপে বাপের দিকে না তাকিয়েই বলল, “বৈদ্যরাজ ঠিকই
বলেছেন পিতা। কান্যকুব্জ আর নিরাপদ নয়। আর গহড়বারের সূর্য অস্ত গেলে হিন্দুদের
সূর্যও অস্ত যাবে। আপনাকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে না। আপনি শুধু আমায় অনুমতি দিন,
আর আপনার সেনাপতিদের আদেশ দিন”।
“আমরা মল্লগ্রামের ব্রাহ্মণরা ধর্মকর্ম ও শাস্ত্রের সাথে
শস্ত্রবিদ্যাতেও পারদর্শী। আপনি আদেশ করলে তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরাও সর্ব
শক্তি দিয়ে ঝাঁপাব”।
“দিলে তো আমার দিবানিদ্রা পণ্ড করে। যদি শরীরে যৌবন ফেরানোর
কোনও বিদ্যা তোমার জানা থাকে তো প্রয়োগ করো। অনধিকারচর্চা করতে এসো না। আর আমার
ছেলেটাকে উস্কিয়ে ওর মাথা খেয়ো না। তার স্ত্রী সন্তান আছে। এখন বিদায় হও”। ভেতরের কক্ষের
দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁকলেন, “তোমরা এসো। খানিকটা সুরা এনো। নাহলে ঘুম আসবে না।”
সংক্রান্তির দিন জয়চন্দ্র গঙ্গা তীরে জলকুশ দিয়ে বেশ কিছু
উপপত্নী ও দাসী ব্রাহ্মণদের দান করলেন। মহারাজকে খুশি করতে শ্রীহর্ষও গ্রহণ করলেন
বিনিয়োগ হিসাবে। পরে বিক্রয় করা যেতে পারে। নিজের জীবন সংযত। বেদান্তবিদ্ ও
কবিখ্যাতি ছাড়া তাঁর আর কিছুতে লালসা নেই। চক্রপাণির মানুষ কেনাবেচা বা দানে মন
নেই। তাঁর চিন্তা পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হিন্দু রাজ্যগুলোকে কী করলে একত্রিত করা
যায়? এর চিকিৎসা তাঁর জানা নেই। এতদিন ধরে জয়চন্দ্রের রাজবৈদ্য তিনি। তাঁকেই
সৎকাজে প্রাণীত করতে পারলেন না। মহাভারতে অস্ত্রগুরুরা ছিলেন মূলত ব্রাহ্মণ।
পরশুরাম তো ব্রাহ্মণ ছাড়া ক্ষত্রিয়দের শিক্ষাই দিতেন না। অথচ কালে কালে ক্ষত্রিয়
ছাড়া আর কারও অস্ত্র ধারণের অধিকার নেই। সমাজের নীচুতলার অমানুষিক পরিশ্রম করা
মানুষগুলি অস্ত্রচালনায় দক্ষ হলেও তাদের সেনাবহিনীতে নেওয়া হয়না। এমনকি
ক্ষত্রিয়ানীদেরও শুধু আগুনে পুড়ে আত্মহত্যার তালিম দেওয়া হয়েছে। জ্বলন্ত চিতায়
ঝাঁপ দেওয়ার আগে যারা দুবার ভাবে না, তাদের কি সাহস বা মনবলের অভাব? তাদের হাতে
অস্ত্র তুলে দিলে রাজান্তপুর থেকেই অন্তত সহস্র সংসপ্তক বেরিয়ে আসত। মল্লগ্রামের
মতো কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া ব্রাহ্মণরাও ধর্মচর্চা ছাড়া অস্ত্রচর্চায় আগ্রহী নন। হলে
ঐ তুর্কীপতি খড়কুটোর মতো উড়ে যেত।
অন্দরমহলের রমনীরা যারা নিজেদের রাজ-পত্নী ভাবতে ভালোবাসত,
তারা ব্রাহ্মণদের সাথে বিদায় কালে মহারাজের জন্য খুব দুঃখিত মনে হল না। শুধু নতুন
প্রভু কী ধরণের জন্তু সেই ভেবে এবং রাজবাড়ির ঠাটবাট অলংকার বজায় থাকবে কিনা ভেবে
কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট হল। একজন শুধু কিছুতেই মহারাজকে ছেড়ে যেতে রাজি হল না।
রাণীদের পায়ে ধরে তার বদলে অন্য দাসীকে দানসরণিতে দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করল।
মহারাজ তাকে গ্রহণ করুন বা না করুন সে মহারাজকেই স্বামীত্বে বরণ করেছে। অন্য
পুরুষের দাসত্ব স্বীকার করতে হলে বিষ পানে আত্মহত্যা করবে। একজন দাসীর আত্মাহুতিতে
কিছুই যায় আসে না। তবে পরিবর্তে ইচ্ছুক দাসী পেয়ে যাওয়ায় বৈদেহীকে রাজান্তপুরেই
রেখে দেওয়া হল। তাছাড়া সে উচ্চ বংশের।
বৈদেহীর পিতা তাকে রাজার কাছে রাজপদ লাভের আশায় উপঢৌকন
দিয়েছিল। রাজপদ না পেলেও সুন্দরী কন্যার বিনিময়ে ব্রাহ্মণ খানিকটা নিষ্কর ভূমি লাভ
করে। পিতা যেদিন ঐ লোলচর্ম কামুকটার হাতে তাকে সমর্পণ করেছিল, বৈদেহী সেদিন মাকে
জড়িয়ে ধরে, বাপের পায়ে পড়ে কত কান্নাকাটি করেছিল। জোর করে রাজবাড়িতে রেখে যাওয়ার
পর টানা তিনদিন অন্ন স্পর্শ না করে শুধু অঝোরে কেঁদে গিয়েছিল। বাপের স্তোকবাক্য, “রাজভার্যা হওয়া
কতখানি সৌভাগ্যের জানিস?” শুনে আর রাজার ঐ শ্রী দেখে ভয়ে ঘেন্নায় কুঁকড়ে থাকত, কোন
দিন তার সাতপাক হয় আর তারপরেই ডাক আসে শয্যায়। আরও ভয়, ঘাটের মড়ার প্রাণ পাখি কবে উড়ে
যায় ঠিক নেই; তখন যদি তাকেও জ্বলন্ত চিতায় উঠতে হয়? কিন্তু দিন যায়, সপ্তাহ যায়,
বৈদেহী অনশন ত্যাগ করে আহার পানীয় গ্রহন করে দেহে বল পায়, কিন্তু বিবাহের কথা ওঠে
না। তাহলে কি সে উপপত্নী হয়ে কাটাবে? ছিছিঃ! কিন্তু বাস্তবে উপপত্নীও নয়, তার
স্থান হয় অনেকটা দাসীর মতো। রাজামশাই রাণী ও রক্ষিতাদের নিয়ে প্রমোদে মত্ত থাকার
সময় বৈদেহীকে পানীয় পরিবেশন ও নানা ফাই ফরমাশ খাটতে হোত। এমন ইন্দ্রিয়পরায়ণ যে
পুরুষ, যিনি কুদর্শনা দাসী পরিচারিকাদেরও শয্যায় তোলেন, তিনি বৈদেহীর দিকে ফিরেও
তাকান না। ব্রাহ্মণকন্যা হয়ে দাসীর স্থান,
সুন্দরী হয়েও এমন অবজ্ঞা! অসহনীয় লাগত। অন্য কাউকে দান করে দিলে সে হয়ত তার দেহ
ভোগ করত, দাসী পদ থেকে উত্তরণ হোত কি? কোথায় তার রাজভার্যা হবার কথা, সেখানে
দাসীদের সারিতে দাঁড় করিয়ে তাকে বিতরণ করা হচ্ছিল? রাজান্তপুরে যখন ঢুকেইছে, তখন
সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
মহারাজ প্রমোদকালে কোনও রাণীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকেন,
আবার সুরা পানের আগে প্রিয়তমাদের ওষ্ঠ স্পর্শ করিয়ে ‘প্রসাদ নিচ্ছি’ বলে রহস্য করেন।
কত অজাত-কুজাতের নারীরাও বাদ যায় না। অথচ বৈদেহী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদসেবা করলে
তার কোলে মহারাজের চরণযুগলই থকে যায়, মাথা ওঠে না। কোনওদিন বৈদেহীর ওষ্ঠে পানপাত্র
তুলে ধরেন না। এমনকি যেদিন জয়চন্দ্র রাতে সঙ্গিনী বাছাই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থেকে
একাধিক নারীকে শয়নকক্ষে নিয়ে যান, সেদিনও রূপসী বর্ণশ্রেষ্ঠ বৈদেহীর দিকে চোখ পড়ে
না। বৈদেহীর ক্রোধের সাথে জেদও বেড়ে যায়। বছরখানেক আগে সে রাজার অঙ্কশায়িনী হবে না
বলে কেঁদেছিল, এখন শয্যায় উপেক্ষিতা বলে লুকিয়ে চোখের জল ফেলে, রোষে দেওয়ালে মাথা
কোটে। অন্যান্য পত্নীদের মতো সীমান্তে সিঁদুর দেয়, তাদের বিদ্রূপ উপেক্ষা করে
সধবার ব্রত করে। পাকশালে কাজের সুযোগ পেলে নিজের হাতে মহারাজের প্রিয় কয়েক পদ
ব্যঞ্জন রেঁধে পরিবেশনের পর উৎকর্ণ হয়ে থাকে প্রশস্তি শোনার জন্য। নিজেকে বোঝায় সে
বৈদেহী, সীতা। সতীত্বের পরাকাষ্ঠা। মহারাজ হয়ত সেই কারণে তার দিকে অগ্রসর হতে
পারছেন না। যেদিন তাঁরও চরিত্র বহুগামিতা থেকে একমুখী হবে রামচন্দ্রের মতো, সেইদিন
তিনি নিঃসঙ্কোচে বৈদেহীর বুকে
মাথা রাখবেন।
শাহাবুদ্দিন মহম্মদ ঘোরি পৃথ্বীরাজকে
যুদ্ধবন্দি করার সময় জয়চাঁদের সহায়তা পেয়েছিল। দিল্লী হস্তগত, এখন তার কনৌজও চাই।
বাধ্য হয়ে অনভ্যস্থ মহারাজ জয়চন্দ্র রাঠোরকে
যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হয়েছে। রাজকুমার হরিশ্চন্দ্রের নেতৃত্বে ও চক্রপাণির
পরামর্শে কান্যকুব্জ তরুণ সেনা ও সেনানায়করা গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বারানসীতেও সৈন্য সংগ্রহের কাজ চলেছে। যমুনার বুকে অস্থায়ী নৌশিবির নোঙর করে আছে।
একটি অভিযান থেকে আহত হয়ে ফিরেছে রাজকুমার। বৈদ্যরাজ তার চিকিৎসা ও স্ত্রী ভামা
তার সেবা করছে। কিন্তু পিতা জয়চন্দ্রের যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে। চান্দাওয়ার থেকে তাঁর
দেহ এনে অন্তপুরে পাঠানো হয়েছে। সৎকার থেকে পারলৌকিক ক্রিয়া কুমারেরই কর্তব্য।
দান, বিলি করার পরও রাজান্তপুরিকার সংখ্যা সহস্রের বেশি। রাণী পদ্মাবলী ছাড়া আর
কতজন সহমরণে যাবে বোঝা যাচ্ছে না। যুদ্ধের
জন্য অর্থ চাই। রাজকোষ ক্ষয় করে এত এত
অন্তপুরিকা পোষার কোনও মানে হয় না। সুতরাং সহমরণে যতজন যায় ততই মঙ্গল।
তাদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে নারীবাহিনী গড়ে তোলা বৈদ্যরাজের অলীক কল্পনা। সিংহাসনে
আরোহন ও আসীন থাকার জন্য হরিশ্চন্দ্রকে এবার চক্রপাণির পরামর্শ নয়, মহম্মদ ঘোরির
অঙ্গুলি হেলনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
হরিশ্চন্দ্রের মায়ের অনেক দিনের প্রতীক্ষা
পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হতে দেখবেন। কিন্তু একবার সতী হওয়ার কথা ঘোষণা যখন করে
ফেলেছেন, তখন আর পিছু ফিরে তাকানোর জো নেই। পুরোহিতকুল উপপত্নীদেরও পরকালে স্বামীর
সেবা করে পূর্ণ পত্নীত্বের অধিকারলাভে অনুপ্রাণীত করছেন। অনেকেই ধর্মপত্নী নয় বলে
সরে আসতে চাইছে। পরিচারিকা ও দাসীদের ভয় নেই।
ভয় নেই। কিন্তু আত্মসম্মান তো আছে। দু বছর
রাজ সান্নিধ্যে থেকেও রূপসী ব্রাহ্মণকন্যার পত্নীত্ব এমন কি উপপত্নিত্বও জোটেনি,
সে কথা স্বীকার করে কী করে? শ্মশানযাত্রার সময় সেও সধবার বেশভূষায় সুসজ্জিতা হয়ে
এগিয়ে এসে রাজার মৃতদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু মহারাজের চিতায় তো এতজন সতীর
স্থান সংকুলান হবে না। তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী পৃথক পৃথক চিতায় সাজিয়ে অন্তপুরিকারা
যে যার চিতা প্রদক্ষিণ করতে লাগল। বৈদেহী জেদ ধরল মহারাজের চিতাতেই সে সহমৃতা হবে।
ইস্! দাসীর শখ কত? কোলে মাথা তো দূর পাদুখানি নিয়ে বসারও জায়গা হল না। তার জন্য
নির্মিত ছোট চিতায় মহারাজের গাত্রবস্ত্র নিক্ষেপ করে পুরোহিত বললেন প্রদক্ষিণ শেষ
করে প্রবেশ করতে। ওদিকে মূল চিতায় ও অন্য কয়েকটিতে অগ্নিসংযোগ হয়ে গেছে। নারীদের
আর্ত-চিৎকারে শ্মশানের কাকপক্ষী ভয় পেয়ে উড়ে পালাতে শুরু করেছে। বৈদেহীর সাতপাক
হয়নি, ফুলশয্যা হয়নি, স্বামীর সাথে কথাও হয়েছে কিনা স্মরণে আনতে পারছে না। এমনকি
এক চিতায় স্থান পর্যন্ত হল না। অথচ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে চলেছে। বিষম যন্ত্রণাকাতর
চিৎকার, কোলাহল, জয়ধ্বণি, চারপাশে প্রজ্বলিত চিতার উত্তাপ, পাখিদের ভীত কাকলি –বৈদেহীর রাজভার্যা
হওয়ার শখ মিটে গেছে। সে পালাতে চায়। কিন্তু আর পথ নেই।
অনুপ্রেরণা : ভোলগা থেকে গঙ্গা: রাহুল
সাংকৃত্যায়ন
তথ্য : wikipedia
ঐতিহাসিক তথ্যে মতভেদ আছে। বৈদেহী চরিত্রটি
কাল্পনিক